ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফুটবলের উন্নয়নে কক্সবাজার-ময়মনসিংহের ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৪:২২, ৭ এপ্রিল ২০১৮

ফুটবলের উন্নয়নে  কক্সবাজার-ময়মনসিংহের ভূমিকা

রুমেল খান ॥ সোনালী অতীত বা গৌরবোজ্জ্বল বর্তমান নিয়ে পড়ে থাকলেই হবে না। সাফল্যময় অতীত-বর্তমানের পুনরাবৃত্তি করতে হবে ভবিষ্যতেও। এর জন্য চাই সদিচ্ছা, সঠিক পরিকল্পনা, অর্থ, দক্ষ লোকবল, অনুশীলন, প্রশিক্ষণসহ আরও অনেক কিছুই। সত্তর ও আশি দশকে এদেশের ফুটবলের ছিল স্বর্ণযুগ। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকেই ফুটবলের জনপ্রিয়তা ও মানের অবনতি হতে শুরু করে নানা কারণে। আগের মতো মানসম্পন্ন এবং জনপ্রিয় ফুটবলার এখন নেই বললেই চলে। এর সবই অবশ্য পুরুষ ফুটবলে। মহিলা ফুটবলের বেলায় বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টোই। যেখানে পুরুষদের ফুটবল প্রায় রসাতলে, সেখানে এখন নারীদের ফুটবল দারুণ চলে। যদিও মহিলা ফুটবলের বয়স মাত্র এক যুগেরও সামান্য সময় বেশি। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও সার্থক বাস্তবায়নে প্রতিনিয়ত তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েদের ফুটবল। গত চার বছরে তিনটি বয়সভিত্তিক ফুটবল আসরে জাতীয় মহিলা ফুটবলাররা জিতেছে পাঁচটি শিরোপা। মেয়েদের দলের অধিকাংশ ফুটবলারই এসেছে বঙ্গমাতা ফুটবল এবং প্ল্যান বয়সভিত্তিক ফুটবল থেকে। প্রশ্ন উঠেছে, মেয়েদের ক্ষেত্রে এমনটা হলে কেন হচ্ছে না ছেলেদের বেলায়? কারণ মেয়েদের বঙ্গমাতা ফুটবল আসরের এক বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছিল ছেলেদের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ স্কুল ফুটবলের আসর (২০১০ সাল থেকে)। এই দুটি আসর হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল টুর্নামেন্ট। কিছুদিনের মধ্যেই বিষয়টি গিনেস বুক অব রেকর্ডসে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। বাংলাদেশ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ই সেক্ষেত্রে এটার কৃতিত্ব পাবে। কেননা টুর্নামেন্ট দুটি তারাই আয়োজন করছে প্রতিবছর। বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের কৃষ্ণা রানী সরকার, মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, তহুরা খাতুন, মারজিয়া, শামসুন্নাহার, সানজিদা আক্তার, আনুচিং মগিনি... এরা মূলত বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের ফসল। তাদেরই পরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) বাছাই করে আলাদা ক্যাম্প করে নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়ে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি শেষ হলো বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের অষ্টম এবং বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের সপ্তম আসর। বাফুফে ঘোষণা দিয়েছে এই আসরে মেধাবী ফুটবলারদের তারা চিহ্নিত করেছে। অচিরেই তাদের ক্যাম্পে ডাকা হবে। কোন সন্দেহ নেই বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট বাংলাদেশে ক্ষুদে ফুটবলার তৈরির ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। শুধু রাজধানী নয়, জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়েও এই টুর্নামেন্ট এখন আলোচনার শীর্ষে। দেশের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদে খেলোয়াড়দের ফুটবল শৈলীতে একদিকে যেমন সবাই আমোদিত হচ্ছে তেমনি এর মাধ্যমে আগামীদিনের প্রতিভাবান ফুটবলার তৈরি হচ্ছে। শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক বিকাশ শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে। আর শিশুর সুস্থ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে খেলাধুলা। এছাড়া খেলাধুলা শিশুদের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দায়িত্ববোধ তৈরি করে। এই উপলব্ধি থেকেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১০ সাল থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট’ এবং ২০১১ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদাত্রী সহধর্মিণীর নামে ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট’ প্রবর্তন করেছে। এবার টুর্নামেন্ট দুটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নতুন দুটি স্কুল। গত ২৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বালক বিভাগের চ্যাম্পিয়ন হয় কক্সবাজারের পেকুয়ার পূর্ব উজানটিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ফাইনালে তারা ২-১ গোলে পাবনার সাঁথিয়ার ভুলবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে হারায়। বালিকা বিভাগে শিরোপা জেতে ঝিনাইদহের শৈলকুপার দোহারো সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ফাইনালে তারা টাইব্রেকারে ৫-৪ গোলে হারায় ময়মনসিংহের নান্দাইলের পাঁচরুখী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়। উল্লেখ্য, সারাদেশ থেকে এবার ছেলে ও মেয়েদের যথাক্রমে ৬৪,৬৮৮ এবং ৬৪,৬৮৩ স্কুল অংশ নেয় এই টুর্নামেন্টে। অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ছিল বালক বিভাগে ১০ লাখ ৯৯ হাজার ৬৯৬ এবং বালিকা বিভাগে ১০ লাখ ৯৯ হাজার ৬১১। গত ১৯-২৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে সাত বিভাগের টুর্নামেন্ট দুটি বিভাগীয় পর্যায়ের ১৪ চ্যাম্পিয়ন দল নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই আসরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑ ঢাকার বাইরের অঞ্চলের স্কুলগুলোর আধিপত্য। ছেলেদের বিভাগে আগে আলোকপাত করা যাক। সবচেয়ে বেশি তিনবার শিরোপা জিতেছে কক্সবাজারের স্কুলগুলো। এরপর দুটি করে সিলেট এবং নীলফামারীর দুটি স্কুল। কক্সবাজারেরগুলো হলো : ২০১৫ সালে পেকুয়ার রাজাখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২০১৬ সালে পেকুয়ার টৈটং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১৭ সালে পূর্ব উজানটিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সিলেটেরগুলো হলো : ২০১০ সালে জৈন্তাপুরের নিশ্চিন্তপুর রেজিঃ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১৪ সালে জৈন্তাপুরের করগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর নীলফামারীরগুলো হলো : ২০১২ সালে সদরের দক্ষিণ দোনদারি কেরানিপাড়া রেজিঃ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১৩ সালে সদরের বেড়াডাঙা সোটাপীর যাদুরহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বরিশালের স্কুল, ২০১১ সালে সদরের চরবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। কক্সবাজারের স্কুলগুলো শুধু সবচেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়নই হয়নি, সবচেয়ে বেশি দু’বার রানার্সআপও হয়েছে। ২০১২ সালে মহেশখালীর মেহেরিয়াপাড়া রেজিঃ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১৪ সালে পেকুয়ার ফৈজুন্নেছা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। তারমানে এই অঞ্চলের স্কুলগুলো পাঁচবার ফাইনাল খেলে তিনবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এছাড়া ১ বার করে যারা রানার্সআপ হয়েছে, তারা হলো : ২০১০ সলে ইসদাইর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সদর, নারায়ণগঞ্জ, ২০১১ সালে রাঙামাটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ২০১৩ সালে উত্তর কড়াপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সদর বরিশাল, ২০১৫ সালে মরিচা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বীরগঞ্জ, দিনাজপুর, ২০১৬ সালে কামরাঙ্গী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, জৈন্তাপুর, সিলেট এবং ২০১৭ সালে ভুলবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাঁথিয়া, পাবনা। ছেলেদের বিভাগে যেমন কক্সবাজার, তেমনি মেয়েদের বিভাগে ময়মনসিংহ। সবচেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ধোবাউড়ার কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। তারা টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব দেখায় (২০১৩, ২০১৪, ২০১৫), যেটা ছেলেদের বিভাগে কক্সবাজারের পেকুয়ার কোন স্কুলই পারেনি। এছাড়া ১ বার করে চ্যাম্পিয়ন হয় ২০১১ সালে রাঙমাটির কাউখালীর মঘাছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২০১২ সালে রংপুর সদরের পালিচড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২০১৬ সালে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের টেপুরগাড়ী বি, কে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১৭ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপার দোহারো সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সবচেয়ে বেশি দু’বার করে রানার্সআপ হয়েছে রংপুর ও রাজশাহীর স্কুলগুলো। রংপুরের স্কুলগুলো হচ্ছে : ২০১১ সালে সদরের পালিচড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২০১৪ সালে সদরের ১নং পালিচড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাজশাহীর স্কুলগুলো হলো : ২০১৫ সালে বাগমারার খর্দকৌড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১৬ সালে চারঘাটের বড়বাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১ বার করে রানার্সআপ হয় ২০১২ সালে সিলেটের জৈন্তাপুরের নিশ্চিন্তপুর রেজিঃ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২০১৩ সালে রাঙামাটির কাউখালীর মঘাছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২০১৭ সালে ময়মনসিংহের নান্দাইলের পাঁচরুখী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সবচেয়ে বেশি ফাইনাল খেলে ময়মনসিংহের ২টি স্কুল, চারবার করে। তবে কলসিন্দুর স্কুল হ্যাটট্রিক করে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও বর্তমানে স্কুলটিতে নোংরা রাজনীতি ঢুকে যাওয়ার কারণে আগের মতো স্কুলটি আর সাফল্য পাচ্ছে না। এখন দেখার বিষয় আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের পুরুষ ও মহিলা ফুটবলার তৈরিতে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে কক্সবাজার এবং ময়মনসিংহের স্কুলগুলো।
×