ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইন স্মৃতি নাট্যোৎসব শুরু

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৬ এপ্রিল ২০১৮

সৈয়দ বদরুদ্দীন  হোসাইন স্মৃতি নাট্যোৎসব শুরু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চৈতালী বিকেলে ভেসে বেড়ায় গানের সুর। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার বহিরাঙ্গনে বিরাজ করে উৎসবমুখরতা। চোখে পড়ে একঝাঁক নাট্যকর্মীর প্রাণ প্রাচুর্যময় উপস্থিতি। এরই মাঝে উৎসব আঙিনায় হাজির হন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে অন্য অতিথিরা জড়ো হন নাট্যশালার লবিতে। সবাই মিলে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন আল্পনায় আবৃত ও লোকজ অনুষঙ্গে সজ্জিত উৎসব আঙিনায়। এভাবেই বৃহস্পতিবার আনন্দ আয়োজনে শুরু হলো হলো সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইন স্মৃতি নাট্যোৎসব। এরপর পাঁচ দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সম্মাননা জানানো হয়ে দুই বরণ্যে নাট্যজনকে। এ সম্মাননা পেয়েছেন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন (মরণোত্তর) ও অধ্যাপক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। ৯ এপ্রিল পর্যন্ত চলমান উৎসবে দেশের নয়টি নাট্যদল ও ভারতের একটি দল মিলে মঞ্চস্থ করবে বৈচিত্র্যময় দশটি নাটক। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে ও এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হবে নাটকগুলো। সেই সঙ্গে প্রতিদিন নাট্যশালার বহিরাঙ্গনে থাকবে সবার জন্য উন্মুক্ত গান, পথনাটক, আবৃত্তিসহ বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। উৎসবের আয়োজক পদাতিক নাট্য সংসদ (টিএসসি)। নবমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভাষাসৈনিক, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইনের নামাঙ্কিত এ নাট্য আয়োজন। উৎসব উদ্বোধন করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। নাট্যশালায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আইটিআইয়ের সম্মানিত সভাপতি রামেন্দু মজুমদুর, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সেক্রেটারি জেনারেল আকতারুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠনের সভাপতি তাসনীন হোসাইন তানু। অতিথিদের কাছ থেকে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। সেলিম আল দীনের পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ কুমার আগরওয়াল। সম্মাননা প্রাপ্তি অনুভূতি ব্যক্ত করে সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, এ সম্মাননা গ্রহণ করতে এসে মনে হচ্ছে, আজ বোধ হয় আমার হিসাব নেবার দিন। এই প্রাপ্তির মাধ্যমে দায়িত্বটি আরও বেড়ে গেল। ১৯৭৪ সালে যখন নাট্যচর্চা শুরু করেছিলাম তখন এ নিয়ে খুব বেশি কিছু ভাবিনি। এখন মনে হচ্ছে, আরও অনেক কিছু দেয়ার আছে আমার। অনুভূতি প্রকাশের এ পর্যায়ে এসে নবীন নাট্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের দিকে না তাকিয়ে তরুণ প্রজন্মকে নিজেদের পথ নিজেদেরই তৈরি করে নেয়া উচিত। আজকে যারা এই মঞ্চে বসে আছেন, সূচনালগ্নে তাদের সামনে কোন পথ ছিল না, তারা সবাই নিজস্ব পথ তৈরি করে নিয়েছেন। সেভাবেই তরুণদের নিজেদের পথ নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হবে। সম্প্রীতির স্বদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাজাত বাংলাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে কারো পরিচয় নির্ণীত হতে পারে না। মানুষের পরিচয়কে ছাপিয়ে মুসলমানের পরিচয় বড় হয়ে উঠতে পারে না। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার সেই প্রেক্ষাপটে বাহাত্তরের সংবিধান অনুসরণ করে নাট্যচর্চার মাধ্যমে সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে দেখতে চাই। উদ্বোধনী বক্তব্যে শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, মঞ্চনাটক হচ্ছে জীবন্ত, প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী শিল্প-মাধ্যম। যে কোন বার্তা জনগণের কাছে সহজেই বার্তা পৌঁছে দেয় মঞ্চনাটক। আমাদের দেশের মঞ্চনাটকের অবস্থান নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পারি। অন্য অতিথিদের বক্তব্যে রাজধানীতে আরও বেশি মঞ্চ নির্মাণের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে স্পিকার বলেন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করাটা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলে এটা সম্ভব বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করছেন। তিনি এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন বলেও তিনি আশা করেন। রামেন্দু মজুমদার বলেন, আজকের সম্মাননাপ্রাপ্ত দুই নাট্যজনের এক জায়গায় মিল রয়েছে। এই দু’জনের হাত ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ চালু হয়েছিল। বর্তমানে দেশে একটি শিল্পকলা নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত। সেখানে চারু ও কারুকলাসহ যুক্ত হবে সকল পারফর্মিং আর্ট। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মঞ্চস্থ হয়েছে দুটি নাটক। জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় প্রাচ্যনাটের নাটক ‘সার্কাস সার্কাস’। প্রযোজনাটি রচনার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছেন আজাদ আবুল কালাম। নাটকের কাহিনীতে দেখা যায়, দ্য গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস দল বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। সমস্যা আরও ঘনীভূত হয় যখন মৌলবাদের কালো থাবা এসে পড়ে দলের ওপর। স্থানীয় ধর্মীয় প্রভাবশালী নেতারা সার্কাস শো বন্ধ করার জন্য হুমকি দেয়। এসব ঘিরে দলের ভেতরেও কলহ বেড়ে যায়। এক সময় ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা দ্য গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। লাশ পড়ে তিন খেলোয়াড়ের, ভস্মীভূত হয় সার্কাসের সব পশু। এভাবেই এগিয়ে যায় নাটকটি। প্রযোজনাটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাখাওয়াত হোসেন রেজভী, শতাব্দী ওয়াদুদ, জাহাঙ্গীর আলম, শাহনাজ জেরিন সাত্তার, নরুবাইয়া মঞ্জুর, শাহানা রহমান রুমিসহ অনেকে। নাট্যশালার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মণিপুরি থিয়েটার মঞ্চস্থ করে ‘ইঙাল আঁধার পালা’। একজন মণিপুরি মৃদঙ্গ বাদকের করুণ কাহিনীকে উপজীব্য করে নাটকটি রচনার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছেন শুভাশিস সিনহা। এটি একইসঙ্গে বাংলা ও মণিপুরি বিঞ্চুপ্রিয়া ভাষায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। প্রযোজনাটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিনহা, উজ্জ্বল সিংহ, অরুণা সিনহা, স্বর্ণালী সিনহা, শ্যামলী সিনহা, সুজলা সিনহা প্রমুখ। আজ শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এদিন বিকেল সাড়ে চারটা থেকে নাট্যশালার বহিরাঙ্গনে শুরু হবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সন্ধ্যায় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হবে পদাতিক নাট্য সংসদের নাটক ‘গুণজান বিবির পালা’ এবং এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে দেশ নাটক মঞ্চস্থ করবে ‘নিত্যপুরাণ’।
×