ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোবাইল ফোন ও অবৈধ পণ্য ঠেকাতে কারাগারে বডি স্ক্যানার স্থাপন

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৫ এপ্রিল ২০১৮

মোবাইল ফোন ও অবৈধ পণ্য ঠেকাতে কারাগারে বডি স্ক্যানার স্থাপন

মশিউর রহমান খান ॥ কারাবন্দী ও কারাগারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা রক্ষায় দেশে প্রথমবারের মতো কারাভ্যন্তরে ‘বডি স্ক্যানার’ স্থাপন করেছে কারা অধিদফতর। দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ কারাগার হিসেবে পরিচিত কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি প্রিজন্স কেন্দ্রীয় কারাগার ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জ কারাগারে দুটি বডি স্ক্যানার স্থাপন করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে চাহিদার প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ কারাগারগুলোতে এসব বডি স্ক্যানার স্থাপন করা হবে বলে কারা অধিদফতর ও প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। কারাভ্যন্তরে যাতে কোন প্রকার অস্ত্র, মোবাইল ফোন, ইয়াবা, গাঁজা কিংবা যে কোন প্রকার মাদকসহ সব ধরনের অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্য প্রবেশ ঠেকাতে এই বডি স্ক্যানার স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কারাগার তথা সারাদেশে প্রথমবারের মতো দেহ তল্লাশির মাধ্যমে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অত্যাধুনিক বডি স্ক্যানারের নতুন যুগে প্রবেশ করল। অত্যাধুনিক এ মেশিনের মাধ্যমে কারাবন্দীই শুধু নয়, সন্দেহভাজন যে কোন কারা কর্মকর্তা বা কর্মচারী এবং কারারক্ষীর দেহও তল্লাশি করা হবে। তবে বডি স্ক্যানার দিয়ে সকল শ্রেণীর বন্দীকেই তল্লাশি করা হবে না। শুধু জঙ্গী, অস্ত্র, মাদক, সন্ত্রাসী মামলার আসামিসহ নতুন পুরাতন আদালত ফেরত সন্দেহজনক সকল আসামি ও কারা কর্তৃপক্ষ যেসব আসামিকে বিশেষ প্রয়োজন মনে করবে সেসব আসামিকেই এই বডি স্ক্যানার দিয়ে তল্লাশি করা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া অন্য সকল আসামিকে সাধারণ পদ্ধতিতে তল্লাশি করা হবে বলে কারা সূত্রে জানা গেছে। কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এই বডি স্ক্যানারের মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তি শরীরের সঙ্গে এমনকি পেটের ভেতরে করেও যে কোন প্রকার মাদক বা অবৈধ পণ্য নিয়ে কারাগারে প্রবেশ করতে চাইলে তা এই মেশিনের মাধ্যমে স্ক্যান করলেই অতি সহজেই কয়েক সেকেন্ডের মাধ্যমে সহজেও তা ধরা পড়বে। ফলে কোন অবৈধ পণ্যই কারাগারে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না। এর মাধ্যমে আদালত ফেরত বা নতুন বন্দীদের কারাগারে প্রবেশের জন্য তল্লাশির জন্য প্রয়োজনীয় সময় অনেকাংশে কমে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কারাগারের এসব বডি স্ক্যানার স্থাপন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অতি প্রয়োজনীয়ও হওয়া সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক কোন বিমানবন্দরেও দেহ তল্লাশির জন্য ‘বডি স্ক্যানার’ আনতে সক্ষম হয়নি সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। কারাগারের নিরাপত্তা রক্ষায় এর মাধ্যমে আরও একধাপ এগিয়ে গেল। কারা সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের আওতায় ‘কারা নিরাপত্তা আধুনিকায়ন’ প্রকল্পের অধীনে প্রাথমিকভাবে দুটি বডি স্ক্যানার কেনা হয়েছে। কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত বিশ্বের ন্যায় আধুনিকায়ন করতে ২০১৬ সালের নেয়া এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে বলে জানিয়েছেন সিলেট বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক ও প্রকল্প পরিচালক এ কে এম ফজলুল হক। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে দুটি স্ক্যানার কিনতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। জার্মানির বিশ্ববিখ্যাত স্মিথ কোম্পানির তৈরি এসব বডি স্ক্যানার জার্মান থেকেই আমদানি করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এসব মেশিন পরিচালনার জন্য কারাগারের কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। কারা নিরাপত্তা আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় এই দুটি বডি স্ক্যানার আনা হয়েছে। সূত্র জানায়, কারাগারের ভেতরে মোবাইল ফোনের প্রবেশ ও মাদকের যত্রতত্র প্রবেশ ঠেকাতে বিশেষভাবে কাজ করবে এসব স্ক্যানার। কারাগারে আটক শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গী, মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ী বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামিরা মোবাইল ফোনে প্রতিপক্ষকে হুমকি প্রদান, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করা, মামলার প্রতিপক্ষকে হুমকি প্রদান কিংবা সন্ত্রাসীদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যার প্রমাণও বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গেছে। এছাড়া কারা কর্তৃপক্ষও প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক বন্দীদের কাছ থেকে আধুনিক প্রযুক্তির মোবাইল ফোন উদ্ধার করছেন বলে কারা কর্তৃপক্ষ সব সময়ই বলে আসছেন। কারা কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবেই প্রতিটি কারাগারে অবৈধ পণ্য প্রবেশ রোধে বা যে কোন উপায়ে প্রবেশ করলে তা উদ্ধার করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তির এসব বডি স্ক্যানার স্থাপনের মাধ্যমে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কারাগারগুলোতে দীর্ঘযুগের অভিযোগের পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, বর্তমানে কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি প্রিজন্স কেন্দ্রীয় কারাগারে দেশের সবচেয়ে বেশি জঙ্গী, শীর্ষ সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ তথা বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ও রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামিরা আটক রয়েছেন। এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে বিভিন্ন প্রকারের সবচেয়ে বেশি বন্দী আটক রয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে এই দুটি কারাগারে দুটি বডি স্ক্যানার বসানো হয়েছে। পরবর্তীতে সকল কেন্দ্রীয় কারাগারসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারাগারে এসব স্ক্যানার বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে কারা সূত্র জানা গেছে। সূত্র জানায়, একজন ডেপুটি জেলার এ বডি স্ক্যানার পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন। নির্দিষ্ট বন্দীর বাইরেও কোন আসামি আদালত থেকে ফেরার পথে কোন প্রকার অবৈধ পণ্য নিয়ে এসেছে এ সংক্রান্ত কোন সংবাদ থাকলে সেই আসামিকেও এই বডি স্ক্যানার দিয়ে তল্লাশি চালানো হবে। জানা গেছে, যে কোন বন্দীকে তল্লাশি করতে মাত্র ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড প্রয়োজন হবে। তবে এসব স্ক্যানারের মাধ্যমে রেডিয়েশন বিচ্ছুরিত হবে বিধায় কোন বন্দীকে বেশি বেশি তল্লাশি করলে শারীরিকভাবে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। তাই বিষয়টি অতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে কারা কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থা ঠেকাতে অপ্রয়োজনে কোন বন্দীকেই বডি স্ক্যানার দিয়ে তল্লাশি না করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে কারা অধিদফতর। প্রকল্প সূত্র জানায়, জার্মান সরবরাহকারী কর্তৃক থাইল্যান্ডের অপারেটরের মাধ্যমে কারা বিভাগের ডেপুটি জেলারসহ মোট ১৫ জন পরিচালনা সহকারীকে সঠিক ব্যবহার পদ্ধতি জানাতে দুই দিনব্যাপী বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এই বডি স্ক্যানারের কোন সমস্যা প্রতীয়মান হলে জার্মানির স্মিথ কোম্পানি পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত ওয়ারেন্টিসহ বডি স্ক্যানার ব্যবহারের জন্য সার্ভিস প্রদান করবে। এসব বডি স্ক্যানারের মাধ্যমে মোবইল ফোন, মাদকসহ অবৈধ সকল পণ্যের ব্যবহার রোধ করা গেলে কারাভ্যন্তরে গঠিত বিভিন্ন অপরাধের মাত্রাও অনেকাংশে কমে আসতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, কারাবন্দীর পাশাপাশি কারাগারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা রক্ষায় দেশে প্রথমবারের মতো সন্দেহজনক বন্দীর দেহ তল্লাশি করতে দুটি বডি স্ক্যানার আনা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে অত্যন্ত কম সময়ে দেহ তল্লাশির মাধ্যমে কারাভ্যন্তরে সকল প্রকার অবৈধ পণ্য প্রবেশ ঠেকাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে এসব বডি স্ক্যানার। এটি দিয়ে বন্দী গোপনে সঙ্গে করে নেয়া মোবাইল ফোন, সকল প্রকার ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, ইয়াবা, গাঁজা মাদকসহ অবৈধ ও নিষিদ্ধ সকল পণ্য প্রবেশ রোধ করা অতি সহজ হয়ে যাবে। এমনকি পেটের ভেতরে করে কিংবা শরীরের যে কোন স্থানে বহন করে কিছু নিলেও সহজেই তা দেখা যাবে। রেডিয়েশন থেকে বাঁচতে বন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা চিন্তা করে বডি স্ক্যানার দিয়ে সকল প্রকার বন্দী নয় জঙ্গী, অস্ত্র, মাদক, সন্ত্রাসী মামলার আসামিসহ নতুন পুরাতন আদালত ফেরত সন্দেহজনক যে কোন বন্দী বা আসামি ও কারা কর্তৃপক্ষ যেসব আসামিকে বিশেষ প্রয়োজন মনে করবে সেসব আসামিকেই এই বডি স্ক্যানার দিয়ে তল্লাশি করা হবে। প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা দুটি বডি স্ক্যানার ইতোমধ্যেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কারাগার হিসেবে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি প্রিজন্স ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপন করা হয়েছে। তিন বছরের ওয়ারেন্টিসহ জার্মানির স্মিথ কোম্পানি পরবর্তী তিন বছর ওয়ারেন্টিসহ সার্ভিস প্রদান করবে। মেনি পরিচালনার জন্য কারা কর্মকর্তা, কারারক্ষীসহ মোট পনের জনকে ২ দিনের প্রশিক্ষণও প্রদান সম্পন্ন করা হয়েছে। কারা নিরাপত্তায় বডি স্ক্যানারের সংযোজন এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। একই সঙ্গে আগামীতে কারাগারে অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্য প্রবেশ ঠেকাতে দেহ তল্লাশিতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সকল কারাগারেই বডি স্ক্যানার বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
×