ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশ বিপর্যয়

মরে গেছে বাগেরহাটের ২৩ নদী

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ৬ এপ্রিল ২০১৮

মরে গেছে বাগেরহাটের ২৩ নদী

বাবুল সরদার, বাগেরহাট ॥ সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে হারিয়ে যাচ্ছে ২৩টি নদী। এর অধিকাংশই মরে গেছে। এখন আর লঞ্চ-স্টিমার ও কার্গো ভ্যাসেল চলতে পারছেনা। যা দুই/চারটার অস্তিত্ব আছে, সেগুলোর অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে ভাটার সময় হাঁটু পানিও থাকে না। শুকিয়ে যাওয়া এসব নদী দেখে এ জনপদের মানুষ এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। স্মৃতিতে খুঁজে ফেরেন উত্তাল প্রমত্তা এসব নদ-নদী। এ জেলায় পলি জমে মরে যাওয়া ২৩টি নদী হচ্ছে পুঁটিমারী, বিশনা, দাউদখালী, মংলা, ভোলা, ঘষিয়াখালী, কালিগঞ্জ, খোন্তাকাটা, রায়েন্দা, বলেশ্বর, ভৈরব, তালেশ্বর, ভাষা, বেমরতা, দোয়ানিয়া, কুচিবগা, ছবেকী, রাওতি, বেতিবুনিয়া, কলমী , দোয়ানিয়া, যুগীখালী, কুমারখালী, কালীগঙ্গা ও চিত্রা নদী। এছাড়া অতিরিক্ত পলি জমে এবং অবৈধ বাঁধের কারণে মরে গেছে বাগেরহাটের দুই শতাধিক ছোট-বড় খাল। এসব নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে একদিকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবন্দর মংলার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন চলছেনা ঢাকা-খুলনা স্টিমার ও ঢাকা-বাগেরহাট লঞ্চ সার্ভিস। অন্য দিকে নদী, খাল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে কৃষকরা চাষাবাদ করতে শুস্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেনা। আর বর্ষা মৌসুমে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার। প্রতি বছরই কৃষকের ফসল, রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে নষ্ট হচ্ছে। বাড়ছে পরিবেশের বিপর্যয়। মরে যাচ্ছে গাছপালা। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ প্রকৃতি। এ জেলায় লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি ও খালে বেড়ি বাঁধ দিয়ে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের ফলে ফসলি জমিতে স্বাভাবিক জোয়ারের পানি উঠতে পারছেনা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৫টি পোল্ডারের ১৬৫ টি স্লুইস গেটে সরকারীভাবে কোন লোকবল নিয়োগ না থাকায় ভাটার পানি নামার সময় ফাপগেট (স্লুইস গেটের নিচের অংশ) গুলো সব সময় বন্ধ থাকায় ভরাট হয়েছে নদী। অন্য দিকে ফারাক্কা বাঁধের কারণে এসব নদী উজানের পানি না আসার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে জোয়ারের পানি স্থির হয়ে থাকায় অতিরিক্ত পলি জমেও ভরাট হয়ে গেছে নদী-খাল। এ কারণে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি দ্রুত ভাটায় নেমে যেয়ে ফসলি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে। হ্রাস পাচ্ছে ফসলি জমির উর্বরতা শক্তি। প্রকৃতি ও কৃষিতে বিবর্ণতার ছাপ পড়েছে। বাগেরহাটে অতিরিক্ত পলি জমে শুকিয়ে যাওয়া নদী ড্রেজিং ও খননের বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মাঈনুদ্দিন, জানান মংলা বন্দর থেকে ঘষিয়াখালী চ্যানেল হয়ে বন্দরের সঙ্গে সহজ যোগাযোগের এই রুটটি সচল রাখতে রামপাল উপজেলা সদর হয়ে দাউদখালী নদীতে এবছর ড্রেজিং করা হয়েছে। জুনে এই চ্যানেলটি খুলে দেয়া হবে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিয়া হায়দার বলেন, নদী খাল ভরাট হওয়ার ফলে দেশী প্রজাতির মাছ উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। অপর দিকে সমুদ্রের লোনা পানিবদ্ধ হয়ে দেশী সরপুঁটি, পাবদা, শিং, মাগুর, ফোলই, খৈলশা, গজাল, চুচড়া, চান্দা, রয়ভেদাসহ এ অঞ্চলের অর্ধশত প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে। জেলা কৃষি অধিদফতরের উপ পরিচালক আবতাব উদ্দিন জানান, সেচ মৌসুমে নদীখালে পানি না থাকায় এবং জলাবদ্ধতার কারণে কৃষি ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য মিলছে না। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, নদীখাল আমাদের জীবন ও সভ্যতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। জনস্বার্থে মরতে বসা নদীখাল দ্রুত পুনঃখননের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে রামপাল-মংলা বৃহত্তর ড্রেজিং ও পুনঃখননের মাধ্যমে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের নাব্য ফিরিয়ে আনা হয়েছে। জেলাব্যাপী এ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। নরসুন্দায় ধান চাষ সংবাদদাতা নান্দাইল ময়মনসিংহ থেকে জানান, এক সময় প্রবহমান নদী ছিল। চলত পালতোলা নৌকা। কিন্তু এখন নিশ্চিহ্ন সেই নদী। নেই পূর্বের জৌলস। যে নদীতে পণ্যবোঝাই ট্রলার চলত সেই নদীতে এখন চাষ হয় ধান। ধীরে ধীরে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে নান্দাইলের নরসুন্দা নদী। নদী যেটুকু রয়েছে তা এখন দখল ও দূষণের কবলে। এই অবস্থায় পরিবেশ রক্ষায় নদীটি আগের রূপে ফেরানোর দাবি সাধারণ মানুষের। এদিকে পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নদীর তলদেশে পলিমাটি জমে ভরাট হতে হতে এখন অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। নদীতে পানি না থাকার কারণে নদীসংলগ্ন এলাকার জমিতে খরা মৌসুমে তেমন আবাদ হচ্ছেনা। প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকরা। আবার প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নদীতে প্রচুর পানি আসে। তখন বন্যার পানিতেও কৃষকের সহস্র একর আবাদি জমির ফসল নষ্ট হয়। এতে দেশের প্রচুর পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়। অথচ এক সময় এসব নদীর বুকে নৌকা চলত, নৌকায় করে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে দূর-দূরান্তে যেতেন। নদীর পতিত জমিতে কৃষকরা চাষাবাদ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অথচ পানিশূন্য নদীর বুকে পলিমাটি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পড়েছে। যদি মাটি খনন করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হয়, তাহলে খরা মৌসুমেও কৃষকরা উপকৃত হবেন। পাশাপাশি অঞ্চলটির জনসাধারণ আর্থসামাজিকভাবে লাভবান হবে। রক্ষা পাবে পরিবেশ। নরসুন্দা নদীর কাছে গিয়ে দেখা যায়, এক শ্রেণীর দখলদার ইচ্ছেমত নদীর দু’পাড় দখল করে ধান চাষ করছে। উৎপাদিত হচ্ছে ধান। এতে দখলদাররা লাভবান হলেও সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব। কিন্তু নরসুন্দা পাড়ের মানুষেরা চায় নদী খনন। যেখানে চাষ হবে রুপালি মাছ। উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরবে সবাই। দু’পাড়ের লক্ষাধিক কৃষক মৌসুমি ফসল ফলাতে জমিতে পানি সেচ দিতে চায় নরসুন্দা থেকে। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার গাজী আব্দুস সালাম (বীর প্রতীক) বলেন, দিনে দিনে নরসুন্দা নদী তার নাব্য হারিয়ে ফেলেছে। এতে নষ্ট হচ্ছে নান্দাইলের পরিবেশ। প্রশাসনের হস্তক্ষেপ না থাকায় প্রতিনিয়ত প্রভাবশালী ও দু’পাড়ের মানুষ ইচ্ছে মতো দখল করে নিচ্ছে।
×