ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখ বরণের আয়োজন গাঁও-গেরামে হালখাতা শুরুর তোড়জোড়

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৬ এপ্রিল ২০১৮

বৈশাখ বরণের আয়োজন গাঁও-গেরামে হালখাতা শুরুর তোড়জোড়

সমুদ্র হক ॥ দিন কয়েক আগের শীতল চৈত্র এই সময়টায় রোদের তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই গাঁও-গেরামে বর্ষ বরণের আয়োজনকে মোটেও দমাতে পারেনি। গ্রামে চৈত্র শেষের দিনগুলোকে আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করার সঙ্গেই নতুন বছরে জীবনের হালখাতা খোলার তোড়জোর শুরু হয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তির অধ্যায়ে সব ধর্মের মানুষের মিলন মেলা টেনে নিয়ে যায় বৈশাখের সম্প্রীতির উৎসবে। এই মেলা পরিণত হয় মানব জীবনের এক বন্ধনহীন অবারিত মিলনমেলায়। চৈত্রের শেষের দিনগুলোতে কৃষক ফসলের মাঠে গিয়ে রোদেলা দুপুরে পরিচর্যার পর ঘাম ঝরা শরীর এলিয়ে দিচ্ছে কোন গাছের ছায়ায়। গাঁয়ের বধূদের বৈশাখ বরণের পালা শুরু হয়েছে। ঘরের চারধারে মাকরসার জালসহ যা ময়লা আছে তা পরিষ্কার করা হচ্ছে। গ্রামে এখন সেদিনের সেই কুঁড়েঘর নেই। কোন বাড়ি পাকা, কোন বাড়ি টিনের চালায় আধাপাকা, কোন বাড়ি টিনে ছাওয়া। পাকা আধাপাকা বাড়ির মেঝে পাকা। পাকা মেঝেও ধোয়া মোছা হচ্ছে। কাঁচা মেঝে ও বাড়ির উঠান এবং আঙিনায় মাটি ছেনে কাদা করে পানির মধ্যে গুলে লেপার কাজ চলছে। বাঙালী নদী তীরের রানীরপাড়া গ্রামের ক’জন কৃষক বধূ বললেন বৈশাখ মাসের আগের দিনও এই লেপা মোছার কাজ চলবে। আঙিনা ও খুলি (বহিঃআঙ্গিনা) লেপে একেবারে ঝকঝকে তকতকে করা হচ্ছে। ঘরের বিছানাপাতি সব ঝেরে পরিষ্কার করা হচ্ছে। কুয়ার (খাবারসহ গৃহস্থালি কাজের পানির আধার) পাড় লেপে দেয়া হচ্ছে। কলের পাড় (টিউবওয়েলের পাড়) পরিষ্কার। মোট কথা বৈশাখী আনন্দ পেতে ঘরদোয়ার ঝকঝকে রাখতে যা করা দরকার তাই হচ্ছে। মনে হবে যেন ঈদের আনন্দের পালা শুরু হয়ে গেছে। বাঙালীর ঐতিহ্য মাটির হাড়িতে রান্না। মাটির হাড়ি পাতিলে রান্না করা ভাত তরকারির স্বাদই আলাদা। রানীরপাড়ার গেরস্তবধূ ফেরদৌসী বললেন, মাটির পাতিলে উপকরণ বসিয়ে খড়ির চুলায় রান্নার পর যে স্বাদ সিলভারের পাতিলে গ্যাসের চুলার রান্নার সেই স্বাদ হয় না। নববর্ষের দিনে গ্রামের মানুষ মাটির পাতিলে ভাত রেধে সেই ভাত পান্তা করে রাখে। পরদিন সকালে সেই পান্তা নুন কাঁচা লঙ্কা দিয়ে খাওয়ার যে কী স্বাদ জিহ্বায় লেগে থাকে। গ্রামে মাটির হাড়ি পাতিলে বৈশাখের রান্নার রেশ হালে নগরীর অনেক বাড়িতে বৈশাখী উৎসবকে ঘিরে রান্নার ধরন পাল্টেছে। নগরীর অনেক গৃহিণী বৈশাখী রান্নার প্রস্তুতিতে মাটির হাড়ি পাতিল কিনছে। মনে হবে ফিরে আসছে বৈশাখী বরণের ঐতিহ্যের সেই দিনগুলো। নববর্ষে আসে ইলিশ মাছে পান্তা ভাত। হালে গ্রামেও যাচ্ছে ইলিশ। গ্রামে নগরীতে ইলিশ পান্তার আমেজ যেন ফুরোয় না। গ্রামের তরুণী ও বধূরাও এই দিনে নতুন শাড়ি বা তোলা শাড়ি পরে (যে শাড়ি ভাল কোন আয়োজনের জন্য রাখা হয়)। বর্তমানে গ্রামেও বৈশাখ বরণের লালপেরে সাদা শাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। গ্রামের বড় কোন গাছের নিচে জটলা পেকে আনন্দ করা হয়। এরই মধ্যে দেখা যায় কুলা ধামা ডালায় ফুল নিয়ে বধূ ও তরুণীরা নৃত্যের তালে গীত গেয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে চাল ডাল লাউ কদু পয়সা কড়ি যা পাচ্ছে তা সংগ্রহে নিচ্ছে। বৈশাখে ভূড়িভোজের আয়োজন হবে এইসব দিয়ে। গীতের কথাগুলো এ রকম- ‘আইলাম গো বর মাগনে/চাউল ডাইল বাইর কর/চাউল না দিলে দিবাইন কড়ি, না দিলে অইবো লড়িদড়ি/ সোনার মুড়ুক হাতে ডালা/এই ঘর দেখতে ভালা/ ঘর ভালো আটুনির/গিরতাইন ভালো রাঁধুনীর/ ও গিরতাইন সুনাভান আমগো দিবাইন কিবা দান।’ এই গীতের অর্থ কি তা বোঝা একটু কঠিন। তবে কয়েক শব্দ শুনে বোঝা যায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের এই গীত আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে বিভিন্ন অঞ্চলে গীত হচ্ছে। গীত গাইয়েদের গীত শুনে আশপাশের বাড়ির মহিলারা যোগ দেয়। অনেক বয়স্ক মহিলা তাদের তারুণ্যের কথা মনে করে নেচে ওঠে। এ সময় আরেক আনন্দ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। এ থেকে বোঝা যায় বৈশাখী বরণের রেশ কতটা বিস্তৃত....। স্যার চার্লস মেটকাফ প্রায় সোয়া শ’ বছর আগে তার ‘টু এলিট অব দ্য মুঘলস’ বইয়ে লিখেছেন ‘বাংলার প্রতিটি গ্রামই যেন একেকটি রিপাবলিক। যার যা প্রয়োজন তা গ্রামেই পাওয়া যায়। তারা আপনাতে আপনি পূর্ণ।’ বৈশাখ বরণের সকল আয়োজন হৃদয় থেকে উৎসারিত-যা থাকে হৃদয়ের মণিকোঠায়।
×