ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এসএমই মেলা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী

রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের বহুমুখিতা আনতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ৫ এপ্রিল ২০১৮

রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের বহুমুখিতা আনতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে রফতানি বহুমুখীকরণের জন্য চাহিদা দেখে নতুন পণ্য উৎপাদন এবং নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিভিন্ন দেশের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নতুন ও আধুনিক প্রযুক্তির আত্মীকরণ এবং পণ্যের মানোন্নয়ন অত্যন্ত জরুরী। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পণ্যের বাজার অনুসন্ধান এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী সেসব পণ্য উৎপাদন করতে হবে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি পণ্যের ওপর রফতানি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আমাদের এখন রফতানি বহুমুখীকরণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। চাহিদা দেখে নতুন পণ্য উৎপাদন এবং নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। আর এক্ষত্রে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৬ষ্ঠ জাতীয় এসএমই মেলা-২০১৮’র উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের বিকাশে তাঁর সরকার দেশের সব জেলা-উপজেলায় এসএমই পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন করবে। যেগুলো এসএমই শিল্পের প্রসারে উদ্যোক্তাদের জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিসের সেবা প্রদান করবে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ঠা-াজনিত শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি তাঁর ভাষণ প্রদান করেননি। এর পরিবর্তে তাঁর ভাষণের লিখিত কপি অনুষ্ঠানে বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ‘ঠা-া লেগে’ প্রধানমন্ত্রীর গলা বসে গেছে। এ কারণে অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা প্রধানমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্যের অংশবিশেষ পড়ে শোনান। এসএমই ফাউন্ডেশন এবং এফবিসিসিআই যৌথভাবে বুধবার থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় পাঁচ দিনব্যাপী এই মেলার আয়োজন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দেশের সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার জাতীয় শিল্পনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে শিল্প উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে গণ্য করছে। সরকারের নেয়া কর্মসূচীর ফলে দেশব্যাপী টেকসই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের দ্রুত প্রসার ঘটছে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তাগণ ব্যবসা স্থাপন থেকে শুরু করে ব্যবসা সম্প্রসারণ, ব্যবসায়িক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ ও সহায়তা, পরামর্শক সেবা ইত্যাদি এই ওয়ানস্টপ সেন্টার থেকে গ্রহণ করতে পারবে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে। সরকারপ্রধান বলেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে এসএমইর গুরুত্ব অপরিসীম। এসএমই সবচেয়ে শ্রমঘন ও স্বল্পপুঁজি নির্ভর খাত হওয়ায়, এ খাতের মাধ্যমে স্বল্পপুঁজি বিনিয়োগে অধিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ শিল্পই ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের অন্তর্ভুক্ত। তাই জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এসএমই খাত গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। শেখ হাসিনা বলেন, দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সুরক্ষার মাধ্যমে দেশের সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁর সরকার ‘জাতীয় শিল্পনীতি-২০১৬’-তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে শিল্প উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে গণ্য করেছে। তিনি বলেন, তাঁর সরকারের গৃহীত কর্মসূচীর ফলে দেশব্যাপী টেকসই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের দ্রুত প্রসার ঘটছে। উদ্যোক্তাবান্ধব নীতির কারণে প্রতিনিয়ত নারীরা ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করছে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির অনেক সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেই, তখন বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। অনেক দেশ বিশ্বমন্দার অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু আমরা সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। বিশ্বে এখন বাংলাদেশ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৫২ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে উন্নীত। তাঁর সরকারের আমলে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমানে ১৯৯টি দেশে ৭৫০টি পণ্য রফতানি করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ৪১ বিলিয়ন ডলার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশী পণ্যের রফতানির হার বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে। বর্তমানে রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। যা ২০২১ সালে ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। তিনি বলেন, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি গঠন করা হয়েছে। ইকোনমিক জোনসমূহ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশে কুটির শিল্পের সুদীর্ঘ গৌরবের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের ঐতিহ্যবাহী জামদানি, নকশীকাঁথা এবং সিলেটের শীতল পাটি ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-তালিকায় স্থান পেয়েছে। উদ্যোক্তাগণ এসব পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের পাশাপাশি বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে পারেন। উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশীয় কাঁচামালনির্ভর শিল্পায়নের পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক কাঁচামালের সহজলভ্যতা বিবেচনা করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। সরকার উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা প্রদান করবে। এসএমই খাতের সম্প্রসারণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের খ-চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার নিজেরা ব্যবসা করে না। সহায়কের ভূমিকা পালন করে। ফলে আজ দেশে বেসরকারী খাত ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। সারাদেশ থেকে বাছাইকৃত ২৬৭টি এসএমই প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে এ মেলায় অংশগ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৬৭ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা। প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন, এসএমই মেলা দেশে উৎপাদিত এসএমই পণ্যের পরিচিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্রেতা আকর্ষণ ও বাজার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ ধরনের মেলা আয়োজনের মাধ্যমে এসএমই খাতের অনেক সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হবে এবং যথাযথ স্বীকৃতি পাবে। তিনি বলেন, আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সফল এসএমই উদ্যোক্তাদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, শিল্প সচিব মোঃ আব্দুল্লাহ, এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন কেএম হাবিবুল্লাহ। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, কূটনীতিকবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সদস্যবৃন্দ এবং ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং কুটির শিল্পের উদ্যোক্তাবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পাঁচ দিনব্যাপী ষষ্ঠ জাতীয় এসএমই মেলায় সারাদেশ থেকে আসা ২৬৭টি এসএমই প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করবে। এর মধ্যে ৬৭ শতাংশই নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠান। মহিলা শ্রমিকলীগের নেতৃবৃন্দের সাক্ষাত ॥ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দলকে শক্তিশালী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। মহিলা শ্রমিকলীগের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উপলক্ষে বুধবার বিকেলে গণভবনে এক আলোচনা সভায় তিনি কথা বলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান মহিলা শ্রমিকলীগের নেতারা। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান তারা। প্রধানমন্ত্রী সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য মহিলা শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীদের একযোগে কাজ করার নির্দেশ দেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে সংগঠনের পরলোকগত নেতাদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। শারীরিক অসুস্থতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে তো আমি বক্তৃতা দিতে পারব না, আমি শুনব। আমি সব সময় বলি, সবাই শুনতে পারে। কিন্তু আমার শোনা তো হয় না। আমি প্রত্যেক জেলা প্রতিনিধিদের কথা শুনব’। এ সময় সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় এসএমই মেলা-২০১৮’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য না রাখার কথাও জানিয়ে তিনি বলেন, সকালে বক্তৃতা দিইনি। পারি নাই। ওই অনুষ্ঠানে জানান হয় ‘ঠা-া লেগে’ প্রধানমন্ত্রীর গলা বসে গেছে। এ কারণে অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা প্রধানমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্যের অংশবিশেষ পড়ে শোনান। মহিলা শ্রমিকলীগ সভাপতি রওশন জাহান সাথীর সভাপতিত্বে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শামসুন্নাহার আক্তার চৌধুরী, কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক বিউটি আক্তার এবং অন্যান্য জেলা ইউনিট নেতারা বক্তব্য রাখেন।
×