ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী ব্যাংক ॥ সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৬ এপ্রিল ২০১৮

বেসরকারী ব্যাংক ॥ সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন

দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার ফল কী হয় তার সাক্ষাত প্রমাণ হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের জন্য কতিপয় জরুরী সিদ্ধান্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি তার রুটিন দায়িত্ব পালন করত তাহলে এসব অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত আজ নিতে হতো না। যেসব সিদ্ধান্তের কথা আলোচনার বিষয় আজ সেগুলো হচ্ছে : ‘সিআরআর’ (ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট) হ্রাসকরণ, ‘রেপো’ হার হ্রাসকরণ এবং সরকারী আমানত বেসরকারী ব্যাংকে সংরক্ষণের হার বর্ধিতকরণ। বর্তমানে দেশের প্রত্যেকটি তফসিলী ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবশ্যকীয়ভাবে তাদের স্ব-স্ব ব্যাংকের আমানতের সাড়ে ছয় শতাংশ নগদ টাকা রাখতে হয়। আর নিজেদের কাছে আমানতের ১৩ শতাংশ রাখতে হয়Ñ হয় নগদে অথবা নগদ এবং নগদে রূপান্তরযোগ্য সরকারই বিল ও সিকিউরিটিজে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ‘সিআরআর’ হার হ্রাস করে সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে পাঁচ শতাংশে পরিবর্তন করেছে। এক কাগজে দেখলাম ‘রেপো রেট’ও (যে হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়) ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ছয় শতাংশে হ্রাস করা হয়েছে। এখন সরকারী সংস্থাগুলো বেসরকারী ব্যাংকে তাদের ফান্ডের মাত্র ২.৫ শতাংশ রাখতে পারে। এই হার বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। কি কারণে এসব পরিবর্তন? কারণ আর কিছুই নয়, কিছু অবাধ্য বেসরকারী ব্যাংক নিয়মবহির্ভূতভাবে বেশি বেশি ঋণ দিয়েছে গ্রাহকদের। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা অপরিসীম। তারা কেবল ‘পুরুষকে নারী, নারীকে পুরুষ’ করতে পারে না। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংককে যে কোন শাস্তি দিতে পারে। অথচ দেখা গেল কোন শাস্তি নেই, কোন মনিটরিং নেই। অবলীলাক্রমে কিছুসংখ্যক ব্যাংক দেদার ‘লোন’ দিয়েছে সমস্ত নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে। ওই সময়েই যদি দু-একটা ‘ম্যানেজিং ডিরেক্টরের’ চাকরি যেত, তারা যদি শাস্তি পেত তাহলে নিয়মবহির্ভূতভাবে এত ঋণ বরাদ্দ হতো না। যদি তা হতো তাহলে আজকের এই ‘সঙ্কট’ তৈরি হতো না। ‘সঙ্কটটি’ সকল ব্যাংকের নয়। সরকারী ব্যাংকের তো নয়ইÑ যে কথা ‘মিডিয়া’ বলে না। কিছুসংখ্যক ব্যাংক এই ‘সঙ্কট’ তৈরি করেছে যাকে অহেতুক ‘তারল্য’ সঙ্কট নাম দেয়া হয়েছে এবং সঙ্কটের আলোচনা এমন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যাতে সরকার মালিকদের দ্বারা বাধ্য হয়ে কতগুলো সিদ্ধান্ত নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রভাবিত করেছে। এই প্রভাব খাটানোর কাজটা হয়েছে খুবই দৃষ্টিকটু। একই কাজ অন্যভাবেও সরকার করতে পারত। ‘ব্যবসায়ীদের মুখোমুখি কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ এই শিরোনাম অহেতুক হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আসলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের একটি অঙ্গসংগঠন। গবর্নর সাহেব মন্ত্রণালয়ের লোক ছিলেন বলে এই প্রচারণা আরও বেশি জোরদার হয়েছে। তবে এটা বলাই উচিত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শতভাগ মালিক সরকার। সরকার চাইলে তাকে প্রভাবিত করতেই পারে, কিন্তু তার একটা সীমারেখা না টানলে জনমনে প্রশ্ন জাগে অনর্থক। এবার আসা যাক বর্তমান সিদ্ধান্তের ফল কি হবে সেই আলোচনায়। প্রথমেই ‘সিআরআর’ প্রসঙ্গ। