ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন কেন জরুরী?

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৮ এপ্রিল ২০১৮

ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন কেন জরুরী?

বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশের ৪৩খ অনুচ্ছেদে ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে’ নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা আছে। কিন্তু আমাদের এখনও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্যে নির্দিষ্ট আইন নেই। আইনের চেয়েও জরুরী এ বিষয়ে জনসচেতনতা, সেটিও নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বুঝতে পারছি না কখন কোথায় কেমন করে আমার ব্যক্তিগত তথ্য, যা অন্যের জানা দরকার নেই, চলে যাচ্ছে ভুল পথে। আর এর ফলে আমরা বুঝতে পারছি না যে, আমরা যে কোন সময়ে একটি বিপদে পড়তে পারি বা আমার ব্যক্তিগত তথ্যের অপ-প্রয়োগ করে আমাকে কেউ বিপদেও ফেলতে পারে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই বিষয়ে আইন ও আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত কড়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান ও কোরিয়ায় এরকম আইনের যথাযথ প্রয়োগের ফলে অনেক বড় রকমের ঘটনা ঘটেছে যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা ও সচেতনতার জন্ম দিয়েছে। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি নিয়ে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে যা ফেসবুকের অর্থনীতি ছাড়াও, নানা দেশের মানুষের মনে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ও তথ্য-প্রযুক্তির জগতের জন্যেও ভবিষ্যত নিরাপত্তাহীনতার অশনিসঙ্কেতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফেসবুক নিজেও স্বীকার করে নিয়েছে, এর ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তার দায় তাদেরই। বিশেষ করে সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা ছড়াতে ফেসবুক ঘিরে যে অপপ্রচার চলেছে তা বন্ধ না করতে পারায় ফেসবুক ক্ষমাও চেয়েছে। ইতোমধ্যে জানা গেছে, ফেসবুকে সংরক্ষিত প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশীর তথ্যও বেহাত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবচেয়ে জরুরী হলো আমার-আপনার ব্যক্তিগত তথ্য অযাচিত প্রকাশের ফলে তা কেমন করে আমাদের ক্ষতি করতে পারে আমরা বুঝতে পারছি কি-না। যেমন ধরুন, আপনি ডাক্তারের কাছে গেলেন ও নানা রকম পরীক্ষার পরে ডাক্তার জটিল কোন অসুখের কথা জানালেন। আপনি কি আপনার এই অসুখ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবেন? কেন দেবেন? আপনি হয়ত চাইছেন সবাই জানুক ও সহমর্মী হোক যে আপনি একটা জটিল অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু সম্ভাব্য ক্ষতি আঁচ করতে পারেননি বলে দেখা গেল আপনার অফিস আপনাকে আর পছন্দ করছে না, সহকর্মীদের কেউ কেউ আপনাকে এড়িয়ে চলছেন। আপনার মেয়ের বিয়ের সম্ভাব্য শ্বশুরবাড়ি হয়ত জানিয়ে দেবে তারা এই বিয়েতে রাজি নয়Ñ কারণ মেয়ের বাবার যে অসুখ তাতে মেয়েও কোনদিন আক্রান্ত হতে পারে। এ সবই কাল্পনিক কিন্তু এমন অনেক ঘটনা আমাদের দেশে ঘটেছে বা ঘটছে। সবচেয়ে বড় কথা বীমা কোম্পানি এসব তথ্য নিয়ে আপনার প্রতি বিরূপ আচরণ করতে পারে। এখানে নীতির দিক হলো আপনি আপনার অসুখ-বিসুখের কথা ডাক্তার ছাড়া কাউকে জানাবেন না। ডাক্তারও আপনার রোগের কথা আর কাউকে জানাবেন না, কারণ এটা আপনার অধিকারের বিষয়। আপনার শরীর ঘিরে যত কিছুই ঘটুক তা আপনার সম্পদ, ফেসবুকে জানিয়ে তাতে আপনি কোন জনসমর্থন আদায় করতে পারবেন নাÑ যাতে আপনার শরীরের অসুখের কোন উপশম হবে। যেমন ধরুন আমরা ন্যাশনাল আইডি কার্ডের জন্য আমাদের অনেক ব্যক্তিগত তথ্য দিয়েছি। এখন ভোটার তালিকার অপপ্রয়োগ করতে কেউ যদি এনআইডি ডেটাবেজ থেকে তথ্য চুরি করে আপনার মতের বিরুদ্ধে কাজ করে আপনি কি তা মেনে নেবেন? নিশ্চয়ই নয়। আমাদের সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক আছে, কিন্তু এই তথ্য-ভা-ার ব্যবহার আইনের দ্বারা সুরক্ষিত হতে হবে, না হলে আমাদের তথ্য নিয়ে যেন কেউ এমন কিছু না করে যা আমার মনের বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তা না হলে আমরা কিন্তু তখন আইনের আশ্রয় নিতে পারছি না। এই সুযোগ নিচ্ছে আমাদের দেশের মোবাইল ফোনের কোম্পানিগুলো। আমাদের সব তথ্য এরা নিয়ে নেয় কিন্তু কী কাজে এই তথ্য ব্যবহার করবে তাতে আমার-আপনার সম্মতি নেয় না। যে কারণে আপনি প্রচুর অযাচিত এসএমএস পেয়ে থাকেন, রাত-বিরেতে পেয়ে বিরক্তও হন, কিন্তু কোন ব্যবস্থা নিতে পারেন না। আপনার মোবাইল ফোন নম্বর বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে বা খাবার দোকানির কাছে আপনার অনুমতি ছাড়া যাবে কেন? কিছুদিন আগে আমরা আঙ্গুলের ছাপ দিলাম সেটা সন্ত্রাস দমনে বেশ কার্যকরী হয়েছে, কিন্তু আমার-আপনার ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় কতখানি নিরাপদ একটি আইন করে তা আমাদের জানিয়ে দেয়া দরকার। যারা নিয়মিত গুগল ব্যবহার করেন তাঁরা জানেন বা না জানলেও জানা দরকার আপনার সকল ব্যক্তিগত তথ্য, কখন কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন, আপনার কাছে কার কার নাম্বার আছে সব সব কিন্তু গুগোল আপনার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছে। কেউ যদি তার মোবাইলের ম্যাপে গিয়ে টাইমলাইন দেখেন দেখবেন আপনার দিনের সকল গতিবিধি, এমন কি কত পা হেঁটেছেন সব তথ্য ওই ম্যাপে উল্লেখ করা আছে। প্রশ্ন হলো গুগল এটা ঠিক করছে কি না। যেহেতু দৃশ্যমান তথ্যগুলো সম্পর্কে আমরা সব জানতে পারছি আমাদের জানা দরকার অদৃশ্য কোন তথ্য-ভা-ার সে আমার কাছ থেকে সব জেনে নিয়ে তৈরি করে নিচ্ছে কি-না, যা কোন এক সময় আমার জন্যে ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন আমি ব্যাংকে কত টাকা আজ জমা করলাম বা উত্তোলন করলাম সে তথ্য মোবাইলে ফোনের কোন সফটওয়ার জেনে নিচ্ছে কী না যা অন্যের কাছে প্রকাশ হলে আমার নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। বা আমি এখন কোথায় আছি (অনেকে ফেসবুকে না বুঝেই নিজের লোকেশন জানিয়ে স্ট্যাটাস দেন যার ক্ষতি নিয়ে নানা দেশে প্রতিকারমূলক আইন হয়েছে) তা জেনে আমার ক্ষতি করতে যায় এমন কেউ সে তথ্য ব্যবহার করবে কী না। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে কোন তথ্যই আর গোপন রাখার সুযোগ নেই, কিন্তু তার অপপ্রয়োগ যেন আপনার-আমার ক্ষতির কারণ না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আজকাল কোন কোন টেলিভিশনে গ্রামের মানুষের, বিশেষ করে মেয়েদের অসুখ বা শারীরিক সমস্যা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে দেখা যায় এটা বহুজনের জন্যে উপকারী হলেও যিনি তাঁর সমস্যার কথা বলছেন তাঁকে ক্যামেরার সামনে বিনা অনুমতিতে আনাও ঠিক নয়, এতে তাঁর ব্যক্তিগত সম্মানের অধিকার ক্ষুণœ হচ্ছে। আমি নিশ্চিত শহরের কোন শিক্ষিত মেয়েকে এভাবে ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসা কখনই সম্ভব হবে না। কিন্তু একজন গ্রামীণ নারীরও তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য সমাধানের যেমন অধিকার আছে তেমনই তার মুখ আড়াল করার অধিকারও আছে। দেশে-বিদেশে নানা রকম তথ্য-প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। এক দিকে এই প্রযুক্তির সীমাহীন সম্ভাবনা, অপরদিকে এর ক্ষতিকর দিকগুলো আমাদের বিব্রত করছে। আমাদের দেশের ইন্টারনেট নিরাপত্তা নিয়ে উন্নত দেশগুলো সন্তুষ্ট নয় ফলে এদিকে মনোযোগ দেয়া দরকার। বাড়াতে হবে আমাদের জন-সচেতনতা, বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের সম্পূরক একটি ‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন’ও আমাদের তৈরি করে নেয়া দরকার। বিদেশী আইটি কোম্পানিগুলো আমাদের দেশে এসে যেন আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিব্রতকর কোন পরিস্থিতি তৈরি না করে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এমন কি এই আইনের ফলে প্রতিশ্রুত বা নিবন্ধিত থাকলে আমাদের দেশে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হবে যাতে তারা আমাদের দেশের তথ্য পাচার করতে না পারে, এমনকি তাদের ব্যবসায় কর আরোপ করাও সহজ হবে যেটি না থাকায় আমরা ফেসবুক বা গুগলের কাছ থেকে এখন কর নিতে পারছি না। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প
×