ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই পদত্যাগ, কারণ হিসেবে পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে থাকার মতো পরিবেশ নেই বলে জানিয়েছেন, ১০ এপ্রিল নতুন কোচ নিয়োগে সিদ্ধান্ত, বিদেশী কোচেই আগ্রহ বাফুফের

বাংলাদেশ ছেড়ে থাইল্যান্ডে ফুটবল কোচ এ্যান্ড্রু অর্ড

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ৫ এপ্রিল ২০১৮

বাংলাদেশ ছেড়ে থাইল্যান্ডে ফুটবল কোচ এ্যান্ড্রু অর্ড

রুমেল খান ॥ গত ২৭ মার্চ লাওসে গিয়ে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলার মাধ্যমে দীর্ঘ ১৭ মাস পর আবারও আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরেছিল বাংলাদেশ পুরুষ জাতীয় ফুটবল দল। স্বাগতিক লাওসকে হারাতে না পারলেও দুর্দান্ত খেলে তাদের রুখে দিয়েছিল ২-২ গোলে ড্র করে। আগামী সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ও অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ সামনে রেখে প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই এ ম্যাচটি খেলে ১৯৭ ফিফা র‌্যাঙ্কিংধারী বাংলাদেশ। ১৮৩ র‌্যাঙ্কিংধারী লাওসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ম্যাচটি ড্রয়ে কৃতিত্ব ছিল বাংলাদেশের। কেননা দুই গোলে পিছিয়ে থেকেও খেলা শেষ হবার আট মিনিট আগে দুই গোল শোধ করে বাংলাদেশ। এমন চেহারার বাংলাদেশ দলকে দেখা যায় বহু বছর পর। আর এ জন্য যাকে দিতেই হবে পূর্ণ কৃতিত্ব, তিনি হলেন দলের কোচ এ্যান্ড্রু অর্ড। মাত্র ৩৭ বছর বয়সী ইংলিশ বংশোদ্ভূত এই অস্ট্রেলিয়ানের ছোঁয়ায় বদলে যায় মামুনুলরা। দলের খেলোয়াড়দের মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটান তিনি। নিবিড় অনুশীলনের মাধ্যমে ফিটনেস ও স্কিলের প্রভূত উন্নতি ঘটাতে সমর্থ হন তিনি। প্রীতি ম্যাচের এই ফলে স্বভাবতই যথেষ্ট আশান্বিত হয়ে ওঠে ফুটবলপ্রেমী বাংলাদেশীরা। তারা স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে অর্ডকে ঘিরেÑ যার প্রচেষ্টাতে হয়তো আবারও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিততে পারবে বাংলাদেশ এবং অধরা বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের শিরোপাও অর্জিত হবে। কিন্তু সেই সুনীল স্বপ্নের বিনাশ ঘটেছে। কেননা স্বপ্নপূরণের কারিগরই যে আর চাইছেন কাজ করতে! গত ১ এপ্রিল থেকেই তিনি নেই। চুক্তি শেষ হবার তিন মাস আগেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। অথচ বাফুফের ইচ্ছে-পরিকল্পনা ছিল অর্ডের সঙ্গে চুক্তি নবায়নের। কিন্তু সেই সুযোগ বাফুফেকে আর দেননি অর্ড। বাফুফের চাকরি ছেড়ে ইতেমধ্যেই তিনি যোগ দিয়েছেন থাই ক্লাব এয়ারফোর্স সেন্ট্রাল ফুটবল ক্লাবে। ২০১৭ সালের জুনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পান অর্ড। শুরুতেই তিনি সিনিয়র দল নিয়ে কাজ করতে পারেননি। তাকে যেন বসে থাকতে না হয় সে জন্য বাফুফে তাকে বয়সভিত্তিক দলগুলো নিয়ে কাজ করায়। তবে এতে সন্তুষ্ট না হয়ে বরং হতাশ হয়ে পড়েছিলেন অর্ড। দীর্ঘ অপেক্ষার পর একসময় জাতীয় দলের ক্যাম্প শুরু হয়। অতীতে দেখা গেছে জাতীয় দল গঠন করে তাদের অনুশীলন করানো হয়েছে ঢাকা বা বিকেএসপিতে। এবারও সেটা হয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন দিক, সেটা হলো এই প্রথমবারের মতো লাল-সবুজবাহিনী নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত অনুশীলন করেছে বিদেশের মাটিতে। আর সেই পুরো প্রক্রিয়াতেই সম্পৃক্ত ছিলেন অর্ড। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিমানযোগে কাতারের উদ্দেশ্যে রওনা হয় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল। তারা উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত সপ্তাহ দুয়েক কাতারে অবস্থান করে কন্ডিশনিং ক্যাম্পের জন্য। ১৫ মার্চ দলটি বিমানযোগে ঢাকায় ফেরে। এরপর ১৯ মার্চ বিমানযোগে রওনা হয়ে বিকেলে থাইল্যান্ড গিয়ে পৌঁছে জাতীয় ফুটবল দল। সেখানে অনুশীলনের পাশাপাশি দুটি প্রস্তুতি ম্যাচও খেলে। একটিতে হারে (রাচাবুড়ি ফল এফসির কাছে ০-১ গোলে), একটিতে জেতে (ব্যাংকক গ্লাস এফসির বিরুদ্ধে ৪-৩ গোলে)। এরপর অর্ডবাহিনী ব্যাংকক থেকে ২৫ মার্চ রওনা হয় লাওসে। তারপরের কাহিনী সবারই জানা। গত কয়েক বছর ধরেই নিয়মিত দৃশ্য ছিল এটা। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল বিদেশে খেলতে যাবার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায় নিজেদের সেরা খেলাটা খেলে জয়লাভের। কিন্তু ফিরে আসে বাজেভাবে হেরে মাথা নিচু করে। কিন্তু ২৭ মার্চ দেখে যায় ভিন্ন দৃশ্য। গৌরবময় ড্র করে লাওস থেকে মাথা উঁচু করেই দেশে ফেরে এ্যান্ড্রু অর্ডের শিষ্যরা। কোচ অর্ডের প্রথম এ্যাসাইনমেন্ট ছিল এই ম্যাচটি। দীর্ঘ ১৫ বছর আগে এই লাওসের কাছেই বাংলাদেশ হেরেছিল ২-১ গোলের ব্যবধানে (২০০৩ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত আসরটি ছিল ২০০৪ এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব, গ্রুপ ‘ডি’)। যদিও চুক্তিতে নিয়ম ছিল জুন মাসের আগের কোন পক্ষই কাউকে ছাড়তে পারবে না। তবে চুক্তি শেষের আগেই অর্ডের চলে যাওয়াটাকে সমস্যা মনে করছে না বাফুফে। এ প্রসঙ্গে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ বলেন, ‘এ বিষয়ে পহেলা এপ্রিল অর্ড আমাদের জানিয়েছেন। থাইল্যান্ডে একটা ভাল অফার পেয়েছেন। সেখানে চলে যেতে চাচ্ছেন। বাংলাদেশে তার পরিবার নিয়ে থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এদেশে থাকার জন্য উপযুক্ত মনে হচ্ছে না। তাই বাফুফেকে তিনি অনুরোধ করেছেন যে ছাড়পত্র দিয়ে দিতে।’ আগামী দুই মাসে বাফুফের জাতীয় দল নিয়ে কোন কার্যক্রম নেই। তাই এই দুই মাসের বেতন অর্ডকে দিতে হয়নি বাফুফের। তাই উভয়পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতেই এই ছাড়াছাড়ি। লাওস থেকেই বাংলাদেশ দলের সঙ্গে আসেননি অর্ড। লাওস ম্যাচের আগে থাইল্যান্ডে দল নিয়ে প্রস্তুতি সারতে গিয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে তখনই থাই ক্লাবটিতে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলেন কোচ। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছেÑ শূন্য কোচের চেয়ারে কাকে বসাবে বাফুফে? সোহাগ আভাস দিয়েছেন বিদেশী কোচের দিকেই আগ্রহ বেশি তাদের, ‘আগামী ১০ এপ্রিল ন্যাশনাল টিমস কমিটির মিটিং হবে। জাতীয় দলের কোচ বিষয়ে সেখানে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ তবে বাফুফে এখনও কোচ নিয়োগের কোন ছাড়পত্র না দিলেও ৪ এপ্রিল বাফুফের ই-মেইলে ১২ বিদেশী কোচের আবেদনপত্র জমা পড়েছে। যেটি একটি রেকর্ডই বলা যায়। কারণ এর আগে একদিনে এতে কোচের সিভি জমা পড়েনি বলে জানান সোহাগ, ‘এরই মধ্যে আমরা বেশ ক’জন কোচের সিভি মেইলে পেয়েছি। কিন্তু আমরা সিভিতে বিশ্বাসী না। তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। যাচাই-বাছাই করব। তারপর চূড়ান্ত কথাবার্তা হবে।’ স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় ফুটবল দলের দায়িত্ব সামলেছেন ২২ কোচ। এদের মধ্যে বিদেশী কোচই ১৮ (১৭ দেশের)। এদের মধ্যে গত নয় বছরে আট বিদেশী কোচ নিয়োগ দিয়েছে বাফুফে। সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন এদের প্রত্যেককেই নিয়োগ দেয়ার সময় উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এদের কেউই নিজেদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। বিদায় নিয়েছেন তিক্তভাবে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ২৩তম এবং বিদেশী হিসেবে ১৯তম কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন অর্ড। বাংলাদেশের আগে কোন জাতীয় দলের কোচ হিসেবে ‘এএফসি প্রফেশনাল লাইসেন্সধারী’ অর্ডের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। সর্বশেষ ২০১৩ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার দল পার্থ গ্লোরির সহকারী কোচ হিসেবে ছিলেন তিনি। অর্ড ‘সকারুস’ (অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ফুটবল দল) দলের হয়েও কাজ করেছেন। সেটা স্কাউট (প্রতিপক্ষের দলগুলোর ওপর গোয়েন্দাগিরি এবং প্রতিভা অন্বেষণ করা) হিসেবে। পার্থে বিশ্বকাপ বাছাই ম্যাচে বাংলাদেশ ০-৫ গোলে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছিল। সে ম্যাচটা মাঠে বসে দেখেন অর্ড। সোহাগ জানান, বাফুফের কাছে অর্ডের আর কোন পাওনা নেই। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, অর্ডের মাসিক বেতন ছিল ১২ হাজার ডলার। ২০১০ সালে থাইল্যান্ডের দল বেক তেরো সাসানার কোচ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন অর্ড। ওই বছরেই মিয়ানামের ইয়াংগুন ইউনাইটেড এফসির একাডেমি ডিরেক্টরের পদে যোগ দেন। ২০১২ সালে দায়িত্ব নেন থাইল্যান্ডেরই মুয়াং থং ইউনাইটেডের অনুর্ধ-২১ দলের। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার অর্ড খেলোয়াড়ী জীবনে (১৯৯৫-২০০০) ছিলেন সেন্টার ব্যাক। সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে দুটি সেমি-প্রফেশনাল ক্লাবে খেলেছেন। কখনও জাতীয় দলে খেলেননি অর্ড। কোচিংয়ে সাফল্য বলতে ২০১১ সালে থাইল্যান্ডে এফএ যুব কাপে বেক তেরো সাসানাকে চ্যাম্পিয়ন করান এবং ২০১৩ সালে রিজিওন্যাল লীগ ডিভিশন টুতে মুয়াং থং ইউনাইটেডকে রানার্সআপ করান। বাংলাদেশের ফুটবলকে বদলে দেয়ার কাজটা মাত্রই শুরু করেছিলেন। কিন্তু তারপরই এভাবে চলে যাওয়াতে কি ছন্দপতন হলো না? বাফুফে অবশ্য তেমনটা মনে করছে না। দেখা যাক, তাদের এমন ভাবনা কতটা সঠিক হয়।
×