ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে শরিকদের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস দানা বাঁধছে

বিএনপি জোটে ফের ভাঙ্গনের সুর

প্রকাশিত: ০৫:০১, ৬ এপ্রিল ২০১৮

 বিএনপি জোটে ফের ভাঙ্গনের সুর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০ দলীয় জোটে আবারও সন্দেহ ও অবিশ্বাস দানা বাঁধছে। বিশেষ করে নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি এবং জোটের শরিকরা সমান গুরুত্ব না পাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে জোটের শরিকরা ইতোমধ্যে বিএনপির প্রতি প্রকাশ্যেই ক্ষোভ ব্যক্ত করছেন। জোটের শরিকরা বিএনপি নেত্রী কারাগারে থাকা অবস্থায় আসন ভাগাভাগির নিশ্চয়তা পেতে চায়। এ অবস্থায় আবারও ২০ দলীয় জোটের ভাঙ্গনের সুর বেজে উঠছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই অবস্থায় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি বড় ধরনের বেকায়দার সম্মুখীন হতে পারে। একদিকে বিএনপি নেত্রী কারাগারে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না। জোটের শরিকদের আবদার মিটাতে বিএনপি নেতাদের হিমশিম খেতে হবে। আবার এই মুহূর্তে জোটের শরিকদের আবদার মেটাতে না পারলে জোট ভাঙ্গনের মুখে পড়তে পারে। তারা মনে করেন খালেদা জিয়াবিহীন বিএনপি নেতাদের বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়া বিএনপির জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এমনকী দলে বিশৃঙ্খলাও দেখা দিতে পারে। কারণ বিএনপি নেত্রী ছাড়া এই মুহূর্তে জোটের আবদার রক্ষা করা বিএনপি নেতাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। জোটের শরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এই মুহূর্তে তারা বিএনপি নেত্রীর মুক্তির কোন সম্ভাবনা দেখছেন না। কবে মুক্তি পাবেন তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। অথচ নির্বাচন কবে হবে তা সবাই জানে। নির্বাচন এগিয়ে আসছে। অথচ বিএনপি নেতারা নেত্রীর মুক্তি নিয়েই বেশি ব্যস্ত রয়েছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে তার মুক্তির এক ধরনের প্রস্তুতি সেরে ফেলছেন বিএনপি নেতারা। অপর দিকে জোটের শরিকরা এই অবস্থায় বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা উল্লেখ করেন বিএনপি অনেক পুরনো দল। দলে অনেক অভিজ্ঞ নেতা রয়েছেন। যারা একাধিকবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এ বিষয়ে তারা যথেষ্ট অভিজ্ঞ। তাই নির্বাচন তাদের কাছে অনেকটাই সহজ। কিন্তু জোটের শরিকরা যারা নতুন নির্বাচন করতে চান তাদের আগে থেকে প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। এ অবস্থায় আগে থেকে যদি নিশ্চয়তা পাওয়া যেত তাহলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতেও সুবিধা হতো। তাছাড়া তারা মনে করছেন খালেদা জিয়া কবে মুক্তি পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। নির্বাচন সামনে রেখে দরকষাকষিরও সুযোগ নেই। তারা জানান, খালেদ জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগেই জোটের এক বৈঠকে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু তা আর বেশি দূর এগোয়নি। কেননা আসন ভাগাভাগির দরকষাকষি এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই এখন থেকে এই দরকষাকষি শুরু না হলে পরে বঞ্চনার শিকার হতে পারেন বলে মনে করছেন তারা। এই অবস্থায় খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার আগেই আসন ভাগাভাগির বিষযটি মীমাংসা করতে চান তারা। তবে জোটের শরিকদের এই অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি বলছে জোটে কোন ভাঙ্গন নেই। এটা আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র। বিএনপি নেত্রী