ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বই

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৬ এপ্রিল ২০১৮

বই

স্বপ্নময়ী একাকী -নাজনীন বেগম শফিক হাসানের গল্পগুচ্ছ ‘স্বপ্নময়ী একাকী’ বের হয় ২০১৮ সালের ভাষার মাসে। চেতনার ঐতিহ্যের প্রকাশনায় বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন নিয়াজ চৌধুরী তুলি, নয়টি গল্পের অভিনব সংযোজনে গল্পকার আপন বৈশিষ্ট্যে কোন এক নির্দিষ্ট গন্তব্যে পথচলায় আবিষ্ট। আবেগাশ্রিত নিবিষ্টতায় গল্পের চরিত্রগুলো নির্মিত হয় স্বাপ্নিক অনুভবের এক পরিচ্ছন্ন নান্দনিক দ্যোতনায়। আঙ্গিক ও বিশিষ্টতায় ছোট গল্পের মূল উপজীব্য কাহিনীর গতিপথ তৈরি করে, এক শৈল্পিক বোধে আপন আলয়ে পরিবেষ্টিত হয় শেষ অবধি মূল বার্তা পাঠকের সামনে হাজিরও করে। মানুষের জীবন নিরবচ্ছিন্ন সুখ কিংবা অবিমিশ্র ভালবাসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত নয়। আনন্দ-বেদনা কিংবা মিলন বিরহের এক অদ্ভুত সমীকরণে চলমান জীবনের বেগই শুধু নয়, স্থিতিও বটে। মানব চেতনায় সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্পর্শকাতর বিষয়গুলো যে মাত্রায় গল্পের রূপকারকে নিয়ে যায় সেখানে তিনি একজন সুষ্ঠু সমন্বয়কই শুধু নয়। সৃষ্টিশীল দ্যোতনায় যথার্থ নির্মাতাও বটে। প্রতিটি গল্পের মূল রসদের গভীরে যা কাজ করে তা হলো মায়াঘন আত্মিক সম্মোহনের ভরে তুলতে চায়। বইটি যে গল্প দিয়ে শুরু করা হয় ‘স্বপ্নময়ী একাকী’ সেই মানেরই একটি আবেগ ঘনিষ্ঠ আলাপচারিপ্রবল উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা। মমতাহীন নিরেট বাস্তবে কঠিন জীবনের রূঢ়তায় লেখক উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত। যা তার গল্পে কোনভাবেই আসতে ব্যর্থ হয়। তার চাইতে গল্পকারের সচেতন মনন আর সৃজনসৌধ ধাবিত হয় ভালবাসায় সিক্ত অপার সম্ভাবনার এক স্বপ্নময় আলোকে। যেখানে ভালবাসার কুশীলবরা আবেশের সাগরে অবগাহন করে জীবনকে পরিপূর্ণভাবেতা যা বাস্তবকে ছাড়িয়ে কল্পনার স্বর্গলোকে ভাসতে থাকে। আত্মকথনের মধ্য দিয়ে তৈরি করা এই গল্পের পূর্ণ অবয়ব প্রেমের গহীন অরণ্যে নিজেকে শুধু হারিয়ে দেয়াই নয় মমতাঘন মহিমায় হৃদয়স্নাত অনুভবের এক শৈল্পিক দ্যোতনাও বটে। শেষ অবধি করুণ রসের এক অন্যতম আখ্যান। বাস্তব আর কল্পনার ফারাক কতখানি লেখক তা পাঠকের মর্মমূলে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। ‘অন্য ছবি’ গল্পের নারী-পুরুষের আকর্ষণ, নিবেদনের স্তুতিতে একে অপরের ঘনিষ্ঠ হওয়া, চিরায়িত হৃদয় নিঃসৃত অর্ঘ্যে সমর্পিত হওয়ার যে আকুলতা তা সত্যিই পাঠকের কাছাকাছি চলে আসার মতো এক অপূর্ব কথামালার শৈল্পিক