ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উজ্জ্বল নক্ষত্রের নিরব বিদায় -আকিল জামান ইনু

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৬ এপ্রিল ২০১৮

উজ্জ্বল নক্ষত্রের নিরব বিদায় -আকিল জামান ইনু

প্রাচীন গ্রীক-রোমান কাল থেকেই সমর নায়কেরা আগ্রহের কেন্দ্রে। যুদ্ধে বীরত্ব তাদের দিয়েছে নায়কের মর্যাদা। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তাদের নিয়ে যাদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সহিংসতার মধ্য দিয়ে। যারা বাধ্য হয়েছেন হিংসার মোকাবেলায় সহিংস পথ বেছে নিতে। আমরা ওয়েলিংটন, এড. নেলসন বা চার্চিলের অনেক অপ্রীতিকর মন্তব্যও মেনে নেই যদি ফলাফল হয় নেপোলিয়ন বা হিটলারের পরাজয়। সভ্যতার স্বার্থের দোহাই দিয়ে। কিন্তু ইউনি ম্যাডিকিজেলা ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে প্রেস আমাদের কি বার্তা দেয়? তা কি এই যে, কোন সাদা চামড়ার বিট্রিশের মতো ফুলেল বিদায়, বা প্রশংসাসূচক বিদায় বার্তা তার প্রাপ্য নয়। তাকে বলা হচ্ছে ‘বিতর্কিত এবং উৎপীড়ক,’ এমন কি তাকে ‘ঘৃণ্য, বিষাক্ত ব্যক্তি’ আখ্যায় অভিহিত করা হয়েছে সংবাদপত্রে। মিডিয়া সামনে এনেছে ১৪ বছরের স্টম্পি ময়েকেটসির মর্মান্তিক হত্যার বিষয়টি। কেউই এটা বিবেচনায় আনেননি যে; এই অপরাধের সঙ্গে কোন যোগসাজশের কথা তিনি বরাবরই অস্বীকার করে আসছিলেন। এমন কি বৈষম্যমূলকভাবে তার ও তার সমর্থকদের ওপর কালিমা লেপনের সরকারী প্রচেষ্টার কথাও বিবেচনায় রাখা হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইউনির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে এসব বিষয় সামনে আনা হচ্ছে। আর এসবের সঙ্গে বর্ণবাদী সমাজে প্রাণ হারানো কালো শিশু বা তাদের সংগ্রামের সম্পর্ক খুব সামান্যই। আসল কথা হলো বর্ণবাদ কতটা ভুল ছিল সেটা স্বীকার করায় অনীহা, সেটিকে হালাল করার এক ধরনের চেষ্টা। তারা এটিও অস্বীকার করতে চায় যে, ইউনি ম্যান্ডেলা বা তার মতো লোকদের কতটা অবদান রয়েছে এই বর্ণবাদী অনাচার, বৈষম্য অবসানে। ব্রিটেনে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ না করেও হিরো হওয়া সম্ভব। সম্ভব সে বিজয় গৌরবের ভাগীদার হওয়া। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী প্রভুত্বকামীদের বিরুদ্ধে লড়াইরতদের সে সুযোগ ছিল না। তাদের নিন্দা করা খুব সহজ। ুুুআমরা ভুলে গেছি সেই অন্ধকার দিনগুলোর কথা। যখন একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নৈতিক ও আইনগত সমর্থন ছিল শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনের পক্ষে। তাদের উৎখাত কতটা কঠিন ছিল সে কথা আজ কলাম লেখক, পন্ডিতেরা ভুলেও বলেন না। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সেখানে কোন কাজে আসেনি। কাজে আসেনি কোন বয়কট, অবরোধ বা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। সহজ সত্যিটা হলো, সেখানে প্রয়োজন ছিল আপোসহীন বিপ্লবীদের। প্রয়োজন ছিল আইন ভাঙতে প্রস্তুত- এমন সব মানুষের। সেইসব মানুষ, যারা রাস্তায় নামবেন মারতে অথবা মরতে। সেটাই ছিল সময়ের দাবি, এটাই সত্য। প্রয়োজন ছিল ইউনি ম্যাডিকিজেলা ম্যান্ডেলার। আজ যাকে বিশ্ব মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, তিনি ছিলেন সেই আন্দোলনের কেবলই একজন সাধারণ কর্মী, আসলে তা নয়, তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত এক নেত্রী। ৩৫টি বছর তাকে টিকে থাকতে হয়েছে শ্বেতাঙ্গ প্রভুত্বকামী শাসকদের সঙ্গে লড়াই সংগ্রাম করে। নিত্যসঙ্গী ছিল হুমকি, হয়রানি, নজরদারি আর কারাবাস। ৪৯১ দিন কাটিয়েছেন নির্জন কারাবাসে, নির্বাসনে কেটেছে জীবনের আটটি বছর। এমনকি কারাগারে তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে অভিনব শাস্তির। নিত্য প্রয়োজনীয় স্যানিটারী সামগ্রী না পেয়ে ভাসতে হয়েছে নিজের রক্তে। নারী হিসেবেও নূন্যতম সম্মান দেয়া হয়নি তাকে। আজ যখন ডেইলি মেইল তার জীবনকে বলে ‘রক্তে-সিক্ত,’ তার হাত রক্তে রঞ্জিত! তখন মনে পড়ে, যে বর্ণবাদী শাসকদের তিনি উৎখাত করেছিলেন তারা তাকে বলত, ‘গু-া’। আজ আমরা নেলসন ম্যান্ডেলা ছাড়া সবার কথা ভুলে যেতে চাই। কে মনে রেখেছে রবার্ট সুবুকিউর নাম? বর্ণবাদী শাসকেরা যার ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসা পর্যন্ত হতে দেয়নি। অথবা এলিস মটসোলদির কথা? ২৬ বছরের আগে যে মুক্তি পায়নি রোবেন আইল্যান্ড থেকে, ছিলেন ম্যা-েলার পাশেই। কিংবা বেনজামিন মলয়েসি, ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দেয়া কবি। আমাদের কাছে ইউনির চেয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা অনেক বেশি নিরাপদ। কারণ তিনি ক্ষমার বার্তা দিয়েছেন, অতীত ভুলে গিয়ে সমন্বয়ের কথা বলেছেন। ম্যান্ডেলা সহজেই যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেছেন শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনকালের প্রেসিডেন্ট এফডব্লিউ ডি ক্লার্কের সঙ্গে। যে সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন ইউনি। ইউনির প্রতিটি বিরোধিতা ছিল যে শ্বেতাঙ্গ প্রভুত্ববাদের বিরুদ্ধে তার আজীবনের সংগ্রাম সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। যে রূঢ়, বিভীষিকাময় বাস্তবের মোকাবেলা তাকে করতে হয়েছে সেখান থেকে তার জন্য বিষয়গুলো মেনে নেয়া অত সহজ ছিল না। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, আমরা কেউ আজ সে বিবেচনায় যাচ্ছি না। ভুলেও গেছি শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনাবসানে ইউনির ভূমিকা। আমরা অনেককেই নায়কের মর্যাদা দিয়েছি। তাদের নাম আমরা ঠাঁই দিয়েছি অমরত্বের তালিকায় আর ভুলে যেতে চাইছি ইউনির মতো মানুষদের। ইতিহাস একদিন ঠিক বিচার করবে কোন পক্ষ সঠিক। আমরা যারা নিজের এবং জাতিগত আত্মমর্যাদা নিয়ে গর্ব করি ইউনির মৃত্যু তাদের সামনে এক সুযোগ এনে দিয়েছে। আমাদের বলতে হবে সেই সত্য, কতটা লড়াই-সংগ্রামের মাঝে দিন পাড়ি দিয়েছেন তিনি। কতটা প্রতিকূল পথ তিনি পাড়ি দিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসনবিরোধী আন্দোলনে। এক জীবনে কতটা মূল্য তিনি দিয়েছেন নিজের আদর্শের জন্য। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত পায়ে স্বজাতির স্বাধীনতার জন্য জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে পথ চলেছেন ইউনি। এবং শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। তার গায়ের রং কালো, তিনি নারী, এক আজন্ম যোদ্ধা। শেষ পর্যন্ত তিনি একজন মানুষ। এমন একজন মানুষ যার সমালোচনা করা যায় কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না। পথ চলেছেন মাথা উঁচু রেখে, সময়কে প্রভাবিত করেছেন নিজের মতো করে। হয়ে উঠেছিলেন স্বজাতির কণ্ঠস্বর, লড়াই-সংগ্রামের প্রতীক। তিনি সত্যিকারের নায়ক, এটাই তার আসল পরিচয়, ইতিহাসের পাতায় এভাবেই ঠাঁই পাবেন তিনি। এটি বলা যায় নিশ্চিত করেই। সূত্র : গার্ডিয়ান
×