ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মহীয়সী

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৭ এপ্রিল ২০১৮

মহীয়সী

বাংলাদেশ ও বাঙালীর এক গৌরব ও অহঙ্কারের নাম হয়ে আছেন তিনি। বাঙালীর স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা যারা জ্বালিয়েছেন, তিনি তাদের অন্যতম। বহুগুণে গুণান্বিত, বহুকর্মে সমর্পিত তিনি। পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালীর অস্তিত্ব রয়েছে, সেখানেই শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় তার নাম, তার কীর্তি। আজীবন সুরের সাধনা যেমন করেছেন তেমনি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কান্ডারি হয়ে রয়েছেন। তবে সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে, জীবিকা হিসেবে বেছে নেননি, বরং সঙ্গীত তার যাপিত জীবনের অবলম্বন যেমন, তেমনি আন্দোলন, সংগ্রামের হাতিয়ার। এখনও তিনি সুরকে হাতিয়ার করে সাম্প্রদায়িকতা ও কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন ৮৫ বছর বয়সেও। সংস্কৃতিকে সঙ্গী ও সুরকে হাতিয়ার করে জীবনভর অশুভের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন কল্যাণের বাণী। মানবিক ও মুক্ত সমাজ বিনির্মাণে রেখে চলেছেন অনন্য ভূমিকা। সংস্কৃতিকে সঙ্গী করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার পথে। সুরকে হাতিয়ার করে আজও এখনও লড়াই অব্যাহত রেখেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। সাম্য, সম্প্রীতি ও প্রগতির দেশ গড়ে তোলার স্থান নিয়ে তিনি সাধনা করে যাচ্ছেন নিরন্তর। এই কীর্তিমান মানব হলেন ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন। বাংলাদেশের গানে গানে প্রাণে প্রাণে তিনি জাগরূক এক স্বতন্ত্র সত্তায়। বাঙালী সংস্কৃতি ও বাঙালিত্বের বোধ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে, বাঙালী সংস্কৃতিকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখে চলেছেন, তা অতুলনীয়। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের এবং স্বাধীনতার পুরোধা বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী গবেষক ও ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম সন্জীদা খাতুন। ব্যক্তি জীবনে শুধু গান পরিবেশন নয়, শিক্ষকতা নয়, সফল সংগঠক নয়, সন্জীদা খাতুন ব্রতী হয়েছেন গভীরতর বিশ্লেষণে, বাঙালীর স্বরূপ সন্ধানে। নিবেদিত আজও শিল্পের আত্মগত সাধনায়- যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত তার বড় অবলম্বন। রবীন্দ্রসঙ্গীত উপলব্ধি তাকে নিয়ে গেছে জীবনের প্রসারিত প্রাঙ্গণে। গান হয়ে উঠেছে ব্যক্তির জন্য মহাজীবনের আশীর্বাদ এবং জাতির জন্য মুক্তিপথের ইশারা। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা পরিবারের সব সদস্যই নানা ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন। শিক্ষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি, মননশীলতার চর্চা করে সন্জীদা খাতুন নিজেকে নিয়ে গেছেন এক ঈর্ষণীয় অবস্থানে। সুর ও বাণীর ভেতর দিয়ে বাঙালী সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে জীবন উৎসর্গ করেছেন। সারাজীবনের চর্চায় তৈরি করেছেন স্বকীয় এক পরিমন্ডল, গোটা বাঙালী জাতির জন্য এক গভীর অনুপ্রেরণার উৎস। তারই নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ছায়ানটের মতো মহাপ্রতিষ্ঠান, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের মতো বৃহৎ সংগঠন। কোন একটি মাত্র পরিচয় দিয়ে তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা সমীচীন নয়। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বর্ষ উদযাপনের জন্য একত্র হয়েছিলেন সংস্কৃতিমনা কিছু মানুষ, তাদের অন্যতম তিনি। ভয়ভীতি পেছনে ফেলে অত্যন্ত সফলভাবে আয়োজিত হয়েছিল জন্মশত বর্ষ। পাকিস্তানী জান্তা শাসকগোষ্ঠী তার এই কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে ঢাকা থেকে বদলি করে রংপুরে। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেননি। মুক্তিযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সেসব ইতিহাসের অংশ। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু পঞ্চাশের দশকে তাকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা’। বাঙালীর আশা, আকাক্সক্ষা, সাংস্কৃতিক জাগরণ আর মহত্ত্বের ক্ষেত্র তিনিই তৈরি করেছেন। বেগম রোকেয়া অবরোধ বাসিনীদের নিয়ে এসেছিলেন দিবালোকে। সেই পথ ধরে সন্জীদা খাতুন এগিয়ে গেছেন। বাঙালী নারী সমাজের হয়েও তিনি সর্বমানবের জাগরণের গানই গেয়েছেন। মহিমান্বিত করেছেন বাঙালীর স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামকে। অভিবাদন এই মহীয়সী নারীকে। তিনি দীর্ঘায়ু হন এই কামনা।
×