কারাগারের যাওয়ার পর থেকে সরকার বিএনপির মধ্যে ভাঙ্গন ধরাতে চেয়েছে। চেষ্টা করেও তারা বিএনপির মধ্যে ভাঙ্গন বা ফাটল ধরাতে পারেনি। এখন জোটের মধ্যে ভাঙ্গন ধরাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত সরকার এখানেও সফল হবে না। কারণ জোটের মধ্যে বড় ধরনের কোন দূরত্ব তৈরি হয়নি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ২০ দলীয় জোটের শরিক এলডিপির পক্ষ থেকে সংসদ নির্বাচনে সংসদীয় আসন বণ্টনে এখনই বিএনপির প্রতি আহ্বান জানান হয়েছে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ অডিটরিয়ামে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির ঢাকা মহানগর উত্তর আয়োজিত সম্মেলনে দলের মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ এ আহ্বান জানান। ড. রেদোয়ান বলেন, বিএনপিকে অনুরোধ করব, নিবন্ধিত ৮টি দলের সঙ্গে আলোচনা করুন। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে তাদের সঙ্গে সাময়িক আলোচনা করে আসন বণ্টন করুন। তিনি আরও বলেন, আমাদের নেতা কর্নেল অলি আহমেদ, জেনারেল (অব) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম (বীর প্রতীক), জামায়াত ও খেলাফত মজলিসের নেতাদের সঙ্গে বসে যার যেখানে নির্বাচন করার মতো প্রার্থী আছে সেটা ক্লিয়ার করে দেন। তাহলে আর কোন দ্বন্দ্ব থাকবে না। এলডিপির যারা প্রার্থী আছে ও জোটের প্রার্থী আছে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয় না, হয় বিএনপির সঙ্গে। আসন বণ্টন হলে আমাদের চলার পথ সুগম হবে। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালে ইব্রাহিম বীরপ্রতীককে মহাজোট থেকে বলা হয়েছিল ১০ জন এমপি ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করে রাখা হবে। আমরা তখন বলেছিলাম, আমরা জাতীয়তাবাদী শক্তি বিএনপির সঙ্গে আছি, এখান থেকে যেতে চাই না, মন্ত্রিত্ব চাই না। অলি আহমেদ বলেন, জোটের শরিকদের প্রতি যথাযথ সম্মান না দেখালে ঐক্য ভেঙ্গে যাবে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে উদাহরণ টেনে বলেন, একটা মানুষ যদি বিয়ে করে বউকে ৫০ তোলা স্বর্ণও দেয়, দুই লাখ ভরি স্বর্ণও দেয় কিন্তু তার প্রাপ্ত সম্মান না দেয় তাহলে সেই স্ত্রী তার ঘর করবে না। একই ভাবে একজন পুরুষকে যদি সম্মান করা না হয় সেও একসঙ্গে বসবাস করতে পারে না। প্রত্যেকের একটা নিয়ম নীতির মধ্যে থাকতে হবে। এ বিষয়ে বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ২০ দলীয় জোটর ভাঙ্গার জন্য সরকার নীল নকশা করছে। জোট বেগম জিয়ার নেতৃত্বেই নির্বাচনে যাবে। অন্যথায় নয়। জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল অব সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক আসন ভাগাভাগি এবং সমান গুরুত্ব না পাওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অবশ্য তিনি বলেন, ২০ দলীয় জোটের মধ্যে ভাঙ্গনের কোন সুর নেই। তিনি বলেন, জোটের মধ্যে উষ্মা থাকলেও তা বড় ধরনের কিছু নয়। কিন্তু বিয়য়টা হলো তাগাদা দেয়া বলা যায়। জোটের একত্রিত রয়েছে। জোটের কোন ভাঙ্গন নেই। বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় জোট নির্বাচনে যাবে না। আমাদের আগেই জোটের এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখনও এই সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। তিনি বলেন, গত তিন বছরে অনেকে জোট ছেড়ে চলে গেছে। অথবা ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বর্তমানে একটি নাজুক পরিস্থিতি চলছে। বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় সরকার আন্দোলন করতে দিচ্ছে না। নাজুক এই পরিস্থিতিতেই জোটের ওপর আক্রমণ আসার আশঙ্কা রয়েছে। আক্রমণকারী হলো সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী, সরকারের