ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিজেএমসির সেই উপদেষ্টাদের নিয়ে আবার পাঁয়তারা

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ৭ এপ্রিল ২০১৮

বিজেএমসির সেই উপদেষ্টাদের নিয়ে আবার পাঁয়তারা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনে (বিজেএমসি) আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া সেই বিতর্কিত উপদেষ্টাদের এবার একই পথে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে পরিচালক পদে বসানোর পাঁয়তারা শুরু হয়েছে! পিআরএলে থাকা অবস্থায় উপদেষ্টা হওয়ার ঘটনা নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে ঠিক তখনই তিন কর্মকর্তার মধ্যে একেএম নাজমুজ্জামান (অতিরিক্ত সচিব), সিরাজুল ইসলামকে (যুগ্ম সচিব) পরিচালক পদে দু‘বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফাইল তোলা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে অনুমোদনের জন্য ফাইল পাঠানো হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি আদায়ে বিতর্কিত সকল তথ্য এড়িয়ে দু’কর্মকর্তার গুণগান গেয়ে বলা হয়েছে ‘তাদের সততা, সুনাম ও দক্ষতার জন্য বিজেএমসিতে তাদের অত্যন্ত প্রয়োজন’। এদিকে বিজেএমসি যাদের কারণে বিতর্কের মুখে সেই কর্মকর্তাদেরই দফায় দফায় বেআইনীভাবে পুরস্কৃত করার ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দেশজুড়ে পাট ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে এসব কর্মকর্তার অনিয়মের প্রতিবাদ করলেও পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং বিজেএমসির একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আশীর্বাদেই এমন ঘটনা বলে বলছেন ব্যবসায়ীরা। পাট ব্যবসায়ী ছাড়াও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নতুন উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, যেখানে অবৈধভাবে উপদেষ্টা হওয়া কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাবাবদ উত্তোলন করা অর্থের হিসেব চেয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেখানে নতুন করে পরিচালক করার চেষ্টা বড় ধরনের দুর্নীতি। এ ঘটনার পেছনে কারা আছেন তাদের খুঁজে বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা। বিজেএমসির অনেক কর্মকর্তারও ঘটনা সম্পর্কে সরকারের শীর্ষ মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। জানা গেছে, আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে পাটকল কর্পোরেশনে (বিজেএমসি) নিয়োগ পাওয়া উপদেষ্টাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাবাবদ উত্তোলন করা অর্থের হিসাব ইতোমধ্যেই চেয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিজেএমসির এ তিন উপদেষ্টার পেছনে ব্যয় করা সরকারী সুবিধার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করে জানানোর জন্য পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দিয়েছে জনপ্রশাসন। সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আপত্তির প্রেক্ষাপটেই কঠোর এ নির্দেশনা দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে বলা হয়েছে, পিআরএল ভোগরত কর্মকর্তাগণ বিজেএমসির পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা পদে কর্মরত থেকে এ পর্যন্ত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি খাতে কত টাকা উত্তোলন করেছেন তার প্রকৃত আর্থিক মূল্য এ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। বস্ত্র ও পাঠ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। যে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সকল আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনে (বিজেএমসি) নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিন উপদেষ্টা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পিআরএলে থাকা অবস্থায় তিন কর্মকর্তার পাটকল কর্পোরেশনের উপদেষ্টা নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মন্ত্রণালয় ও বিজেএমসির যোগসাজশে সকল আইন লঙ্ঘন করে কিভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে উপদেষ্টা। ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে পিআরএলে থাকা অবস্থার একেএম নাজমুজ্জামান (অতিরিক্ত সচিব), সিরাজুল ইসলাম (যুগ্ম সচিব), বাবুল চন্দ্র রায় (যুগ্ম সচিব) দুটি সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে একই সঙ্গে বেতন গ্রহণসহ নানাবিধ অনিয়মের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন- এ শিরোনামে বলা হয়েছে, প্রশাসন ক্যাডারের এ তিন কর্মকর্তা দুই বছর বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বলা হয়েছে, এ তিন কর্মকর্তাকে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেয়া হয় এবং প্রত্যেক উপদেষ্টাকে মাসিক ৮০ হাজার টাকা সম্মানী দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উপদেষ্টারা পরিচালকের কক্ষে বসেই পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিবেদনে নিয়োগকে সম্পূর্ণ অবৈধ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের অর্গানোগ্রামে উপদেষ্টার কোন পদ নেই এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক এ পদ অনুমোদিতও নয়। প্রতিবেদনে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ তাদের নিয়োগ দাতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া তাদের সম্পদের তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কাজে লাগানোর সুপারিশও আছে। বলা হয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাতিল করে গ্রহণ করা সমুদয় অর্থ ফেরত নেয়াসহ তাদের বিরুদ্ধে এবং নিয়োগ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা যেতে পারে। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদের বিষয়ে দুদকের মাধ্যমে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা যেতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তিন কর্মকর্তার রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, তিনজনই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাজনক পদে পদায়ন পেয়েছেন। একেএম নাজমুজ্জামান পাট ক্রয়ের সময় নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। তিন কর্মকর্তার অনিয়মের ঘটনায় একের পর এক গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকেই তোলপাড় চলছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এমনকি পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী ইয়াজ উদ্দিন প্রামানিকও ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পাট ব্যবসায়ীরাও মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। অথচ যাদের কারণে পুরো বিজেএমসি জড়িয়ে পড়েছে বিতর্কে সেই কর্মকর্তাদেরই এবার পুরস্কৃত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে একটি বিশেষ গ্রুপ। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টার মেয়াদ শেষে দুজনকে উপদেষ্টা পদে বসাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফাইল পাঠনো হচ্ছে। বিজেএমসি দুজনের প্রশংসার ফিরিস্তি লিখে ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। যাকে মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তাই বলছেন ‘ প্রশংসাপত্র’। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো জন্য লেখা আবেদনপত্রের শীর্ষে লেখা হয়েছে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য’। মোঃ সিরাজুল ইসলামের জন্য লেখা আবেদনে যেখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সকল অনিয়ম ও চলমান কেলেঙ্কারি। বরং বলা হয়েছে, ‘সততা, সুনাম ও দক্ষতার জন্য তিনি এখানে সমাদৃত। বিজেএমসির স্বার্থে তাঁকে দুই বছরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হলে তা বিজেএমসিকে আরও অগ্রসর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিজেএমসির বর্তমান পরিস্থিতিতে তার মতো একজন অভিজ্ঞ ও কর্মদক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি অত্যন্ত প্রয়োজন। এ পর্যায়ের ১ জন কর্মকর্তার জন্য বেতন-ভাতা, সরকারী গাড়ি, ড্রাইভার, গাড়ির জ্বালানি এবং রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদিতে প্রতি মাসে প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা সম্মানী প্রদান করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে আবেদনে। একে নাজমুজ্জামানকে নিয়োগ দিতেও একই কৌশল নেয়া হয়েছে। দুজনের চিঠিতেই মাননীয় প্রতিমন্ত্রীকে অবগত করার বিষয়টি উল্লেখ করেছে বিজেএমসি। একে নাজমুজ্জামানের জন্য লেখা আবেদনে বলা হয়েছে, বিজেএমসির স্বার্থে তার সঙ্গে আরও দুই বছরের জন্য চুক্তি করা হলে তা বিজেএমসিকে আরও অগ্রসর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া পাট খাতের উন্নয়নে তার মতো একজন অভিজ্ঞ ও কর্মদক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি অত্যন্ত প্রয়োজন। জানা গেছে, বিশেষ মহলটি পরিকল্পনা অনুযায়ীই নির্বাহী ক্ষমতাসহ পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। আইন অনুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রক্রিয়া করা হলে গত দেড় বছরের সংঘটিত আইন বহির্ভূত সকল কর্মকা- জবাবদিহিতার আওতায় পড়বে এমন আশঙ্কা থেকেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোন অনুমোদনও নেয়া হয়নি। মহলটি ধারণা করছে, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় আগের ঘটনা সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত নয়, তাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে কিছু প্রশংসা সূচক বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলেই অনুমোদন পাওয়া যাবে। বিধান অনুসারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর সার-সংক্ষেপ প্রেরণ করা হবে কি হবে না তা একান্তভাবে মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারাধীন বিষয়। অথচ তার অধীনস্ত দফতর সার-সংক্ষেপ প্রণয়ন করেছে যা বিরল ঘটনা। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, সরকারী ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কোন সরকারী সংস্থায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের উদ্যোগে কেন বারবার বিধি ভঙ্গ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কেন তাদের অনুমোদন নেয়া হচ্ছে না? কেন অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না? কি কারণে গণকর্মচারী অবসর আইন ১৯৭৪ কে আমলে আনা হচ্ছে না? অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পিআরএলভুক্ত বা পিআরএল কিংবা পিআরএল শেষে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অন্য কোন চুক্তিভিক্তিক সরকারী চাকরির জন্য আবেদন করার ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে এই বিধিও লঙ্ঘন করে ফায়দা হাসিলের আয়োজন চলছে।
×