ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বালানি নিয়ে নতুন ভূরাজনীতি

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৪ এপ্রিল ২০১৮

জ্বালানি নিয়ে নতুন ভূরাজনীতি

জ্বালানি হিসেবে তেল আবিষ্কার ও ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে তেল নিয়ে ভূরাজনীতির শুরু। জ্বালানির প্রবাহ রাষ্ট্রসমূহের ক্ষমতা ও প্রভাবকে কতখানি কিভাবে প্রভাবিত করে সেটাই ভূরাজনীতির বৈশিষ্ট্য। জ্বালানি নিয়ে ভূরাজনীতি মূলত হয়েছে বিশ্বের দেশগুলোর তেলের চাহিদা নিয়ে। তেল সম্পদ বাগানোর, এর চালানের নিরাপত্তা রক্ষা, শত্রুকে তেল করায়ত্ত করতে বা চালান আটকে রাখতে না দেয়া এবং সম্ভব হলে তেলের ওপর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে বহুলাংশে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। তেল ও গ্যাস অফুরান নয়। এক সময় তা নিঃশোষিত হবে। তাছাড়া তা সর্বত্র পাওয়া যায় না। এ কারণে উৎপাদকদের লাভের স্বার্থে তা রেশন করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে ভোক্তা দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে অনুভব করে আসছে যে তেলের দুষ্প্রাপ্যতা তাদের অধিকতর বিপন্ন করে তুলছে। ১৯৭৩ সালে আরবদের তেল অবরোধের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট আমদানিকৃত তেলের ওপর দেশের নির্ভরশীলদের দুর্বলতা হিসেবে ধরে নিয়েছে। তেলের দুষ্প্রাপ্যতার এই ধারণাটির অবসান ঘটতে চলেছে তিনটি বড় ধরনের অগ্রগতির কারণে। প্রথমত যুক্তরাষ্ট্রের শেল বিপ্লব যা দেশটিকে তেল ও গ্যাসের সমষ্টিগত একক বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশে পরিণত করেছে। আমেরিকা এখন এত বেশি তেল উৎপাদন করছে যা আগে কখনও করেনি। গত নবেম্বরের হিসাব অনুযায়ী দেশটি উৎপাদন করছে দৈনিক ১ কোটি ব্যারেল। ১৯৮০ সালের কার্টার ডকট্রিনে ঘোষণা করা হয়েছিল যে মধ্যপ্রাচ্যে স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রক্ষায় সামরিক শক্তি প্রয়োগের অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল আসলে তেলের স্থিতিশীল সরবরাহ সুনির্দিষ্ট করা এখন মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলের সরবরাহ রুটের নিরাপত্তা রক্ষায় আমেরিকার রক্ত ও সম্পদ অপচয় করার প্রয়োজনীয়তা কমেছে। দ্বিতীয় বড় পরিবর্তনটা ঘটছে চীনে। দেশটি জ্বালানি নিবিড় অর্থনীতি থেকে সার্ভিস নিবিড় অর্থনীতিতে সরে আসার চেষ্টা করছে। গত কয়েক বছরে দেশটি তেল ও কয়লার চাহিদা কমিয়ে দেয়া, বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি মন্থর করা, গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা এবং কার্বন নির্গমন বৃদ্ধি রোধ করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। এখনও চীন বিশ্বের বৃহত্তম জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানিকারক হলেও দেশটি বায়ুশক্তি ও সূর্যালোককে কাজে লাগানোর দিকে বেশি করে ঝুঁকে পড়ছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারে এ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা আছে চীনে। জ্বালানির ক্ষেত্রে একটা উত্তরণ ঘটাতে চীনের উদ্যোগ আমেরিকার মতোই অসাধারণ। এই দুটি অগ্রগতি তৃতীয় একটি অগ্রগতি অর্জনে ভূমিকা রাখছে। সেটা আরও দীর্ঘমেয়াদী একটি ধারা। সেটা হলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কম কার্বন নির্গমন হয় এমন জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা। এ জন্য বায়ু ও সৌরশক্তি, ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক গ্রিড এবং আরও নানা ধরনের পরীক্ষামূলক বিশুদ্ধ জ্বালানি উৎসের পেছনে ট্রিলিয়নকে ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। জ্বালানির ক্ষেত্রে এই উত্তরণকে কেন্দ্র করে সর্বে্ত্তাম প্রযুক্তি করায়ত্ত করার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তৈরি করতে যেসব গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিরল খনিজ উপাদান দরকার তা করায়ত্ত করার জন্যও সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এমআইটির এক বিশেষজ্ঞের ভাষায় ‘জ্বালানির মূল্য যেখানে জ্বালানি সম্পদের মধ্যেই আবদ্ধ তেমন এক বিশ্ব থেকে আমরা চলে যাচ্ছি এমন এক বিশ্বে যেখানে প্রযুক্তিই হলো সম্পদ।’ শিল্পবিপ্লব থেকে শুরু করে প্রথম পর্যায়ে কয়লা জ্বালানিতে এবং পরে তেলে উত্তরণ বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল। তবে সর্বশেষ যে জ্বালানিতে উত্তরণের চেষ্টা চলছে তার প্রভাব হবে একই ধরনের সুদূরপ্রসারী। এই জ্বালানি উত্তরণ সমাজগুলোকে বা রাষ্ট্রসমূহকে জ্বালানি ক্ষেত্রে পরাশক্তিতে পরিণত করবে। তবে এই উত্তরণের মধ্যে ভূরাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ নতুন জ্বালানি শক্তিতে উত্তরণের ফলে যেসব দেশ পেট্রোলিয়ামের ওপর নির্ভরশীল তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্পষ্টতই সে সব দেশ যাদের জীবাশ্ম জ্বালানির পর্যাপ্ত মজুদ আছে এবং অর্থনীতির সংস্কার না ঘটিয়ে তারা দীর্ঘদিন তেলের ওপর নির্ভর করতে চায়। বিশেষজ্ঞরা এটাকে অনিবার্য মনে করেন যে জ্বালানি নিয়ে ভূরাজনীতি কোন দেশ তার নিজস্ব সর্বাধিক জ্বালানি উৎপাদন করতে পারছে এবং কোন দেশের এক্ষেত্রে সর্বোত্তম প্রযুক্তি আছে সে সংক্রান্ত প্রতিযোগিতার রূপ ধারণ করবে। মিগুয়েল এবিয়াস কানেত নামে ইইউর এক বিশেষজ্ঞের ভাষায় ‘আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি করায়ত্ত করার অপরিবর্তনীয় পথে বসেছি। যারা বিশুদ্ধ জ্বালানিতে উত্তরণ ঘটাতে পারবে না ভবিষ্যতে তাদের স্থান হবে পরাজিত ও ক্ষতিগ্রস্তদের দলে।’ চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×