মূর্ছনা। এই গল্পটির পরিণাম কিন্তু বেদনাঘন আর্তিতে পাঠককে ব্যাকুল করে না বরং সম্মোহিত মিলনের অভিনব ঝঙ্কারে গল্পের মূল পাত্র-পাত্রীরা অনবদ্য হয়ে ওঠেন। ছোট্ট এই গল্পটির শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, কথোপকথনের ফুলঝুড়ি সবই পাঠকের দৃষ্টি কাড়ার মতোই। ‘খেলাঘর’ গল্পটি কৌতূহলোদ্দীপক এবং হাস্যরসে ভরা। নাম বিভ্রাট নিয়ে শুরু গল্পটি পাঠককে ভিন্নমাত্রার আনন্দ দেবে। গল্পটিতে প্রসঙ্গক্রমে এসে যায় নিষিদ্ধ পল্লীর বিচিত্র নারীদের হরেক রকম ভাবভঙ্গি এবং শুদ্ধ সমাজের প্রতি তাদের কটাক্ষ আর বিদ্বেষ ছোঁড়া। গল্পটিতে বিস্ময়করভাবে উঠে আসে শুধু নিষিদ্ধ পল্লী নয় অত্যাধুনিক বিলাসহুল হোটেলেও কলগার্লদের নিয়মিত আনাগোনার সঙ্গে অভিজাত এবং দাম্ভিক খদ্দরেরও চমৎকার অভিযোজন। সমাজের একটি অতি বাস্তব প্রতিদান তো বটেই। আরও একটি কঠিন সত্য পাঠককে নাড়া দেবে সন্দেহ নেই। কোন মেয়ের স্বাপ্নিক চেতনায় রূঢ় জীবনের কঠোর চপেটাঘাত। হরেক রকম দুঃসহ টানাপোড়েনে আফসানার কল্পলোকের রঙিন ফানুস কোথায় যে উবে গেল যার যথার্থ উত্তর কারও কাছে নেই। আঘাতের নির্মম পেষণে স্বপ্নময় জীবনটা যে কোন্ পাঁকে মোড় নেয় তা মানুষের উপলব্ধির বাইরে। এসব পঙ্কিল ঘটনা স্নাত ও গল্পকারের মননকে তাড়িত করে, সৃজন চেতনাকে করে অনেক বেশি বাস্তবঘনিষ্ঠ। গল্পগুলো মানুষের প্রতিদিনের জীবন প্রবাহের এক অনবচ্ছেদ কাহিনী সম্ভার। যেখানে আনন্দঘন আবেশে চরিত্রগুলোর যেমন শিল্পকর্ম নির্মিত হয় একইভাবে বেদনাবিধুর আর্তিতে সৃষ্টির মহিমাও এক পরিশীলিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। গল্পের শুরুটা যেমন আকস্মিক, অভিনব, পরিণতিতেও আছে নাটকীয়তা এবং চমৎকারিত্ব। সব মিলিয়ে রূপকার গল্পের যে ইমারত গড়তে চেয়েছেন সেখানে ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়েও তাকে একজন স্থপতির মর্যাদা দেয়া যায়। তবে গল্পগুলো একপেশে, কাহিনীর মধ্যে তেমন কোন বৈচিত্রতা নেই, প্রকৃতির লীলাভূমি আবহমান বাংলার কোন নৈসর্গিক বৈভব, নেই যা প্রতিটি গল্পের মাত্রাকে আরও আকর্ষণীয় করতে পারত। ভাষার মাসে লেখা গ্রন্থটিতে দেশাত্ববোধের একটি পরিচ্ছন্ন আবেদন থাকা জরুরী ছিল। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি। . মায়া এ্যাঞ্জেলো মায়া এ্যাঞ্জেলো (৪ এপ্রিল, ১৯২৮-২৮ মে, ২০১৪) একজন প্রখ্যাত মার্কিন কবি, লেখিকা ও অধিকার মতাদর্শী। নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারের লড়াইয়ে সর্বদা সোচ্চার এই সাহিত্যিক ৫০-এর দশকের শেষের দিকে হার্লেম লেখক পরিষদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনেও (১৯৫৪-১৯৬৮) সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম আত্মজীবনীমূলক বই ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজেড বার্ড সিংজ’ তাঁকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি এনে দেয়। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি অভিনয় এবং অধ্যাপনার সাথেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভার জন্য অর্জন করেছেন বহু দেশী-বিদেশী পদক ও সম্মাননা। ‘ফিনোমেনাল ওম্যান’ কবিতাটি ১৯৭৮ সালে তাঁর এ্যান্ড আইস্টিলরাইজ নামক কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। এই কবিতায় মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে কীভাবে একজন নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি লুকিয়ে থাকে তার নিজস্ব নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যের মাঝেই। কেবলমাত্র আত্মসচেতনতা ও আত্মবিশ্বাসই একজন আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ নারীর অসাধারণ ও বিস্ময়কর হয়ে ওঠার চাবিকাঠি। বিস্ময়কর নারী অনুবাদ : নূর-ই-ফাতিমা মোশাররফ জাহান রূপসীরা অবাক হয়ে ভাবে, আমার গোপন রহস্যটি কী। শরীর আমার নয়মডেলের মতো, চেহারাও নয় তোমিষ্টি। তবু যখন বলতে শুরু করি, ভাবে তারা, মিথ্যা বলছি বুঝি। আমি বলি- রহস্য আমার বাহু-লতার দৈর্ঘ্য, আমার নিতম্বের প্রস্থে, আমার পা ফেলার ধরনে, আমার বাঁকা ঠোঁটের কোণে। আমি এক বিস্ময়- আমি এক নারী। সব মিলিয়ে, আমি এক বিস্ময়কর নারী। শান্ত পায়ে আগাই যখন ঘরভর্তি লোকের ভিড়ে, পুরুষেরা দেখে তখন উঠে দাঁড়ায় আসন ছেড়ে, বাবিনয় দেখায় হাঁটু গেড়ে। এরপর, বেড়ায় ঘুরে আমায় ঘিরে- মৌমাছিদের মতো। আমি বলি- রহস্য আমার কটাক্ষেরছটায়, আমার হাসির ঝিলিকে, আমার কোমরের দোলায়, আমার গতির পুলকে। আমি এক বিস্ময়- আমি এক নারী। সবমিলিয়ে, আমি এক বিস্ময়কর নারী। পুুরুষেরাও অবাক হয়ে ভাবে, কী-বা এমন দেখে আমার মাঝে। আমার গহিন গোপন রহস্যকে কোনভাবেই পায়না তারা খুঁজে। যতই আমি বোঝাই তাদের, তবু নাকি হেঁয়ালি সব। আমি বলি- রহস্য আমার সুঠাম পিঠেরবাঁকে, আমার উষ্ণ হাসির তাপে, আমার বুকের ওঠা-নামায়, আমার চলার মধুরিমায়। আমি এক বিস্ময়- আমি এক নারী। সবমিলিয়ে, আমি এক বিস্ময়কর নারী। এখন তবে বুঝলে তো তোমরা, কেন আমি মাথা নোয়াইনা। কেন নিজের কদর ভুলে, অকারণে গলা তুলে চেঁচাইনা, বা দাপিয়ে বেড়াইনা। চলতি পথে যখন আমার দেখা পাবে মনে তোমার জাগবে পুলক, গর্ব হবে। আমি বলি- রহস্য আমার জুতার সরব হিলে, আমার দীঘল এলোচুলে, আমার কোমল হাতের মুঠোয়, আমার স্নেহের মায়া জালে। কারণ, আমি এক বিস্ময়- আমি এক নারী। সবমিলিয়ে, আমি এক বিস্ময়কর নারী।
×