ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজান হামলায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করে সাগর

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৬ এপ্রিল ২০১৮

হলি আর্টিজান হামলায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করে সাগর

শংকর কুমার দে ॥ বহুল আলোচিত গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছিল বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী সন্দেহভাজন আসামি হাদিসুর রহমান সাগর। বৃহস্পতিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। দুই দফা রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার সাগরকে আদালতে হাজির করার পর স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে সম্মত হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জবানবন্দী রেকর্ড করেন ঢাকা মহানগর হাকিম গোলাম নবী। জবানবন্দীতে তদন্ত সংস্থা সিটিটিসির কাছে সাগর বলেছে, গত বছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কাছাকাছি গিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পœ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মন্ত্রী, এমপিসহ শতাধিক মানুষ হত্যার পরিকল্পনা করেছিল তারা। সাগর পুরনো জেএমবি’র সদস্য। ২০১৪-১৫ সালে তামিম চৌধুরীর হাত ধরে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয় সে। নব্য জেএমবিতে সে বোমা তৈরির কারিগর হিসেবেও পরিচিত ছিল। গুলশান হামলার পর থেকে নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল হাদিসুর রহমান সাগর। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তদন্ত সংস্থার সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, দুই দফা রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার সাগরকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। সাগর স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম গোলাম নবী তার জবানবন্দী রেকর্ড করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সন্ত্রাস দমন আইনে দায়ের করা এ মামলায় গত ২২ মার্চ সাতদিন এবং ৩০ মার্চ পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গী নেতা এবং অস্ত্র সরবরাহকারী হাদিসুর রহমান সাগর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। গত ২১ মার্চ রাতে সংবাদের ভিত্তিতে শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক এলাকায় অভিযান চালিয়ে হাদিসুর রহমান সাগর ও আকরাম হোসেন নিলয় নামের নব্য জেএমবির শীর্ষ দুই জঙ্গীকে গ্রেফতার করে বগুড়া জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গ্রেফতারের পরপরই তাদের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। হাদিসুর রহমান সাগর গুলশান হলি আর্টিজান জঙ্গী হামলায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করার ঘটনায় তাকে খুঁজছিল পুলিশ। কে এই সাগর ॥ হাদিসুর রহমান সাগর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত জঙ্গীনেতা নুরুল ইসলাম মারজানের ভগ্নিপতি। রাশেদসহ গ্রেফতার হওয়া শীর্ষ জঙ্গীদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে সাগরের সম্পর্কে বিস্তর তথ্য পেলেও ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে তাকে এতদিন ধরতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। জঙ্গী সাগর অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। সে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সংগঠনের কাউকে কোন সঠিক তথ্য দিত না। যোগাযোগ রক্ষার এ্যাপস ব্যবহারেও বিশ্বাসী নয় সে। তাই সাংগঠনিক কাজে সবার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। ঘনঘন অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে এই জঙ্গী নেতা এখনও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাজশাহীতে সাগরের সহযোগী হিসেবে যারা জেএমবিতে এসেছে তাদের অনেকে আগে শিবিরের কর্মী ছিল। ধূর্ত এই জঙ্গীর প্রকৃত নাম হাদিসুর রহমান, সাগর তার সাংগঠনিক নাম। তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলায়। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আরেক পরিকল্পনাকারী নূরুল ইসলাম মারজানের ভগ্নিপতি এই সাগর। মারজানের বাড়ি পাবনায় হলেও তারা কুষ্টিয়ার সীমান্ত এলাকায় থাকত। এই সুবাদে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও ঝিনাইদহে তার যাতায়াত ছিল। গুলশান হামলার আগে ঝিনাইদহে থাকা জঙ্গীদের আস্তানায় গিয়েছিল সাগর। সাগর পুরনো জেএমবির সদস্য ছিল। ২০১৪ সালে সে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। একপর্যায়ে নব্য জেএমবির শূরা সদস্য মনোনীত হয়। দায়িত্ব ছিল উত্তরাঞ্চলে। ভারতের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহের কাজ করতো সে। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো রাশেদ ও ছোট মিজানের কাছে দেয় গ্রেফতার হওয়া দুর্ধষ এই জঙ্গী সাগরই। সাগরের নেতৃত্বে জঙ্গী হামলার প্রস্তুতি ছিল ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসে ধানমন্ডির ৩২ নং রোডের জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য ও মাল্যদান উপলক্ষে জমায়েত হওয়া মন্ত্রী, এমপিসহ শত শত জড়ো হওয়া মানুষজনের মধ্যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল গ্রেফতার হওয়া দুই জঙ্গী সাগর ও নিলয়ের নেতৃত্বে জঙ্গীরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ আগস্টের আগে রাজধানীর পান্থপথের হোটেল ওলিও-তে অবস্থান নেয় নব্য জেএমবির জঙ্গীরা। নব্য জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য সাইফুলের পরিকল্পনায় ছিল যে কোনও উপায়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কাছাকাছি গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো। এজন্য বেশ বড় আকারের একটি বোমা তৈরি করে সাইফুলের হাতে পৌঁছে দিয়েছিল তার সহযোগী জঙ্গীরা। এই ঘটনায় বোমা তৈরির কারিগর এবং অর্থ সরবরাহকারীসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম-সিটিটিসি ইউনিট। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে আটজন ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সর্বশেষ মোহাম্মদ তাজুল ওরফে ছোটন নামে এক জঙ্গীকে গত ১৬ মার্চ গ্রেফতারের পর তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিটিটিসি। এরপর গত ২১ মার্চ বগুড়ায় গ্রেফতার করা হয় সাগর ও নিলয়কে। এর মধ্যে সাগর বৃহস্পতিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করতে গিয়ে ধরা পড়ে ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসির সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নং রোডের জাদুঘরে হামলার আগেই সিটিটিসি’র অভিযানে পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের একটি কক্ষে নিজেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয় জঙ্গী সাইফুল। ওই ঘটনায় রাজধানীর কলাবাগান থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে গ্রেফতার করা আট জনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, কারা, কেন এবং কী উদ্দেশে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল, তার পুরো ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এমনকি কারা অর্থ সরবরাহ করেছিল, তাও জানা গেছে। হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনাল কক্ষের আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার ঘটনার তদন্তের শেষ পর্যায়ে এসে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী দুর্ধষ জঙ্গী হাদিসুর রহমান সাগর ও পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার অর্থ যোগানদাতা নিলয় গ্রেফতার হয়। এই দুই দুর্ধষ জঙ্গীর নেতৃত্বেই গত ১৫ আগস্টে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাদুঘরে জাতীয় শোক দিবসে সমবেত হওয়া মন্ত্রী, এমপিসহ শতাধিক মানুষজনকে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। গ্রেফতার হওয়ার আগে তারা দুই জনেই গ্রেফতার হওয়ার আগে আবার নতুন করে নব্য জেএমবি জঙ্গী সংগঠনটি সংগঠিত করছিল বলে সিটিটিসির দাবি। গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনা ॥ হাদিসুর রহমান সাগরকে নিয়ে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার মামলায় এই পর্যন্ত সাত জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। সাগরকে নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদানকারী জঙ্গীর সংখ্যা দাঁড়ালো ছয় জনে। হামলায় জড়িত যাদের বিভিন্ন অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ‘রাজীব গান্ধী’, রাশেদুল ইসলাম রাশেদ ওরফে র‌্যাশ, রাকিবুল হাসান রিগান, সোহেল মাহফুজ। হলি আর্টিজান বেকারিতে সশস্ত্র হামলাকারী পাঁচজনই কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছিলেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন আসামিদের মধ্যে তামিম চৌধুরী, বাশারুজ্জামান চকলেট, ছোট মিজানসহ কয়েকজন মারা গেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকেও এই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এখনও কারাগারে রয়েছেন। তবে তার সম্পৃক্ততার বিষয়ে এখনও স্পষ্ট কিছু বলেনি পুলিশ।
×