ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বই -তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ৬ এপ্রিল ২০১৮

 বই -তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর

ঠেস-কথার মুন্সিয়ানা ও ভাবনার ঘোরে নিজস্বতায় শব্দকে শ্রুতিধর ও ভাবের গায়েবি মদদদানকারী সাধক কবি ওবায়েদ আকাশ। প্রত্যেকটি কবিতা-ই ঘোরলাগা মোড় পেরুতে পেরুতে পাঠককুলের মনে হয়, কবিতাটি লেখা শেষ হলো কেন শেষপর্যন্ত...! আরও কতক্ষণ পাঠক নিজেকে সঁপে দিতে চায়, এভাবেই কবিতার পর কবিতার শেষেও তৃপ্তি নিয়েই নাখোশ পাঠক; তাই কবি তাঁর কবিতা বইয়ের নাম রাখলেন ‘তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর’... অর্থাৎ, ওবায়েদ আকাশ নিজের জগতের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। পাঠশেষে পাঠক সরোবরে খোঁজেন ওবায়েদ আকাশের ভাবে মোহিত হওয়ার গুপ্ত কলাকৌশল ও বুনন মাহাত্ম্য। আমার কাছে মনে হয়, নিরীক্ষার নামে দুর্বোধ্যতা কবিতাকে ধর্ষিত করে, পাঠককে দেয় চরম বিভ্রান্তি। এটা কেউ কেউ স্বীকার করে আবার অনেকে করে না, হয়ত বা করতে চায় না। তবে দুর্বোধ্যতা শুধু শব্দার্থ বুঝতে না পারা নয়, ভাবেরও ব্যাপার থাকে। যখন ভাবেরও কোন হিসাব না মিলে তখন সেসব কবিতাকে এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। ওবায়েদ আকাশ তাঁর কবিতায় হয়ত আড়াল বা ঢাকনা রাখতে মনপছন্দ; কিন্তু ভাবে মজে গিয়ে টালমাটালি অবস্থা হবে পাঠকের। অতঃপর ওবায়েদ আকাশকে শুধু নিজস্বতা বলয়ে আবদ্ধ করে রাখলেও হবে না। বলতে হয়, কবিতায় ব্যবহৃত প্রত্যেকটা শব্দই শুধু ওবায়েদ আকাশের। অথচ এসব শব্দ প্রতিদিন কবিরা ব্যবহার করছেন। তাহলে, ওবায়েদ আকাশের কেন বলছি...? এখানে ব্যাপারটা হচ্ছে, ওবায়েদ আকাশ শব্দকে নিজের করে নিতে পারেন স্বাচ্ছন্দ্যে। দরদ দেখিয়ে নয়ত চোখ রাঙিয়েও! শব্দের উপস্থাপনা ও বুননে নিজের মতো করে ভাবেন ও গড়েন। ‘তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর’ কাব্যগ্রন্থে ওবায়েদ আকাশের প্রতিটা কবিতাই একেকটি ভ্রমণ। শুরু থেকে শেষ অবধি পাঠককে ধরে রাখতে সক্ষম ভাব ও ঘোরের মায়াবলে। প্রত্যেকটি কবিতার শুরুতে একটা সূক্ষ্ম মেসেজে আরম্ভ হয়ে পরিসমাপ্তিতে পাঠক নিজেই যেতে পারেন উচাটনে; যেমন কাব্যগ্রন্থের শুরুতে ‘মুক্তি’ কবিতার প্রথমেই বলেন— ‘আমার বিছানাসঙ্গীর গায়ের ওপর থেকে/চাদর সরিয়ে দেখি, সে ওখানে নেই!/একটি প্রাপ্তবয়স্ক আত্মজীবনী পড়ে আছে’ এ কবিতাটির শেষে মেসেজটির সমাধা দিচ্ছেনও অকপটে, খুব সুন্দরোত্তম গভীরতায় ‘অভ্যাসবশত ভোরবেলাÑ আমাদের সন্তান যখন/আমার গায়ের চাদর ধরে টান দিল/দেখল, আমাদের দু’জনের কেউই তখন/নেই ওখানে!