ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষের সংস্পর্শ যেসব প্রাণীকে বদলে দিয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৬ এপ্রিল ২০১৮

মানুষের সংস্পর্শ যেসব প্রাণীকে বদলে দিয়েছে

আমাদের পূর্ব পুরুষরা গত ১৫ হাজার বছরে ডজনকে ডজন বন্যপ্রাণীকে পোষ মানিয়ে গৃহপালিত করেছিলেন তাদের খামারের প্রাণী হিসেবে অথবা পোষা প্রাণী হিসেবে রাখার জন্য। যেমন কুকুর, গরু, ভেড়া, ঘোড়া, শূকর, পাখি ইত্যাদি। এভাবেই বুনো নেকড়ে পোষ মানানোর মধ্য দিয়ে পোষা কুকুরে বিবর্তিত হয়। আগে যা ছিল অতি হিংস্র প্রাণী বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে কম হিংস্র বা অতি শান্ত স্বভাবের প্রাণী যেগুলো প্রজননের জন্য নির্বাচিত হয়। পোষ মানানোর ব্যাপারটা তাই নির্বাচনের অতি গুরুত্বপূর্ণ মানদ-। কালক্রমে পোষ মানা প্রাণীর আচরণটি শুধু বদলায়নি তাদের চেহারা বদলে গেছে। বিভিন্ন প্রজাতির বেলায় এই একই রকম পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। যেমন গৃহপালিত খরগোশ, কুকুর ও শূকরের সবার শরীরে সাদা ছোপ ছোপ দাগ আছে, তাদের কান দুটো ঝুলানো, মস্তিষ্কের আকার ছোট এবং নাসিকাও খাটো। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে গৃহপালন সিনড্রোম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সম্প্রতি একদল গবেষক এই বৈশিষ্ট্যগুলো শস্যাগার বা গোলাবাড়িতে বাস করা বুনো ইঁদুরের মধ্যেও লক্ষ্য করেছেন। জুরিখের কাছে একটি গোলাবাড়িতে বাস করা এই ইঁদুরদের পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার ফলে তাদের স্বতন্ত্র দুটো পরিবর্তন ঘটে গেছে। একটা হলো তাদের বাদামি রঙের লোমশ শরীরে সাদা ছোপ ছোপ দাগ পড়েছে এবং লম্বাটে নাসা হয়ে গেছে খাটো। গবেষক দলের প্রধান আনা লিন্ডহোম বলেন, ‘এই ইঁদুরগুলো ভয় নামক বস্তুটি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছে এবং তাদের মধ্যে গৃহপালিত হওয়ার বা পোষ মানার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। মানুষের দিক থেকে কোন রকম নির্বাচন ছাড়াই শুধুমাত্র নিয়মিত মানুষের সংস্পর্শে থাকার ফলেই এমনটি ঘটেছে।’ বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী লিন্ডহোম প্রায় ১৫ বছর ধরে শূন্য গোলাবাড়িতে বাস করা ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালিয়ে এসেছেন। গবেষকরা ইঁদুরগুলোক নিয়মিত খাবার দিয়েছেন, পানি দিয়েছেন এবং তাদের সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্যানুসন্ধান চালিয়েছেন। গৃহপালন বা পোষ মানা সিনডোম সম্পর্কিত বিজ্ঞানীদের ধারণাটি এসেছে এক অসাধারণ গবেষণা থেকে যা শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সালে সাইবেরিয়ায়। সোভিয়েত জিনেটিক বিজ্ঞানী দিমিত্রি বেলায়েভ বুনো শিয়াল পোষ মানিয়ে তাদের বিবর্তনমূলক পরিবর্তন সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান চালান। তিনি প্রতিটি নতুন প্রজন্মের শিয়ালদের মধ্য থেকে সবচেয়ে বেশি পোষ মেনেছে এমন প্রাণীগুলোকে বেছে নেন। কালক্রমে দেখা যায় যে শিয়ালগুলোর আচরণ বদলাতে শুরু করেছে। তারা মানুষজনকে শুধু যে সহ্য করে নিয়েছে তাই নয়, উপরন্তু সরাসরি বন্ধুভাবাপন্নও হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে তাদের চেহারাও বদলে গেছে। ওদের গায়ের পশমে সাদা ছোপ ছোপ দেখা দিয়েছে, লম্বাটে নাসাও খাটো হয়েছে। কান হয়েছে আনত এবং লেজ কোঁকড়ানো অবস্থা ধারণ করেছে। গবেষকরা মনে করেন যে প্রাণীদের এসব আচরণগত ও শারীরিক যেসব পরিবর্তন সমান্তরালভাবে ঘটে যায় তার জন্য দায়ী হলো ভ্রƒণের প্রথম অবস্থার স্টেম সেলগুলোর ছোট একটি গ্রুপ থাকে বলা হয় নিউরাল ক্রেস্ট। কানের কোমলান্থি, দাঁতের প্রধান অংশ যে কঠিন টিস্যু দিয়ে গঠিত সেই ডেন্টাইন, গাত্রচর্মের স্বাভাবিক বংশের জন্য দায়ী মেলানোসাইট এবং স্ট্রেস হরমোন যেখান থেকে উৎপন্ন হয় সেই এড্রেনাল গ্ল্যান্ডÑ এসব কিছুই স্টেম সেল থেকে সৃষ্ট। যে সব প্রাণী কম ভীরু বা হিংস্র সেগুলো পোষ মানার জন্য নির্বাচনের ফলে এদের এড্রেনাল গ্ল্যান্ড ছোট হয়ে আসে যার ফলে সেগুলোর সক্রিয়তা কাম এবং সেই কারণে প্রাণীগুলো সহজে পোষ মানে। পশমের রং ও মাথার সাইজ পরিবর্তনকে পোষ মানানোর অনভিপ্রেত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলে গণ্য করা যেতে পারে। মেডেলিন গেইগার নামে এক গবেষক দেখিয়েছেন কিভাবে ১৫ হাজার বছর আগে ইঁদুরগুলো মানুষের খাবারের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তাদের কাছাকছি বাস করতে শুরু করে। শুধুমাত্র এই নৈকট্যের কারণে ইঁদুররা মানুষের সংস্পর্শ লার্ভে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং ঘর-পোষা হয়। তিনি বলেন, নিজ থেকে এই ঘরপোষা হওয়ার ফলে ঘটনাচক্রে ও অনবধানবশত ধীরে ধীরে তাদের চেহারায় পরিবর্তন ঘটে। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন যে বুনো নেকড়ে গৃহপালিত কুকুর বিবর্তনের প্রক্রিয়াটি গোড়াতে মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াই শুরু হয়েছিল। মানুষের কাছাকাছি বাস করা নেকড়েরা কম হিংস্রা ও অপেক্ষাকৃত ভীরু হয়ে ওঠে। ওটাই ছিল গৃহপালিত হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×