ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রত্যেক কবি তাঁর অভিজ্ঞতা, যাপন, দর্শনকে নান্দনিক শব্দসহযোগে তাঁদের কবিতায় তুলে ধরে থাকেন। প্রত্যেক কবির চিন্তা-চেতনা যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি তাঁদের শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগও স্বতন্ত্র। তাই কোন কোন কবি একই বিষয়ের ওপর লিখলেও তাঁদের উপস্থাপনের কারণে দু

তাঁদের নাগরিক স্বর -মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ৬ এপ্রিল ২০১৮

তাঁদের নাগরিক স্বর -মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

এক শামসুর রাহমান। তিনি আমাদের প্রধানতম নাগরিক কবি। নগরকে তাঁর মতো করে ঐভাবে কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। ব্যক্তিজীবনেও তিনি আপাদমস্তক শহুরে ছিলেন। তাঁর বলার ভঙ্গি ও কবিতার উপকরণ তাই স্বভাবসুলভ নগরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। বাংলা কবিতার নাগরিক সভ্যতা তাঁর কবিতাকে কেন্দ্র করেই সমৃদ্ধ হয়েছে। অল্প কিছু সময় বাদ দিলে শামসুর রাহমান তাঁর দীর্ঘ জীবন ঢাকা শহরে যাপন করেছেন। ফলশ্রুতিতে তাঁর নগরকেন্দ্রিক কবিতা তাঁর নিজস্ব ঢংয়েই উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি শহুরে দালানকোঠা, নিষ্প্রাণ পাথরে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় বাস, পাকা রাস্তা, রোড লাইট, বাজার, পার্ক, অলিগলি, মার্কেট, ঘুপচি, রেস্তোরাঁ-ইত্যকার নাগরিক শব্দের বহুল প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। যেখানে গ্রামের নিসর্গ ও প্রকৃতি দেখে সবাই মুগ্ধ, সেখানে শামসুর রাহমান মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন নগরের সৌন্দর্য। শহরের নিসর্গ তাঁকে বারবার টেনেছে। শহরের পরিবর্তনও কবি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছেন। কখনও শহরের প্রতি যে তাঁর বিতৃষ্ণা লাগেনি এমনটিও নয়। কখনও কখনও তিনি শহর ছাড়তে চাইলেও পরে সেই ইচ্ছাকে দমন করেছেন। স্মৃতিমাখা বেড়ে ওঠার শহর ঢাকাতেই তিনি স্থির থাকেন : ‘আঁধারের রহস্যময় প্রাচীন তারার স্বপ্নে দয়ালু উজ্জ্বল নৈকট্যের স্মৃতিতে উষ্ণ চিরকাল। বুঝি তাই ফিরে আসি বারবার তেতো হয়ে আসা চুরুটটা মুখে চেপে।’ শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় বারবার শহরকে নানা মাত্রিকতায় দেখতে চেয়েছেন। ছোট ছোট বিষয় আশয়ও তার দৃষ্টি থেকে এড়ায়নি। মূলত কবির সুখ-দুঃখ, অভিজ্ঞতা, পথচলা এই শহরকে ঘিরেই। কবিতায় রাহমানের নাগরিকতার স্বরূপ বহুবিচিত্র। আপাদমস্তক শহরে থাকা শামসুর রাহমানও শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েন নাগরিক পরিবেশে। তাই তিনি গ্রামের পরিবেশ শহরে আনতে চান। চান প্রশান্তি : ‘বড়ো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সম্প্রতি আমরাই শহরে বাগান চাই লিরিকের প্রসন্নতা ছাওয়া।’ বৃষ্টির কথা উচ্চারণ করলে নিঃসন্দেহে মানুষের দৃষ্টি গ্রামের টিনের চালে গিয়ে পৌঁছবে। কিন্তু শহরে কি বৃষ্টি হয় না? শহরের বৃষ্টিও যে আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হয় জনজীবনে, তা শামসুর রাহমান কবিতায় ধরেছেন ভালভাবে। কবি শহরের বৃষ্টিকে প্রেমের মধ্যে একাত্ম করে দিয়েছেন। সেজন্যে তিনি বলতে পারেন অবলীলায় : ‘বরং পার্কের বেঞ্চে সময় কাটাই চলো কথোপকথনে/চলো পার্কে বৃষ্টির আদর মাখি চোখে মুখে...।’ শামসুর রাহমান নাগরিক জীবনযাপন করলেও তিনি অন্ধ নন। শহরের প্রতি তাঁর মমত্ব থাকলেও সেটা বাস্তবতাকে অস্বীকার করে নয়। সেজন্যেই শহরে নেতিবাচক দিকটিও তিনি সহজে যেমন উপলব্ধি করেছেন, তেমনি সেটি উপস্থাপনও করেছেন তাঁর কবিতায়। একচক্ষু দৃষ্টি কখনও তাঁর চিন্তাকে আকীর্ণ করতে পারেনি। তাই তিনি স্বচ্ছন্দেই বলতে পারেন ‘এ শহর চতুর্দিকে ভিড় চতুর্দিকে/বামনেরা জটলা পাকায়’। শামসুর রাহমানকে ঢাকাকে চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখেছেন। শহরের পরিবর্তন তিনি টের পাচ্ছিলেন। কেননা, যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাতে ঢাকা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন রূপ লাভ করছিল। এই পরিবর্তন তিনি মেনে নিতে পারেননি। অবশ্য কেউই চাইবে না তার স্মৃতিঘেরা পরিচিত দৃশ্যগুলো হারিয়ে যাক। শামসুর রাহমানও এ দলের বাইরের কেউ নন। তাই তাঁকে সসঙ্কোচ আক্ষেপে কবিতায় বলতে দেখি : ‘আমি কি কখনও জানতাম এত দ্রুত/শহরের চেনা দৃশ্যাবলি লুপ্ত হয়ে যাবে?’ শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকে বিশেষভাবে ধারণ করে আছেন। মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতার বেলাভূমিতে প্রবলভাবে আঁচড়ে পড়েছিল। শামসুর রাহমান প্রথমত যে রাজনীতি সচেতন ছিলেন না, কিন্তু পরে যে পুরোমাত্রায় রাজনীতি সচেতন ছিলেনÑতাঁর কারণ কি নাগরিক যাপন নয়? বিশেষত, নাগরিক যাপনই তাঁকে আরও বেশি রাজনীতিসচেতন করে তুলেছিল। যাঁর অভিঘাত ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যে স্পষ্ট। যদিও এ কাব্য থেকে তাঁর কবিতায় নতুন দিকে বাঁক নিচ্ছিল। যেহেতু রাহমান তাঁর দৈনন্দিনতাকে কবিতায় স্থান দিতেন, তাই শহর অসংখ্যবার স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায়। নগর, নাগরিকতা হয়ে উঠেছে তার কবিতার বিশেষ উর্বরভূমি। পরে আরও অনেক কবিই নাগরিকতাকে কবিতায় স্থান দিয়েছেন, কিন্তু শামসুর রাহমানের মতো নয়। বিশেষত, শামসুর রাহমানের কবিতাগুলো বর্ণনাত্মক বলেই তাঁর কবিতা নাগরিক যাপনকে সহজেই পাঠকদের সামনে উন্মোচিত করেছে। দুই. সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম কুড়িগ্রাম জেলায় হলেও তিনি জীবনের অতিক্রান্ত অধিকাংশ সময় ঢাকা শহরে কাটিয়েছেন। তাঁর লেখালেখির বিকাশও হয়েছিল এই নগরে। যদিও তাঁর কবিতা বহুবিধ বিষয়কে ধারণ করে আছে, তবু সেখানে নাগরিক যাপনের উপস্থিতি কম নয়। নাগরিক ধারায় তাঁর স্বর যে প্রবল সে-কথা না বলেও বলা যায়, তিনি তাঁর দেখা নগরকে এঁকেছেন বিবিধ ব্যঞ্জনায়। তাঁর নাগরিক প্রেম : তুমি ভাল আছো তো এখন? বারবার এই প্রশ্ন ছুড়ে দিতে চাই শহরে, রাস্তায়, ঘরে, রেস্তোরাঁয়, টেলিফোনে, বাগানে, বিমানে; তুমি ভাল আছো? বারবার এই প্রশ্ন ছুড়ে দিতে চাই বরফে, বর্ষায়, পার্কে, পরবাসে, সিঁড়িতে, মোটরকারে, দেয়ালে, পোস্টারে। তুমি আছো কোথায় কীভাবে? যেখানেই আছো তুমি ভাল আছো কি-না? -আমার জানতে বড় সাধ হয় কেবল প্রেমই নয়, তাঁর বিরহে, প্রতিবাদে, দ্রোহে, প্রকৃতিতে নাগরিক জীবনের প্রভাব সুস্পষ্ট। কবিতায় তিনি যেমন বলেছেন, ‘এসো, আমরা এই শহরের ওপর দিয়ে/পাখির দলের মতো উড়িয়ে দিই/আজ আমাদের কোরাস।’ তেমনি খুব স্বাভাবিকভাবে উচ্চারণ করেছেন- ‘এ হলো শহর এক এমন শহরÑকেবলি পাথর আনাজ পাথর এর ভবন পাথর, বাহন পাথর এর মানুষ পাথর, পানিও পাথর এর উৎসব পাথর শরীর পাথর এর সঙ্গীত পাথর, করতলে পায়রার জন্যে রাখা দানাগুলোÑএবং পাথর, এ হলো এক বেজান শহর’ -বেজান শহরের জন্যে কোরাস এই পাথর শহরের গান গেয়ে তিনি চলে যেতে চান এ শহর থেকে। শহরের কোন কিছুই যেন তাঁকে টানছে না। নাগরিক কৃত্রিমতাকে তিনি আঁচ করতে পেরেছেন। তাই তিনি বলেন, ‘আমি চলে যাব/তোমাদের কমার্শিয়াল ব্লকগুলোর জানালা থেকে/অনবরত যে বমন/সেই টিকার-টেপের নিচ দিয়ে/এক্ষুণি;/আমি চলে যাব/তোমাদের কম্পিউটারগুলোর ভেতরে যে/বায়ো-ডাটার সংরক্ষণ/তার পলকহীন চোখ এগিয়ে/অবিলম্বে;।’ কেননা, শহরের এ্যাপার্টমেন্ট, উনুন, ব্যাংক, পরিষদ, রমণী কবিকে কষ্ট দেয়। সৈয়দ হকের ‘আমার শহর’ কবিতায় তিনি যখন বলেন, ‘এখন আমার কাছে এ শহর বড় বেশি ধূসর/ধূসর বলে মনে হয়’ তখন শহরের প্রতি বিতৃষ্ণ হওয়ার ছবিটি আরও স্পষ্ট হয়। বিশেষত, শহরের সভ্যতার নামে অসভ্যতা, সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি কবিকে পীড়া দিত। দিন যতই যাচ্ছিল ততই যেন পরিচিত প্রিয় শহরটি হারিয়ে যেতে বসেছে। কবির মতে, ‘আমি যাকে চিনতাম/যার বুক ভেঙে পুরানা পল্টন ঘিরে হাঁটতাম দুপুরে গভীরে,/প্রথম প্রেমের মতো যার গলা হঠাৎ জড়িয়ে/কবিতা লেখার হাতেÑ/এই দুটো হাতেÑ/দুঃখসম মেশানো দু চোখে আমি কাঁদতাম,/আমার শহর সেই ডুবে গেছে কোন্ কালীদহে।’ শহরের এই রূঢ় পরিবর্তন শামসুর রাহমানের মতো সৈয়দ শামসুল হকও মানতে পারেননি। এই পরিবর্তন কবির হৃদয়ে শূন্যতার বিশাল বৃত্ত তৈরি করে দিয়েছে। তবে নাগরিক যাপন করেও ফুল, নদী, পাখি, জ্যোৎ¯œা, পালিমাটি তাঁর কবিতায় ওঠে এসেছে বারবার। এই কারণেই নাগরিক অভিঘাত তুলে ধরার ক্ষেত্রে শামসুর রাহমান কিংবা শহীদ কাদরী যতটা দক্ষ ছিলেন, অনভূতির কারণেই সেভাবে তুলে ধরেননি সৈয়দ হক। তবে নিঃসন্দেহে সৈয়দ শামসুল হকের অজ¯্র কবিতা সম্ভারের মধ্যে তাঁর শহরকে উপজীব্য করা কবিতাগুলো ব্যতিক্রম। ইটের নগরের সৌন্দর্য, যান্ত্রিক সভ্যতার প্রাপ্তি, ক্লান্তি, জড়তা, স্বেদ-সবকিছুই তাঁর কবিতার নাগরিক স্বরকে উচ্চকিত করেছে। তিন. শহীদ কাদরীর জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতার পার্ক সার্কাসে। ১০ বছর শৈশব জীবন কলকাতায় অতিক্রম করার পর ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় তিনি ২৬ বছর বসবাস করেন। ১৯৭৮ সাল থেকে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বার্লিন, লন্ডন, বোস্টন ও নিউহয়র্কে বাস করেছেন। যদি যাপনের কথা চিন্তা করা হয় এবং যাপনের সাথে সাহিত্য রচনার যোগসূত্র আঁকা হয়Ñতবে শহীদ কাদরীর কবিতায় নাগরিকতার উপস্থাপন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সহজ হবে। কবি যা লিখেন তার ভিত্তিমূল হিসেবে তাঁর যাপিত জীবন, দর্শন, অভিজ্ঞতা, পরিবেশসহ নানা উপকরণ কাজ করে। শহরে বেড়ে ওঠার কারণে স্বভাবজাতভাবে নাগরিকতা শহীদ কাদরীর মধ্যে ছিল। তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘শহীদ কাদরীর নাগরিকতা অর্জিত নয়, স্বভাবজাত’। শহীদ কাদরীর যাপন করা নাগরিক জীবন যে তাঁর কবিতায় এসে উপস্থিত হয়েছে সেটি তাঁর কবিতাগুলো পাঠ করলেই বোঝা যায়। তবে নাগরিক জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় শহীদ কাদরী নিজস্বতার প্রকাশ করতে পেরেছেন। তিনি এ জীবনকে উদ্যাপন করেননি, বড় করে দেখেননি এবং নাগরিকতার জয়গানও তাঁর কবিতা প্রকাশ করে না। নাগরিক সৌন্দর্য উন্মোচনের চেয়ে তাঁর অধিকাংশ কবিতায় নাগরিকতা স্থান পেয়েছে দুঃখ, আক্ষেপ, বিদীর্ণতার স্বর হিসেবে। নাগরিক জীবনের সীমাবদ্ধতা কবিকে ভাবিয়েছে, তবে সে সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার চেষ্টাও তাঁর ছিল। তাই তিনি হা-হুতাশ করেছেন, কখনও কটাক্ষ, কখনও বদলে দিতে চেয়েছেন শহরকে। ‘এবার আমি’ কবিতাটি এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। এ কবিতাটির মধ্যে শহীদ কাদরী যেমন উপমায় নাগরিকতার সৌন্দর্য স্পর্শ করেছেন, একই সঙ্গে প্রকাশ করেছেন শাহরিক আক্ষেপ ও অভিমান এবং উত্তরণের জন্য তাঁর প্রচেষ্টাটি এখানে অর্থবহ রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে। কবিতার শুরুতেই শহীদ কাদরী বলেছেন : ‘চায়ের ধূসর কাপের মতো রেস্তোরাঁয়-রেস্তোরাঁয়/অনেক ঘুরলাম...’। তারপর যেন নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেন অথবা প্রেয়সীকেÑ‘এই লোহা, তামা, পিতল ও পাথরের মধ্যে/আর কতদিন?’ নিজেকে নিয়ে অবলীলায় বলেছেন, ‘আমি করাত-কলের শব্দ শুনে মানুষ/আমি জুতোর ভেতর, মোজার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ।’ এই যে নাগরিক জীবন, জুতো, মোজার ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়াÑতার পরিবর্তে কবির ইচ্ছে : ‘আমি এবার গাঁও-গেরামে গিয়ে/যদি ট্রেন ভর্তি শিউলি নিয়ে ফিরি/ হে লোহা, তামা, পিতল এবং পাথর/ তোমরা আমায় চিনতে পারবে তো হে!’ শহীদ কাদরীর প্রেমও তাঁর নাগরিক বৃত্তের বাইরে নয়। তাঁর প্রেম নাগরিক অলিগলি ছুঁয়েই অমরত্বের পথে হেঁটেছে। শহরের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে সঙ্গী করেই কবি হেঁটেছের তাঁর কাক্সিক্ষত পথে। তবে তাঁর প্রেমের কবিতাগুলোতে নাগরিক জীবনের বিতৃষ্ণা স্পষ্ট। শহরের পরিবেশের প্রতি তাঁর তীব্র তীর পরতে পরতে লক্ষণীয়। শহীদ কাদরীর কবিতায় স্পষ্টভাবেই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দেখা মেলে। তিনি নিজেকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করতে পারদর্শী ছিলেন। কবি শহীদ কাদরীকে ‘একটি উত্থান-পতনের গল্প’ কবিতায় দেখি ব্যক্তি শহীদ কাদরীকে উপস্থাপন করেছেন তাঁর নিজস্ব ঢংয়ে। ব্যক্তি শহীদ কাদরীর নাগরিক যাপনকে কবির উপস্থাপন : ‘প্রবল বর্ষার দিনে বাবা রাস্তায় জলোচ্ছ্বাস তুলে স্টুডিবেকারে ঘরে ফিরতেন, আমি পাতলুন গুটিয়ে স্যান্ডেল হাতে অনেক খানাখন্দে পা রেখে এভিনিউ পার হতে চেষ্টা করি’ শহীদ কাদরী হাস্যরসিকতা পছন্দ করতেন। সূক্ষ্ম রসিকতা কখনও বন্ধুদের নিয়ে, কখনও নিজেকে নিয়েও। শহরের