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে একটা ‘টুল’ যা দিয়ে তারা মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রয়োজনে এটা বাড়ানো যায়, কমানোও যায়। এটা নির্ভর করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। বর্তমান মুহূর্তে যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘টাইটার মানিটরি পলিসি’ অনুসরণ করছে যখন এর হার সাড়ে ছয় থেকে সাড়ে পাঁচে নামানো ঠিক হয়নি। এতে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা বাড়বে। তবে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে দেয় এই টাকা নতুন ঋণে দেয়া যাবে না তাহলে সর্বনাশে কিঞ্চিত রক্ষা হবে। ‘সিআরআর’ হ্রাসের মাধ্যমে প্রাপ্ত টাকা ব্যাংকগুলোর উচিত হবে ‘তারল্য’ সমস্যা মেটানোতে ব্যয় করা। নতুন ঋণদানে অবশ্যই নয়। কারণ অনেক ব্যাংক অতিরিক্ত ঋণ দিয়ে রেখেছে। যারা দেয়নি তাদেরও সংযত থাকা দরকার। বাজারে খুব বেশি টাকা নেই। তবে একটা বাঁচুয়া ব্যাপার ঘটেছে। মার্চ মাসে রেমিটেন্সের পরিমাণ বেশ বেড়েছে। এর অর্থ কিছু ‘ক্যাশ’ জেনারেট হবে। ডলারের চাপও কিছুটা কমবে যদি না ব্যাংকগুলো বেপরোয়াভাবে আবার ‘এলসি’ খুলতে শুরু করে। কাগজে দেখলাম রোজার সামগ্রী আসতে শুরু করেছে। ছোলা, ডাল, সয়াবিন, খেজুর, চিনি ইত্যাদির স্টকও ভাল। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান পদক্ষেপের সুফল ব্যাংকগুলোর ঘরে তোলার কথা। এ ক্ষেত্রে তাদের সংযত থাকার অনুরোধ জানাই। কারণ ব্যাংকিং খাতের যে কোন ধরনের ‘সঙ্কট’ শুধু সরকারের সঙ্কট নয়, এতে আমানতকারীরা জড়িত। মালিকরাও জড়িত। মালিকরা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং দেশের মানুষের আলোচনার মধ্যে তাদের নাম। যে কোন ‘সঙ্কট’ তাদের সুনামকেও খাটো করবে। আশা করি তারা আমার এই ইঙ্গিতকে বুঝতে পারবেন। বুঝে ব্যাংকে সুশাসন কায়েমের ব্যবস্থা করবেন। ব্যাংক নষ্ট হলে তারাও যাবেন। সরকারের কিছু ক্ষতি হতে পারেÑ যা না হওয়াই উচিত। কারণ বেসরকারী মালিকদের হয়ে সরকার অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তই নিয়েছে। তার প্রতি তাদের সম্মান দেখানো উচিত হবে। দ্বিতীয়ত সরকারী আমানতের প্রসঙ্গে আসি। বর্তমানে বেসরকারী ব্যাংকে সরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মোট ফান্ডের মাত্র ২৫ শতাংশ রাখতে পারে। এটাকে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। স্বীকার করি এটা জরুরী পদক্ষেপ। কিন্তু চিরকাল এটাই কি থাকা উচিত হবে? বেসরকারী ব্যাংকিং খাত এখন ‘সাবালক’ খাত। তাদের বয়স হয়েছে অনেক। তাদের কার্যক্রম শুরু ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে। তখন ২৫ শতাংশের নিয়ম করা হয়েছিল তাদের ‘সাপোর্ট’ করার জন্য। তখন প্রত্যেক বেসরকারী খাতে কমপক্ষে একজন করে সরকারী প্রতিনিধি থাকতেন তাদের বোর্ডে। সেই দিন এখন আর নেই। ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ৮০ শতাংশই তাদের হাতে। ঋণের বেশির ভাগও তাদের হাতেই। সরকারী আমানত মোট আমানতের বিশ ভাগের বেশি নয়। দেশের বৃহত্তম বেসরকারী ব্যাংকের আমানত অনেক সরকারী ব্যাংকের চেয়েও বেশি। এমতাবস্থায় তারা বিশেষ মর্যাদা চাইতে পারে না। চাওয়ার কোন যুক্তি নেই। আজকে সরকার ‘বাধ্য’ হয়ে যে রেয়াত বেসরকারী ব্যাংককে দিয়েছে তা আমার মতে, বেশি দিন চালু রাখা ঠিক হবে না। বেসরকারী ব্যাংক চলবে নিজের শক্তিতে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যতই দিন যাচ্ছে ততই তাদের শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। সরকারী ব্যাংকের বহু বদনাম। কিন্তু তাদের ‘তারল্য সঙ্কট’ বলতে কোন দিনই কিছু ছিল না। অথচ বেসরকারী ব্যাংক এই সমস্যায় অতীতেও ভুগেছে। কয়েকটি ব্যাংক ডুবেছেও। এসব ব্যাংকের নাম করতে চাই না। বেপরোয়া ব্যাংকিংয়ের কারণে বিনিয়োগ কোম্পানি ছিল দুটোÑ তারাও ডুবেছে। এ দুটো এখন বেসরকারী ব্যাংক। বোঝাই যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব কোনভাবেই কম নয়। সরকারী ব্যাংক কিছু না কিছু নিয়ম মানে। তাদের ওপর নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু বেসরকারী ব্যাংকও ইদানীং আলোচনার শীর্ষে এসে গেছে। বিশেষ করে নতুন ব্যাংকগুলো। তারা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করে ব্যাংকিং করেছে। এটা করতে পেরেছে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। ব্যাংকিং এবং রাজনীতি দুটো মিললে ভয়ানক পরিণতি হয়। যা হচ্ছে এখন দেশে। ব্যাংক ব্যবস্থা, লিজিং কোম্পানির ব্যবসা, বীমা ব্যবসা, তৈরি পোশাক রফতানি ব্যবসা এখন মোটামুটি কিছু ব্যবসায়ীর হাতেই। তারা দিনে দিনে এককভাবে ধনী হচ্ছেন। ধনী হতে বাধা নেই। কিন্তু ধনী হতে হবে প্রতিযোগিতা দ্বারা, মেধা দ্বারা, শ্রম দ্বারা। দুঃখের বিষয় আমাদের বেসরকারী খাত দুটোই নির্ভর করছে সরকারের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর। এটা কি ঠিক? ১৯৮৩-৮৪ সাল আর আজ ২০১৮ সাল। ৩৪ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও কি বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর শিক্ষা হবে না? তারা কি বুঝতে পারছে না জনগণের আস্থা ছাড়া ব্যাংক ব্যবসা হবে না। জনগণই আমানতকারী। সরকার আমানতের মালিক নয়। বস্তুত ব্যাংক ব্যবসায় আমানত আগে, ঋণ পরে। কিন্তু বর্তমান মালিকদের একাংশ মনে করে ব্যাংক মানেই ঋণ আগে, আমানত পরে। এই ধারণা থেকেই আজ ব্যাংকিং খাতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আমানত ও আমানতকারীর স্বার্থ চারদিকে উপেক্ষিত হচ্ছে। ‘ঋণখেলাপ’ মানেই আমানতকারীর স্বার্থ লঙ্ঘিত। তারা সুদ কম পায়। তাদের আমানতের টাকা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আরেকটি কারণে। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, তরুণ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের একটা ধারণা হয়েছে নিজের টাকার দরকার নেই, ব্যাংকের টাকাতেই ব্যবসা করা যায়। ব্যাংকের টাকা থেকেই পুঁজি বানানো যায়। এই ধারণাই ব্যাংকিং ব্যবসার প্রধানতম শত্রু এই মুহূর্তে। ‘ব্যাংকলেড’ গ্রোথ নিতে, ভাবা দরকার। যদি এই নীতিই অনুসারিত হয় তাহলে বর্তমানে যা হচ্ছে তার থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×