/মনে মনে ভাবলাম, প্রত্যেকের মুক্তির জন্য/কেউ-না-কেউ একজন থাকেই প্রান্তরে’ (মুক্তি; ৯পৃ.) ০২. এক সত্যকে অন্য সত্যে প্রতিস্থাপিত করে মূল বিষয়কে (মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা) গ্রহণযোগ্য করে তোলাই সমকালীন কবির উদ্দেশ্য আর এটাই সুয়ারিয়ালিজম। আমার মনে হয়, নব্বইয়ের দশকের কবিদের মধ্যে ওবায়েদ আকাশ-ই সুয়ারিয়ালিজমকে অত্যন্ত সুচারুরূপে ব্যবহার করতে সবচেয়ে পারদর্শী। উপস্থাপনা ও বুননের সারল্যতায় পাঠকের কাছে হয়েছে বরণীয়। শব্দের ক্যারিসমায় আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যবহারে হয়েছেন নন্দিত। এসব কিছুর সমাহার ‘তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর’। কাব্যগ্রন্থটি সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, ওবায়েদ আকাশ জীবনঘনিষ্ঠ এক শিল্পীই হয়েছেন শেষপর্যন্ত প্রাকৃতিক নির্যাসে। নিচে এ বইটি থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করছি- ক. হর্ষতরঙ্গ, তুমি নিবেদিতার জন্য এক টুকরো জায়গাজমি রেখ জানো যে, অসময়ে বজ্র-বিষয়ক মামলায় তার চুলের গভীর দিয়ে ঢুকে পড়েছে রাষ্ট্রীয় শোষণ এখন সে সমুদ্রকে বাজার আনিয়ে দেয়, গভীর রাতে তার কামনার পাশে উন্মুক্ত করে ব্যক্তিগত মহার্ঘ শরীর (হর্ষতরঙ্গ; পৃ. ১২) খ. অঙ্কুরোদগমকালে প্রতিটি পাতার মহলে থেমে থেমে রচনা করি অনুনয়হীন আলোর ভঙ্গিমা (অনুনয়হীন; পৃ. ১৩) গ. ঘড়ির দিকে তাকালে কোন কাঁটাটি কখন ঠিক বুকের মধ্যে বিঁধে যায় এই ভয়ে ঘড়িকে বর্জন করেছি (সময়; পৃ. ৩৩) ঘ. পোশাকের অন্ধকার থেকে বিশ্বাসের নৈকট্য স্পষ্ট দেখা যায়– তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর হাঁসগুলো কানায় কানায় উৎসব ছাতিম গাছের নিচে পর্যটনের জিভ চেটে নিচ্ছে নাগরিক ধুলো– (আরণ্যক গ্রীবায় : পৃ. ৫৩) ঙ. কয়েকটি অথবা কয়েকশো ঘণ্টা পর আমি ব্যালকনির খাড়ায় কমলা রঙের অন্ধকার হয়ে বলব যে একদিন যে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম আজ তাতে কতদূরব্যাপী সূর্যাস্ত দেখা যায় এবং আমাদের উত্তরাধিকার যারা ঘোরতর রাতে কালোকে কমলা এবং ঘরকে বাহির দেখছে– তাদের জন্য পরিকল্পিত আবাসে আমরা কতদূর পরাপ্রাকৃতিক সংযোজন রেখেছি যেহেতু এখনই তারা মরুতে মাছ এবং সমুদ্রতলে উটের চাষাবাস বিষয়ে সারারাত মুখস্থ করছে পরাবিদ্যার বই! (উত্তরাধিকার; পৃ. ১৬) এতকিছু বলার পরও, ওবায়েদ আকাশ ব্যক্তিমনের বিচিত্রিত অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ, চিন্তন ও অনুভূতির বিশ্বস্ত বিশ্লেষণে ভালবাসার কথাই বলতে চেয়েছেন। ভালবাসায় বোধের দরজা নাড়িয়েছেন ভাবের দুই হাতে। ‘তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর’ পাঠকপ্রিয় হোক এটুক আমার কামনা।
×