প্রতিদিনের যাপন তাই নিঃসঙ্কোচে তুলে আনতে তিনি পারঙ্গম। এ প্রসঙ্গে ‘কোন কোন সকালবেলায়’ কবিতার একাংশের পাঠ নেয়া যাক : টুথব্রাশ, মাজন চুলে ঠান্ডা বাতাস সকালের, কমোডে বসে ‘বাংলাদেশ টাইমস’ অনেকক্ষণ অনেক অনেকক্ষণ। শামসুর রাহমানের মতো শহীদ কাদরীও রাজনীতি সচেতন কবি। তবে উপস্থাপনের দিক দিয়ে তাঁরা দুজনেই স্বতন্ত্র। ১৯৭৪ সালে শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট রাইট লেফ্ট’। এ কবিতা রচনার পেছনে যুদ্ধ পরবর্তী মনোভাব দারুণভাবে কাজ করেছিল। সেজন্যে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র বললেই মনে হয় তেজগাঁ/ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা,/হাসপাতালে আহত মজুরের মুখ।’ এখানে যে ‘তেজগাঁ’, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল’ শব্দের ব্যবহার তা কবির নাগরিক প্রতিচ্ছবির ফসল। বিশেষত, শহীদ কাদরী তাঁর কবিতায় যেভাবে অকপটে নাগরিক শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন, ব্যবহার করেছেন যান্ত্রিক বিষয়-আশয়, তা অন্য কোন কবির কবিতায় ফুটে উঠেনি। তাঁর কবিতায় ‘ল্যাম্পপোস্ট, ফুটপাথ, করাতকল, ট্রাফিক, ক্লাব, এরোপ্লেন, পোস্টার, অটোগ্রাফসহ প্রচুর ইংরেজী শব্দকে সহজে ব্যবহার করেছেন। এইসব শব্দবন্ধ প্রতিদিন নাগরিক জীবনে ব্যবহার হলেও কবিতায় তার সন্ধান আমরা কমই পেয়েছি। আর এসব শব্দকে কবিতার ভাবের প্রবাহের সঙ্গে যথাযথভাবে সংযুক্ত করাও কম কষ্টকর কাজ নয়। শহীদ কাদরী কষ্টকর কাজেই ব্রতী হয়েছিলেন এবং লাভ করেছিলেন সফলতাও। চার. শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও শহীদ কাদরীÑতিনজনই নাগরিক যাপনকে কবিতায় তুলে ধরলেও তিনজনেরই যাপনই কি একরকম? সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন, কবিতা একীভূত হওয়ার পথে হাঁটে না। কবিতা চায় স্বাতন্ত্র্যতা। আলোচ্য তিন কবিই নাগরিকতাকে অবলম্বন করে কবিতা লিখলেও তাঁর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। এ পার্থক্য যেমন চিন্তায়, শব্দ চয়নে, তেমনি পার্থক্য এর উপস্থাপনেও। শামসুর রাহমানের কবিতা যতটা বর্ণনাত্মক-অন্য দুজন একই ঢংয়ে শহরকে উপস্থাপন করেননি। শহীদ কাদরীর কবিতায় নাগরিক জীবনের যতটা ক্লেদ, বিষণœতা ছড়িয়ে আছে ততোটা গভীরে ছড়িয়ে নেই সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায়। ব্যক্তিগত জীবনে শামসুর রাহমান সারাজীবন নগরে কাটিয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হকও অধিকাংশ জীবন ঢাকায় কাটিয়েছেন। শহীদ কাদরীর যৌবনদীপ্ত দিনগুলো কেটেছে রাহমান ও সৈয়দ হকের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, কবিতার আলোচনা, সমালোচনা করে। তাঁদের নাগরিক জীবন এক হলেও তার উপস্থাপন ছিল বহুবর্ণিল। তাঁরা প্রত্যেকেই বাংলা কবিতায় নিজের স্বর যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। তিন কবির একজনও বর্তমানে সবুজ ঘাসের ওপর পা ফেলে দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু সবুজ হয়ে আছে তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার। তাঁদের কর্মের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
×