রাজনৈতিক কূটকৌশল প্রণয়নকারীরা। আর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলো বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন শরিক দল। তবে তিনি উল্লেখ করেন ২০ দলীয় জোটর শরিক দলগুলো নির্বাচনমুখী দল। বিএনপি নেত্রী কারাগারে যাওয়ার আগেই আসন ভাগাভাগির বিষয়ে আলোচনা উঠেছিল কিন্তু তখন এ বিষয়ে আর আলোচন হয়নি। তবে আলোচনা হয়নি বলে হবে না। তা তো নয়। ২০ দলীয় জোটের প্রধান দল হিসেবে বিএনপি আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই প্রতিশ্রুতির ওপর আমরা এখনও আশা রাখি। এই প্রতিশ্রুতি আদায় করতে জোটের শরিক দলগুলো বদ্ধপরিকর। তিনি বিএনপি নেত্রী কারাগারে থাকা অবস্থায় আসন ভাগাভাগির তাগাদার বিষয়ে বলেন, আলোচনা করতে সময় লাগতে পারে। বিএনপি আওয়ামী লীগের যারা দীর্ঘদিন ধরে যারা রাজনীতি করছে, অতীতে একাধিক নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তারা অনেক অভিজ্ঞ। আর যাদের এই অভিজ্ঞতা আছে তাদের জন্য পথ পাড়ি দেয়া সহজ। কিন্তু জোটের শরিকদের অনেকের এই অভিজ্ঞতা নেই। তাই তাদের প্রস্তুতি নিতে সময়ের দরকার হয়। এর মানে এই নয় যে আমরা বিএনপি নেত্রীকে অবজ্ঞা করছি। বিএনপি নেত্রীবিহীন নির্বাচনের কথা ওঠে নাই। তিনি বলেন, এলডিপির সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনায় এটা উঠে এসেছে যে জেটের প্রার্থীদের যদি আগ থেকে ধারণা দেয়া হয় তাহলে জোটের অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে। এ ছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন বিএনপির প্রার্থীরাও আন্দোলনের মাধ্যমে এক ধরনের আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবশ্য জোটের ভাঙ্গন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস মনে করছেন এটা সরকারের ষড়যন্ত্র। বিএনপি নেত্রী কারাগারের যাওয়ার পর থেকে তারা বিএনপিকে ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। এখন জোট ভাঙ্গার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। বেসরকারী একটি টেলিভিশনের সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ২০ দলীয় জোটের ভাঙ্গনের সুর শোনা যাচ্ছে এমন ‘বেসুরো সুর’ শুনি নাই। ২০ দলীয় জোটের ভাঙ্গার কোন আভাস পায়নি। জোটের ভাঙ্গন নিয়ে কোথাও এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। বিএনপি নেত্রী কারাগারে রয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে রয়েছেন। দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে দল ভাঙ্গার চেষ্টাও করা হচ্ছে। তিনি বলেন বিএনপির ভাঙ্গনের ক্ষমতা এই সরকারের নেই। এমনকী ২০ দলীয় জোটের ভাঙ্গনের আশঙ্কাও নেই উল্লেখ করেন। শুধু এবার নয়। এর আগেই ২০ দলীয় জোটের সমান গুরুত্ব না পাওয়া এবং ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অনেকে জোট করার পর ছেড়ে চলে গেছে। জোটের অন্যতম শরিক দল ইসলামী ঐক্যজোট আগেই জোট ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমান সময়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কও তত ভাল নয়। তারা জোট ছাড়ার ঘোষণা না দিলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে বলে জানা গেছে। ইসির জামায়াতের নিবন্ধন না থাকলেও আগামী নির্বাচনে তারা বিএনপির ঘাড়ে চড়ে বৈতরণী পার হতে চায়। এ জন্য তারা বড় ধরনের টার্গেট নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে বনিবনা না হলে জামায়াত জোট ছেড়ে চলে যেতে পারে বলেও আভাস পাওয়া গেছে। সূত্র জানায় জামায়াত চলে গেলে জোট ত্যাগ করবে তাদের অনুসারী আরও ক’টি ইসলামী দল। এর ফলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন সামনে রেখে আবারও বড় ধরনের ভাঙ্গনের মুখে পড়তে পারে।
×