ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রিক্সার চাকায় ঘুরছে কবিরের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৭ এপ্রিল ২০১৮

রিক্সার চাকায় ঘুরছে কবিরের স্বপ্ন

সন্তানদের বিসিএস ক্যাডার বানাতে দিনরাত রিক্সার প্যাডেল ঘুরিয়ে হারভাঙ্গা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন শেখ মোঃ কবির (৫০)। কাঠফাঁটা রোদ কিংবা ঝড়ো বৃষ্টি কোন কিছুতেই বিশ্রামের সুযোগ নেই তার। রিক্সার চাকা না ঘুরলে সংসারের চাকা ঘোরে না কবিরের। একদিন রিক্সা না চালালে অর্ধাহারে অনাহারে কাটে তার পরিবারের সদস্যদের। অদম্য ইচ্ছার জোরেই বিগত ৩৪ বছর ধরে রিক্সা চালিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন ইট-পাথরের বরিশাল নগরীতে। স্বপ্ন তার একটাই ছেলে ও মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার। ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একদিন বিসিএস ক্যাডার হবে এটাই তার জীবনের শেষ ইচ্ছা। রিক্সা চালিয়ে দুই পুত্র, এক কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার চালাচ্ছেন শেখ মোঃ কবির। তার (কবির) আদি বাড়ি পিরোজপুর জেলা সদরের সিআই পাড়ায়। তার বাবা ওই এলাকার বাসিন্দা মৃত শেখ মোঃ নূর মোহাম্মদ। অভাব অনটনের কারণে দেশ স্বাধীনের আগে কাজের সন্ধানে বাবা শেখ নূর মোহাম্মদ পুত্র শেখ মোঃ কবির, শেখ মোঃ কামাল ও স্ত্রী রাশিদা বেগমকে নিয়ে বরিশাল নগরীতে আসেন। জীবিকার তাগিদে নূর মোহাম্মদ দিনমজুরের কাজ শুরু করেন। কখনও কাজ না পেলে নগরী ঘুরে চকলেট, চানাচুর ফেরি করে বিক্রি করতেন। দুই ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো তো দূরের কথা প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে নূর মোহাম্মদকে। বাবার কষ্ট দেখে শৈশবেই নিজেও দিনমজুরের কাজে নেমে পড়েন শেখ কবির। উপার্জনের অর্থ তুলে দেন বাবার হাতে। শৈশব পেরিয়ে কিশোর বয়সেই রিক্সার প্যাডেলে পা রাখতে হয় শেখ মোঃ কবিরকে। সেই থেকে তিনি অবিরাম ৩৪ বছর ধরে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছেন। সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আসার পর শেখ কবির ১৯৯১ সালে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন। সংসারে নতুন সদস্য আসায় খরচ বেড়ে যায় কবিরের। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে কবির যা রোজগার করেন তা দিয়েই কোন মতে তাদের সংসার চলে। বিয়ের দুই বছর পর তার কন্যা সন্তান ফাতেমা আক্তারের জন্ম হয়। এর কয়েক বছর পর একে একে দুই ছেলের জন্ম হয়। অভাব থাকলেও সব মিলিয়ে ভালোই চলছিল কবিরের সংসার। কিন্তু হঠাৎ করে ফের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ২০১৬ সালে এক দুর্ঘটনায় শেখ কবিরের ডান পা ভেঙে যায়। দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে ডান পায়ে বড় ধরনের অস্ত্রোপাচার করা হয়। ওইসময় ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে অর্থের অভাবে থমকে যায় কবিরের সু-চিকিৎসা। ফলে ভাঙা পা আর ভাল হয়নি। এরপরের সংগ্রাম তার অনেক করুণ। কিভাবে দিন যাবে। ভাঙা পা নিয়ে রিক্সা চালানো সম্ভব নয়। তাই অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটে তার পরিবারের সদস্যদের। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের দু’মুঠো খাবার জোগাড়ে রাস্তার পাশে চায়ের দোকান দিয়ে বসেন কবির। থাকতেন সরকারী জমিতে ছাপড়া তুলে। সরকারী জমি হওয়ায় একবছরের মাথায় ছাপড়া ঘর ও ছোট্ট চায়ের দোকানটিও উচ্ছেদ করা হয়। তখন স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কবির আশ্রয় নেন জেল বাগানের গাছ তলায়। এরপর শুরু হয় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। কিছুদিন বেকার থাকার পর ধারদেনা করে ব্যাটারিচালিত একটি রিক্সা ক্রয় করেন কবির। অদম্য ইচ্ছার জোরে সেই রিক্সা চালিয়ে জীবনের চাকা ঘোরানোর চেষ্টা করে চলেছেন তিনি। শেখ মোঃ কবির বলেন, ভাঙা পায়ের কারণে এখন আর বেশিক্ষণ রিক্সা চালাতে পারি না। প্রতিদিন রিক্সা চালিয়ে তিন থেকে চারশ’ টাকা আয় হয়। তা দিয়েই সংসারটা কোন রকমে চলছে। তার (কবির) বড় মেয়ে ফাতেমা আক্তার নগরীর মানিক মিয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। দুই পুত্র বাপ্পী ও মোবারক নগরীর মথুরনাথ স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। শেখ মোঃ কবির আরও বলেন, জীবনের শেষ ইচ্ছা ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একদিন বিসিএস ক্যাডার হবে। জানি না এ স্বপ্ন কতদিন চালিয়ে যেতে পারব। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে এখনই হিমশিম খেতে হয়। শেখ মোঃ কবিরের আদি বাড়ি পিরোজপুর জেলা সদরের সিআই পাড়ায় ১৪ কাঠা জমি পরেছিল তার (কবির) বাবার ভাগে। তবে কবিরের বাবার মৃত্যুর পর পুরো সম্পত্তি চাচাতো ভাইয়েরা দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে বরিশাল নগরীর ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউনিয়া খান বাড়ি এলাকার একটি ঘরে দুই পুত্র, এক কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে শেখ কবির ভাড়া থাকেন। -খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে
×