ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অশান্ত জনপদে শান্তির সুবাতাস

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৭ এপ্রিল ২০১৮

অশান্ত জনপদে শান্তির সুবাতাস

রাজশাহী জেলার একটি উপজেলার নাম বাগমারা। বিভাগীয় শহর থেকে এর দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার। দেশের প্রত্যন্ত উপজেলা হলেও ‘বাগমারা’ নামটির সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে। এক সময়ের রক্তাক্ত সেই জনপদে এখন ফিরে এসেছে শান্তির সুবাতাস। সব চিত্রই পাল্টে গেছে সময়ের ব্যবধানে। যোগাযোগ, শিক্ষা-দিক্ষা থেকে শুরু করে অবকাঠামো উন্নয়ন, সংস্কৃতি থেকে ক্রীড়া সব সেক্টরেই লেগেছে উন্নয়নের ছাপ। যে উপজেলার নাম শুনলে এক সময় শিউরে উঠতো মানুষের প্রাণ, সেই বাগমারার গ্রামে গ্রামে লেগেছে উন্নয়নের আলোকছটা। একদিকে বিচ্ছিন্ন জনপদ, অন্যদিকে সন্ত্রাসী, জঙ্গীগোষ্ঠীর অপতৎপরতা কিংবা লাল পতাকাবাহিনীর (চরমপন্থীর) দৌরাত্ম্যে যেখানে স্কুল কলেজে যেতে পারত না শিক্ষার্থী, সেখানে এখন দলবেঁধে শিক্ষার্থীদের স্কুল যাত্রার চিত্র চোখে পড়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ার চিকিৎসাসেবা পাওয়া যেখানে ছিল প্রায় অসম্ভব, সেখানে এখন ঘরের দোরগোড়ায় উন্নত চিকিৎসাসেবা। ১০ বছর আগেও যেখানে ঘরে ঘরে শিশুদের ঘুম পাড়ানো হতো বাংলা ভাইয়ের ভয় দেখিয়ে সেখানে এখন দিন বদলের ছোঁয়া। কয়েক বছর আগেও রক্তাক্ত এ জনপদে হিংসা, খুন, জখম, হত্যা ছিল প্রতিদিনের প্রকাশ্য ঘটনা। এখানে বাংলা ভাইদের উত্থান, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, লাল পতাকা বাহিনীর নৃশংসতা আর বিভীষিকাময় জীবনের গল্প ছিল প্রতিদিনের জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম। কিন্তু এখন সময়ের ব্যবধানে বাগমারাবাসী তাদের বিভীষিকাময়, রাতের ঘুম হারাম করা অতীত ভুলতে বসেছে। বাগমারার মানুষ এখন শান্তিতে বাস করছে। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের চিত্রে পাল্টে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। সহজ যোগাযোগ না থাকায় প্রথম থেকেই বাগমারার জনপদ ছিল এক আতঙ্কের নাম। ২০০৪ সালে এখানেই উত্থান হয় বাংলা ভাইয়ের। তারপর শুরু হয় হিংসা, খুন, জখম, হত্যা। বাড়ি থেকে মানুষ ধরে এনে চালানো হতো কথিত চর্চার সেলে অমানুষিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের আর্তনাদ গ্রামবাসীকে আতঙ্কিত করার জন্য শোনানো হতো মাইকে। সাধারণ মানুষও বাগমারার নাম শুনলে এমনিকেই অজানা আতঙ্কে আতকে উঠতেন। তবে সময়ের ব্যবধানে বদলে গেছে এ উপজেলার দৃশ্যপট। বর্তমান সরকারের অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বদলে যেতে থাকে বাগমারার দৃশ্যপটও। সারা বছর বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রম চলে এখন এখানে। এরই মধ্যে গ্রাম থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে পাকা সড়ক। প্রতিষ্ঠা হয়েছে অসংখ্য স্কুল-কলেজ মাদ্রাসা মক্তব। বিদ্যুতের আলোর ছোয়া সর্বত্র। বিপথগামী তরুণরা মাদক এবং সন্ত্রাস ত্যাগ করে ব্যবসা ও কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেছে। স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সতর্ক এবং দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো বাগমারা এলাকা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়েছে। রক্তাক্ত জনপদ আজ পরিণত হয়েছে শান্তির বাগমারায়। তাই বাগমারাকে ঘিরে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিগণের মধ্যে আগ্রহের শেষ নেই। বাগমারায় এখন শিক্ষায় বিপ্লব চলছে, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রীড়া উন্মাদনা। রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ সারাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বাগমারা উপজেলার সবচেয়ে বেশি ছাত্রÑছাত্রী ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে। এসবই ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ বাগমারার উদাহরণ। বাগমারা কুখ্যাতি থেকে সুখ্যাতি অর্জন এর নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় সাংসদ প্রকৌশলী এনামুল হক। সরকারী সহায়তা আর ব্যক্তিগত উদ্যোগ সব মিলিয়ে উপজেলাকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। বাবা-মায়ের নামে গড়ে তোলা সালেহা ইমারত ফাউন্ডেশন এ উপজেলা বদলে দেয়ার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সম্প্রতি কথা হয় সংসদ সদস্য এনামুলের সঙ্গে। তিনিই শোনালেন গ্রাম বদলের নেপথ্যের নানা কাহিনী। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনে জয়ি হওয়ার পর থেকেই তিনি নেমে পড়েন বাগমারার কুখ্যাতি বদলের অভিযাত্রায়। ১৬টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে বাগমারার বিশাল এলাকা। এখানে লোকসংখ্যা চার লক্ষাধিক। ২০০৮ সালের পূর্বে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে কোন পাকা রাস্তা ছিল না। বর্তমান সরকারের আমলে এসে গত ৯ বছরে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাগমারায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০৮ সালের পর থেকে উপজেলায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণ ও ১৫৫ কিলোমিটার রাস্তার সংস্কার করা হয়। এছাড়া ২৯০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরে ১৩১ কিলোমিটার সম্পূর্ণ নতুন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। অধিকন্তু, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সংযোগ সাধনে ১৬ টি ব্রিজ ও ৩৮ কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের ফলে উপজেলা সদরের সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে পারছে লোকজন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্রিজ ও কালভার্ট না থাকায় লোকজনকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে উপজেলা সদরে আসতে হতো। এতে করে চরম ভোগান্তি পোহাতে হতো লোকজনকে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের প্রচেষ্টায় লোকজনের সেই ভোগান্তি দূর করেছেন বর্তমান সরকার। উপজেলার কাচারীকোয়ালী পাড়া ইউনিয়নের পীরগঞ্জ বাজারের পাশে নদীর উপরে নবনির্মিত ব্রিজের কারণে ৬টি ইউনিয়নের হাজার হাজার লোকজনের যাতায়াতের যে কষ্ট হতো তা দূর হয়েছে। এছাড়া উপজেলার তালতলী, জোলাপাড়া, হাটমাধনগর, হুলিখালীসহ বেশ কয়েকটি নদীর উপরে নতুনভাবে নির্মিত ব্রিজ উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। বাগমারায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন প্রকার কাঁচামাল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী অল্প খরচে পরিবহন করতে পারছে লোকজন। শুধু রাস্তা-ঘাটের উন্নয়নই শেষ নয়। বর্তমান সরকারের আমলে এসে শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে চারটি বহুতল ভবন নির্মাণের পাশাপাশি উপজেলার আটটি কলেজ, ৩২ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ছয়টি মাদ্রাসার ভবন নির্মাণসহ ৪৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়াও উপজেলা শিক্ষা অফিস, সার্ভার স্টেশন, ডাক বাংলো, ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, দুটি অত্যাধুনিক পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করা হয়। এছাড়া উপজেলা পরিষদে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশাসনিক ভবন ও অডিটরিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। যা বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন পরিষদের নতুন ভবন নির্মাণসহ হাট-বাজারের উন্নয়নে ১৩টি হাটে শেড নির্মাণ করা হয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, এনামুল হক ছিলেন ঢাকার ব্যবসায়ী। ২০০১ সালের দিকে বাগমারা উপজেলা আস্তে আস্তে অশান্ত হতে থাকে। এ সময় বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি কিছু সংখ্যক বিপথগামী দল ও লোকের হাতে হত্যার শিকার হন। ধীরে ধীরে বাংলা ভাই এবং সর্বহারাগোষ্ঠীর আত্ম-প্রকাশ ঘটে। হত্যা, খুন, রাহাজানি, মাদক প্রভৃতির মাধ্যমে বাগমারা রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়। এমন দুর্দশায় ঢাকায় স্থির থাকতে পারেননি এনামুল। তিনি বাগমারার মানুষকে নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন, ফিরে আসেন গ্রামে। কিভাবে বাগমারার মানুষকে মুক্ত করা যায়, এর উপায় নিয়ে ভাবতে থাকেন। তিনি লক্ষ্য করেন, বাগমারায় সর্বাধিক সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা সংখ্যায় প্রচুর হলেও অধিকাংশই তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করে না কিংবা করতে পারে না। হতাশা গ্রাস করে ফেলে অল্পশিক্ষিত তরুণদের। তারা হাত বাড়ায় সর্বনাশা মাদকের দিকে, অগ্রসর হয় বিপথগামীতার দিকে। আবার, শিক্ষিত বেকারদের হতাশা ও অভাবের সুযোগ নিয়ে সমাজের নিষিদ্ধ ও বিপথগামী অংশ তাদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়। বাগমারাকে অশান্ত করার চক্রান্ত চলতে থাকে। তবে উন্নয়নে বদলে যাওয়া বাগমারায় সেই কুখ্যাতি এখন অতীত। সর্বত্র শান্তির ছোয়া লেগেছে এককালের রক্তাক্ত জনপদে। -মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে
×