ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

এ দীনতা ক্ষমা কর প্রভু

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৭ এপ্রিল ২০১৮

এ দীনতা ক্ষমা কর প্রভু

মনে হয় নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তারই একটি ডেমোনেস্ট্রশন হয়ে গেল গত ১ এপ্রিল চাঁদপুরে। প্রধানমন্ত্রী নৌকা প্রতীকে ভোট চাইলেন। জনতা দুই হাত তুলে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে সমর্থন জানালেন। জানাবেনই না কেন! এর আগেও ঢাকা, সিলেট, খুলনা, ঠাকুরগাঁও-এ জনসভা করে ভোট চেয়েছেন। এই তো ক’দিন আগে জানা গেল এবার আমাদের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬১০ মার্কিন ডলারে এবং জিডিপি ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতিও ৬%-এর নিচে। অন্যান্য প্রবৃদ্ধির তথ্য আগেও বহুবার উল্লেখ করেছি এবং ব্যাপক প্রচারও পেয়েছে। তাই এখানে আর উল্লেখ করলাম না। তবে দুটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ করবÑ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বাঙালীদের বিশ্ব পরিমন্ডলে এমন উচ্চতায় তুলে এনেছেন যে, এখন আমরা বুক চিতিয়ে বলতে পারি আমি বাঙালী, স্বাধীন সার্বভৌম উন্নয়নশীল বাংলাদেশের নাগরিক, ভাষা-সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে-মর্যাদায়, অর্থ-সম্পদে গর্বিত জাতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষণ বিগত ২৫০০ বছরের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না।’ শেখ হাসিনা আজ আমাদের মধ্যে এমন এক শক্তি সঞ্চারিত করে দিয়েছেন যে, আমরা বাঙালীরা কাউকে ভয় করি না। মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় বলতে হয়, ‘আমি কি ডরাই সখী ভিখারি রাঘবে...’। গত ১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার চাঁদপুর সফর ও স্থানীয় স্টেডিয়ামে জনসভা শেষে ওইদিন সন্ধ্যা থেকে অদ্যাবধি টেলিফোনের পর টেলিফোন ‘আমাকে কেন মঞ্চে দেখা গেল না, আমি কেন মঞ্চে উঠলাম না? আমাকে সিকিউরিটি পাস বা আমন্ত্রণপত্র দিয়েছিল কি-না?’ অনেকেই টেলিফোনে জানান তারা দুঃখ পেয়েছেন আমাকে মঞ্চে না দেখে। গ্রাম-গঞ্জে এখন ডিশ লাইন ও টিভির সিটিজেন মিডিয়ার ছড়াছড়ি। মনে হলো এরা আমাকে পছন্দ করেন। আমাকে কম পছন্দ করেন এমন লোকও টেলিফোন করেছেন। তারা করেছেন পরিহাসছলে। ‘রাজনীতি করতে হলে মঞ্চে উঠতে হয়, এই অপ্রিয় সত্যটি উপলব্ধি করলাম এবার নেত্রীর সভামঞ্চে না উঠে।’ মঞ্চে আমি উঠতে পারতাম। কেউ বাধা দিতে পারত না। কিন্তু ৬-৭ হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকের একটি বিরাট মিছিল নিয়ে বাগাদি চৌরাস্তা থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে যখন সভাস্থলে (স্টেডিয়াম) এলাম সে সময় চরম মিস ম্যানেজমেন্টের কারণে মিছিলের একেক অংশ একেক গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে বহুধাবিভক্ত হয়ে কেউ গ্যালারিতে, কেউ স্টেডিয়ামের মাঠে বিচ্ছিন্নভাবে বসে পড়ে। একটি বিরাট অংশ ঢুকতে না পেরে আউটার স্টেডিয়ামে বসে নেত্রীর বক্তৃতা শোনে। তখন আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম মঞ্চে না গিয়ে স্টেডিয়ামের মাঠে বসে বক্তৃতা শোনার। প্রখর রোদের মধ্যে এখানে আমার সঙ্গে সহস্রাধিক কর্মী বসা ছিল। কিন্তু প্রচলিত ধারণা হলো মাঠে কর্মী-সমর্থকদের মাঝে বসে বক্তৃতা শোনার মধ্যে আনন্দ আছে, তৃপ্তি আছে; কিন্তু তাতে করে দলের নেতত্ব নমিনেশন কোনটাই সুনিশ্চিত করে না। বিশেষ করে যদি ক্ষমতাসীন দলের হয়। এটি প্রধানমন্ত্রীর পূর্ব নির্ধারিত সফর। ১ এপ্রিল নেত্রী চাঁদপুর আসেন এবং অনেক প্রকল্প উদ্বোধন ও অনেকগুলোর ভিত্তি স্থাপন করেন। চাঁদপুরের একজন হিসেবে আমি ও আমরা আনন্দিত এবং কৃতজ্ঞ। চাঁদপুরকে পর্যটননগরী করার বা এখানে একটি মেডিক্যাল কলেজ করার ঘোষণা আমাদের আরও কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। আমরা তাঁর সুস্থ দীর্ঘজীবন কামনা করি। তবে চাঁদপুরের ডেমোনেস্ট্রেশনটি মিস ম্যানেজমেন্টের কারণে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মিছিলগুলো জনসভাস্থল স্টেডিয়ামের গেটে এলে আর সুশৃঙ্খল থাকতে পারেনি। সাধারণ শ্রোতা-দর্শকরা কে কোন্ গেট দিয়ে ঢুকবে তা নির্দেশনা থাকায় মিছিল খন্ড বিখন্ড হয়ে কেউ গ্যালারিতে, কেউ মাঠে স্থান পায়। অনেকে কোন গেট দিয়ে ঢুকতে না পেরে পাশে আউটার স্টেডিয়ামে বসে নেত্রীর বক্তৃতা শোনে। মাঠের একটা বড় এলাকা ফাঁকা পড়ে থাকে। যে কারণে চাঁদপুরের সন্তান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সুজিত রায় নন্দী বক্তৃতার মাঝে বলেই ফেললেন ‘মাঠ অনেকখানি খালি।’ কিন্তু এটি হওয়ার কথা ছিল না। জনগণ নির্বিঘ্ন গেট পার হতে পারলে মাঠ, গ্যালারি সবই ভরে যেত। কিন্তু ভরল না, এ দুঃখের শেষ নেই। আরেকটি ব্যাপার খুব শ্রুতিকটু লেগেছে যে, জনসভা মঞ্চের পরিচালনার মাইক থেকে চাঁদপুরের বিপরীতে পদ্মার ওপারে শরীয়তপুর জেলা পরিষদ এবং দূরের লক্ষ্মীপুর জেলার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়; কিন্তু চাঁদপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মঞ্চে উপস্থিত থাকার পরও তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি। এটা হীনম্মন্যতা, এর নাম রাজনীতি নয়। ভব্যতাও নয়। এটাকে চানক্যনীতিও বলা যেতে পারে। অবশ্য যারা করেছেন তারা হীনম্মন্যতা থেকেই করেছেন। চানক্যের নাম না জানারই কথা। তাছাড়া বক্তাদের কে কার পরে বক্তৃতা করবেন অর্থাৎ সিনিয়রিটি প্রটোকল কোনটাই মেনটেইন করা হয়নি। কেন কি কারণে তা কেবল আয়োজকরাই বলতে পারবেন। আমার এসব বলার অর্থ বৈরিতা নয়। এখনও নির্বাচনের ৭-৮ মাস বাকি রয়েছে। এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে, নিজেদের সংশোধন করেত হবে- ‘এ দীনতা ক্ষমতা করব প্রভু।’ শেখ হাসিনা এখন তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন এবং তাঁর দায়িত্ব পালন আজ বিশ্বব্যাপী সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এমনি এমনি করেনি। তাঁর দেশপ্রেম, মেধা, সাহস, দূরদর্শিতা বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকেও এক অনন্য উচ্চতায় তুলে নিয়েছে এবং উন্নয়নশীল দেশের সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে। সামনেই উন্নত দেশের মহাসড়ক। আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ। সামনের নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। জাতির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এটি বিশেষ প্রয়োজন এ জন্য যে, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেল, বিদ্যুত প্রকল্প, অর্থাৎ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন, সেইসঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র, মাদক চোরাচালানি জঙ্গী এসব নির্মূল কাজ এখনও শেষ হয়নি। এ মুহূর্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কেন শেখ হাসিনাকে জাতি পরবর্তী নির্বাচনেও বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী তথা রাষ্ট্রনেতা হিসেবে দেখতে চায়? এ জন্য যে, সামনে ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের গ্র্যাজুয়েশন সনদ অর্জন করে উন্নত দেশের সিঁড়িতে পা রাখতে হবে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা। কেউ কেউ মনে করেন সে তো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তাদের উদ্দেশে কথা হলো, তারা কি ভেবেছিল আমরা এবারই উন্নয়নশীল দেশ হব? আমি বলি, শেখ হাসিনা বারবার প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং আমরাও বারবার এক একটি অর্জন ঘরে তুলতে পারব। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেছিলেন। বেঁচে থাকলে এতদিন অপেক্ষা করতে হতো না, পরবর্তী দশ বছরেই আমরা উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হতাম। তেমনি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে ৪১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, তার অনেক আগেই আমরা উন্নত দেশের পর্যায়ে উঠে আসব। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন- What Bengal things today, rest of India things tomorrow. আমি বলি– What sheikh Hasina things today, rest of other leaders think tomorrow. শেখ হাসিনার মতো সেই মেধা, সাহস, দূরদর্শিতা এসবের কোনটাই অন্যদের নেই। ঢাকা ॥ ৫ এপ্রিল ২০১৮ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×