ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আইএসের হাতে কুবেরের ধন!

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৮ এপ্রিল ২০১৮

আইএসের হাতে কুবেরের ধন!

সেই দিনগুলো গত হয়েছে যখন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের কালো পতাকা ইরাকের এক-তৃতীয়াংশ এবং সিরিয়ার প্রায় অর্ধেক অংশজুড়ে পত পত করে উড়ত। সেই ইসলামিক স্টেট ধসে পড়েছে। স্বঘোষিত খেলাফতের প্রায় ৯৮ শতাংশই বণাঙ্গনে হাতছাড়া হয়ে গেছে। আইএস যখন তুঙ্গে ছিল তখন এর যোদ্ধার সংখ্যা ছিল সম্ভবত এক লাখ কি তারও বেশি। কিন্তু এর প্রায় ৭০ হাজার যোদ্ধাই লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যুদ্ধে পরাস্ত এবং রাষ্ট্রটি ধসে পড়ার পর এর হাজার হাজার যোদ্ধা পালিয়ে গেছে। কিছু যোদ্ধা ইরাক ও সিরিয়ায় রয়ে গেছে। বাকিরা গোপনে তুরস্কে চলে গেছে কিংবা মিসর, লিবিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অঙ্গসংগঠনগুলোতে গিয়ে ভিড়েছে। আইএসের প্রায় ১০ হাজার বিদেশী যোদ্ধা মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে চলে গেছে বলে জানা যায়। আইএসের যারা জিহাদ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর সেটা করার মতো উপায় এখনও তাদের হাতে আছে। লাখ লাখ ডলার এরা এই অঞ্চলজুড়ে গোপনে জমিয়ে রেখেছে। এরা ইরাকে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছে, তুরস্কে সোনা কিনে রেখেছে এবং অঙ্গসংগঠনগুলোর কাছে অর্থ পাচার করে চলেছে। জিহাদীদের অর্থ স্থানান্তরের কাজে জড়িত এক সাবেক অস্ত্র ব্যবসায়ী বলেছেন, ‘আইএস ভূখ- থেকে যে কি পরিমাণ অর্থ বাইরে চলে গেছে তা আপনারা বিশ্বাসই করতে পারবেন না।’ ইরাকের এক পার্লামেন্ট সদস্যের হিসাবে পিছু হটার সময় আইএস ৪০ কোটি ডলার ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে পাচার করেছে। ইরাক ও সিরিয়ায় ঘাঁটি গেড়ে বসার পর আইএস নগদ অর্থে বিশাল মজুদ গড়ে তোলে। তারা দখলকৃত তেল খনিগুলো থেকে তেল বিক্রি করে দেয়, তাদের শাসনাধীন এলাকার লোকজনের কাছ থেকে কর আদায় করে, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং ইরাকী ব্যাংকগুলো থেকে সম্ভবত ৫০ কোটি ডলার লুটে নেয়। এভাবে সংগঠনটি ইতিহাসের সবচেয়ে বিত্তশালী সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হয়। ২০১৫ সালে খিলাফতের জিডিপি ছিল ৬০০ কোটি ডলার। বিদেশী দান বা অর্থায়নের পথ রুদ্ধ করে সন্ত্রাসীদের তহবিল বঞ্চিত করার প্রচলিত কৌশলগুলো তেমন কোনই কাজে আসেনি। তাই আমেরিকার নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী কোয়ালিশন সংস্থার রিফাইনারি ও তেলের ট্যাঙ্কারগুলোর ওপর বোমা ফেলে এর নগদ অর্থের মজুদ ধ্বংস করে দেয় এবং এর বিত্তশালী লোকজনকে গুপ্ত ঘাতকের দ্বারা শেষ করে দেয়। ইরাকী সরকার আইএস ভূ-খ-ে সরকারী কর্মচারীদের বেতন প্রদান বন্ধ করে দেয় যাতে করে জিহাদীরা তার ওপর ভাগ বসাতে না পারে। এই কৌশল একটা নির্দিষ্ট অবস্থা পর্যন্ত কাজে দিয়েছিল। আইসের তেল থেকে অর্জিত আয় কমে যায় এবং সংগঠনটি তার যোদ্ধাদের বেতন-ভাতা কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তার পরও আইএস তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলো থেকে অর্থবিত্ত দোহন করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ক্রমশই এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে আইএসের অর্থায়নের পথ বন্ধ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়টা হলো এক ভূখ- থেকে বঞ্চিত করা। জিহাদীরা অবশ্য আগে থেকে আঁচ করতে পেরেছিল যে তাদের ভূখ- হারাতে হবে। গত বছরের মার্চ মাসে গ্রুপটি সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে তার নিজস্ব কাগজী মুদ্রার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। পরে সেই নির্দেশ মুদ্রা ব্যবসায়ী ও মানি এক্সচেঞ্জ কেন্দ্রগুলোতে সম্প্রসারিত করা হয়। এতে করে আইএস সিরিয়ার পাউন্ড ও আমেরিকার ডলার বাগিয়ে নেয়ার সুযোগ পায়। ইরাকে তারা শত শত মানি এক্সচেঞ্জ কেন্দ্র নতুন করে চালু করে। তার মধ্যে কয়েক ডজন কেন্দ্র ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ইরাকের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারেন্সি নিলামেও অংশ নিয়েছিল এবং তার ফলে গ্রুপটি সরকারের হামলা শুরু হতে পারার আগেই ইরাকী দিনার ডলারে রূপান্তরিত করে নিতে পেরেছিল। সিরিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন তুর্কী নগরীগুলোতে কারেন্সি ব্যবসায়ীরা জানায়, গত বছরের প্রথম দিক থেকে আইএস তার খিলাফতের বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে নিয়ে চলেছে। এই অর্থ হাওয়ালা ব্যবস্থায় স্থানান্তরিত করা হয়। এটি হলো অর্থ স্থানান্তর কেন্দ্রগুলোর একটি ঘরোয়া জাল। এতে অর্থ স্থানান্তরের কাজটা সস্থা, দ্রুত এবং একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা প্রায় অসম্ভব। সিরিয়া ও তুরস্কে হাওয়ালা কেন্দ্রগুলোর নেটওয়ার্ক সিরিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সম্প্রসারিত হয়েছে যার ফলে শরণার্থী, অস্ত্র ব্যবসায়ী, তেলের চোরাচালানকারী ও বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর পক্ষে দেশের ভেতরে-বাইরে অর্থ আনা-নেয়া করা সম্ভব হয়েছে। কখনও কখনও লাখ লাখ ডলারের নগদ অর্থের লেনদেন সম্পন্ন করতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। বড় লেনদেনগুলো অনেক সময় এতই বড় হয় যে একটি মাত্র হাওয়ালা কেন্দ্রে নিজের পক্ষে তা প্রক্রিয়া করা সম্ভব হয় না। কাজেই তুরস্ক, ইউরোপ, লেবানন এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশ কিছু মুদ্রা ব্যবসায়ী এতে জড়িত হয়ে পড়ে। অর্থের হদিস পাওয়া কঠিন। হাওয়ালা ব্যবসায়ীরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সাঙ্কেতিক মোবাইল চ্যাট এপ্লিকেশন হোয়াটসএ্যাপ ব্যবহার করে থাকে। তারা কদাচিৎ লেনদেনের বিস্তারিত রেকর্ড কিংবা গ্রাহকদের নাম রাখে। নগদ অর্থে সিংহভাগ তুরস্কে গিয়ে শেষ হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা সেখানে এই অর্থ ভবিষ্যতের তৎপরতার জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে মজুদ রাখা হচ্ছে, সোনায় বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং আইএসের সিøপার-সেলগুলোকে সক্রিয় রাখার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তুরস্কের পুলিশ বাহিনীর সন্ত্রাস দমন বিভাগের সাবেক প্রধান আহমদ ইয়াইলা বলেন, দুই তিন সদস্যের একটি সেলের থাকা খাওয়ার জন্য মাসে মাত্র ৫০০ ডলার লাগে। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি ইস্তানবুুলের একটি নৈশক্লাবে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার তদন্ত থেকে জানা গেছে যে, আইএস এই নগরীতে প্রায় একশ’টি নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুলেছিল। এসব আশ্রয় কেন্দ্র থেকে পুলিশ ৫ লাখ ডলারে বেশি উদ্ধার করে। আইএস তার নগদ অর্থের মজুদ এই অঞ্চলজুড়ে বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ করেছে। ইরাকে তারা ফার্ম, কার ডিলারশিপ, হোটেল ও হাসপাতাল কিনতে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাজে লাগিয়েছে যারা আদর্শের চাইতে বরং মুনাফার দ্বারাই বেশি চালিত। এদের অনেকে উপজাতীয় নেতা বা ব্যবসায়ী যারা আগে জিহাদীদের সঙ্গে কাছ করেছে, তেল, অস্ত্র, মানুষ ও মালামাল পাচার করেছে। দুর্বল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও লাগামহীন দুর্নীতির কারণে ইরাকের পক্ষে এই সমস্যা মোকাবেলা করা কঠিন। বেশকিছু মন্ত্রণালয় সন্ত্রাসবাদীদের অর্থায়ন রোধ করার চেষ্টা করলেও তেমন কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি। ওদিকে রাজনীতিকরাও কালোবাজার থেকে ফায়দা লুটছে। সরকারের ভেতরে আইএসের চর রয়েছে বলে অনেকের আশঙ্কা। নগদ অর্থ সৃষ্টি না সংগ্রহ করার সামর্থ্য এখনও আইএসের রয়েছে। সংগঠনটি এখন ভূখ- দখল থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে সশস্ত্র হামলা পরিচালনার দিকে। তাই ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক অর্থ আদায়, চোরাচালান ও অপহরণ এগুলো লাভজনক কারবার হয়েই থাকবে। ফলে নতুন ও পুরনো অর্থ বহু বছর ধরেই জিহাদীদের ব্যবসায়ে নিয়োজিত রাখবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×