ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিউটি পারভীন

এই আশরাফুল, সেই আশরাফুল!

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৪ এপ্রিল ২০১৮

এই আশরাফুল, সেই আশরাফুল!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘আশার ফুল’ নাম হয়ে গিয়েছিল তার। এর কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিস্ময়কর কিছু ঘটনার জন্ম দিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন বিশ্বব্যাপী। সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো পরাক্রমশালী দলকে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কাছে প্রথম পরাজয়ের স্বাদ উপহার দিয়েছিলেন, একদিনের জন্য টেস্টে দেশের পক্ষে সর্বাধিক ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড গড়েছিলেন, এমনকি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ৫২ বলে ৯৪ রানের বিস্ফোরক ইনিংসগুলো তাকে সবসময়ই আলোচনায় রেখেছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করেই যেন ক্যারিয়ারে কালিমা লেপন করেছিলেন। গত ৫ বছর পুরোপুরিই ছিলেন আলোচনার বাইরে। কিন্তু এবার দেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে যা করেছেন নতুন করে আলোচনায় ফিরেছেন মোহাম্মদ আশরাফুল। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কালো থাবায় জর্জরিত হয়ে ৫ বছর আন্তর্জাতিক ও তিন বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর লড়াইটা ছিল নিজের সঙ্গেই। সেই লড়াইয়ে এবার দেশের অন্যতম ক্রিকেট আসর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে (ডিপিএল) জিতেই গেলেন আশরাফুল। কিন্তু এখনও জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা হয়নি বলে নিজেই দাবি করে বলেন সেজন্য আগামী ৪/৫ মাস কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ধারাবাহিকতা না থাকার সমালোচনাকেও কবর দিয়েছেন টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। ডিপিএলে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের হয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে অপরাজিত ১০২ রানের ইনিংস খেলে সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছেন। এর আগে দেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে আর কোন ব্যাটসম্যানই এ কীর্তি গড়তে পারেননি। সবমিলিয়ে চলতি লীগে ৫ সেঞ্চুরি করে দেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন তিনি। এর আগে দেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে আর কোন ব্যাটসম্যান এক মৌসুমে এত শতক হাঁকাতে পারেননি। তাই আবারও জাতীয় দলের জার্সিতে ফিরবেন এমন প্রত্যাশা তার অসংখ্য ভক্তকুলের। কিন্তু আশরাফুল নিজেই তা নাকচ করে দিয়েছেন। স্বপ্ন দেখলেও বাস্তবতা সামনে এনে তিনি জানিয়েছেন আরও সময় লাগবে জাতীয় দলে খেলার উপযুক্ত হতে। মূলত ফিটনেস সমস্যাটাকেই বড় করে দেখেছেন তিনি। আশরাফুল তাই দৃষ্টি দিচ্ছেন আসন্ন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২০ আসরের দিকে। আশরাফুল বলেন, ‘আগে এক দিন হলে পরের ১০ দিন হতো না। খেলতাম তবে শট সিলেকশন ভালো ছিল না। এখন যে বেশি ভাল হয়ে গেছে, তাও না। কিন্তু একটু ভালো হয়েছে, আরও উন্নতি করতে হবে। সে জন্য প্রচুর অনুশীলন করতে হবে। পুরো লীগে পুল শট খেলে কোন চার-ছক্কা মারিনি। পাঁচটি সেঞ্চুরি করেছি কিন্তু পুল শট মারিইনি। আপনারা জানেন এটা আমার প্রিয় শট। এটা বাদ দিয়েছি। খেলিইনি। বাঁহাতি স্পিনারের বিপক্ষে ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে এক্সট্রা কাভার দিয়ে উড়িয়ে মারা যে শট, মারিনি সেটাও। ফিটনেস নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। পুরো লিগে স্ট্রাইক রেট ছিল ৭৪। এটাকে আরও ১৬ বাড়াতে হবে। আরেকটু ফিট হলেই সেটি সম্ভব। ৯০-৯৫ স্ট্রাইক রেট আনতে পারলে ভাল হবে। সেটা আস্তে আস্তে হবে।’ ক্যারিয়ারের পুরটা সময় তুখোর মেধাবী ক্রিকেটার হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। তবে আরেকটি কারণে ছিলেন সমালোচিত, তা হচ্ছে ধারাবাহিকতার অভাব। ১৯৯৯-২০০০ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগ লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটের মর্যাদা পায়। তার আগে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের হয়েই পাকিস্তানের জহুর ইলাহী সর্বাধিক পাঁচটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। লীগের এক আসরে করা সর্বাধিক সেঞ্চুরির কীর্তি ছিল সেটাই। কিন্তু জহুরের করা ওই সেঞ্চুরিগুলো অবশ্য লিস্ট ‘এ’ তালিকাভুক্ত না হওয়ায় আশরাফুলই এখন বাংলাদেশের লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে সর্বাধিক ৫ সেঞ্চুরি হাঁকানো ব্যাটসম্যান। ২০০১ সালে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া আশরাফুল সবমিলিয়ে শতক হাঁকাতে পেরেছিলেন এই লীগের আগ পর্যন্ত মাত্র ৫টি। ব্যাটিং গড়টাও যেমন ছিল সেটা কোনভাবেই ভদ্রোচিত চেহারার ছিল না। কিন্তু এবার যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে গেলেন আশরাফুল। ফিক্সিংয়ের কালিমা মেখে দীর্ঘদিন ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিলেন আশরাফুল। প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞার পর শর্তসাপেক্ষে ৩ বছর পর ২০১৬ সালে তিনি দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট আসরে ফেরেন। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর গত ডিপিএলে প্রথম খেলে নিজেকে চেনাতে পারেননি আশরাফুল। ৫ ম্যাচে করেছিলেন ১২৩ রান। এ কারণেই এবার বড় কোন ক্লাব তাকে নেয়নি। অবশ্য, এ মৌসুমটা যে দুর্দান্ত যাবে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন শুরুতেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। এবার কলাবাগান তাকে দলে টানলেও শুরুটা বেশ ভয়াবহ রকমেরই ছিল। তৃতীয় ম্যাচেই প্রাইম দোলেশ্বরের বিপক্ষে একটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু এরপর যেন ব্যর্থতার অমানিশায় ডুবে যাচ্ছিলেন। টানা তিন ম্যাচে ৮, ০, ০ রান করে এমনকি একাদশ থেকেও ছিটকে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। গুঞ্জন শোনা গেছে অনেক অনুরোধ করে অগ্রণী ব্যাংকের বিপক্ষে রবিন লীগের ম্যাচটিতে খেলেছিলেন। সেই ম্যাচে অপরাজিত ১০২ রান করার পর থেকে আর সমস্যা হয়নি তার। পরের ম্যাচে ০ করলেও, তারপর তিন ম্যাচে ৬৪, ১৬ ও ১২৭ রান করেন। অর্থাৎ সর্বশেষ ৬ ম্যাচে তিনটি শতক (দুটি অপরাজিত) ও একটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ফুরিয়ে না যাওয়ার বড় প্রমাণই দিয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী এ তারকা। এরপর রবিবার রেলিগেশন লীগে দলের শেষ ম্যাচে তিনি দারুণ ধৈর্য ও স্থিতি নিয়ে খেলেছেন। ১৯৩ মিনিট ক্রিজে থেকে দেখেশুনে খেলে ১৩৭ বলে ১০ চারে ১০২ রান করে অপরাজিত থাকেন। চলতি বছরের আগস্টে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞার শাস্তিপূরণ হয়ে যাবে আশরাফুলের। এরপর ফ্র্যাঞ্চাইজি টি২০ লীগ বিপিএল ও প্রথম শ্রেণীর বিসিএল এবং জাতীয় দলে খেলার জন্য আর কোন বাঁধা থাকবে না। তবে জাতীয় দলে খেলতে হলে পারফর্মেন্স থাকলেই যথেষ্ট নয়, ভাল ফিটনেসের বিকল্প নেই। তাই ফের জাতীয় দলে খেলতে চাইলে কঠিন পরীক্ষাতেই বসতে হবে আশরাফুলকে। কিন্তু এবার ইতিহাস গড়ে জাতীয় দলের নির্বাচকদের ভাবনার খোরাক দিয়েছেন। বলা যেতে পারে নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে এক ধরনের চ্যালেঞ্জই ছুঁড়ে দিয়েছেন। কারণ, লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে টানা ৩ সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে রেকর্ড গড়েছেন। মোহামেডানের বিপক্ষে ১২৭, অগ্রণী ব্যাংকের বিপক্ষে ১০৩ নট আউট এবং ব্রাদার্সের বিপক্ষে ১০২ নটআউট- এই তিন সেঞ্চুরি বাংলাদেশের এ প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পোস্টারবয়কে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা এবং ২০০৩ সালে অসি ক্রিকেটার মাইক হাসি লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে টানা ৫ সেঞ্চুরি করে বিশ্বরেকর্ডের মালিক। আশরাফুলের সামনে অবশ্য সেই সুযোগ নেই। কারণ চলতি লীগ শেষ হয়ে গেছে তার দলের। কিন্তু আশরাফুল চলতি মৌসুমে রান সংগ্রাহকের তালিকাতেও শীর্ষে উঠে গিয়েছিলেন। এবার ৫ সেঞ্চুরি ও ১ হাফসেঞ্চুরিতে ৬৬.৫০ গড়ে আশরাফুলের সংগ্রহ ৬৬৫ রান। কিন্তু কলাবাগানের কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরীও আশরাফুলের বিষয়ে বললেন, ‘৫ বছর প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটের বাইরে থাকা একটি লোক এর পরও এখন এসে যা খেলছে, তা ওর অসাধারণ প্রতিভার গুণই প্রমাণ করে। তবে এখন ওর ভেতরে সেই আশরাফুলের ৬০ ভাগ আছে। ওর এখন দুটি যুদ্ধ। জাতীয় দলে ঢোকার জন্য যারা লড়ছে, তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আরেকটি প্রকৃতির সঙ্গে। শারীরিক গুণাগুণ ধরে রাখা। এখন যা আছে, সেটা ওই প্রতিযোগিতার জন্য যথেষ্ট নয়। সেটাও ওকে অর্জন করতে হবে। ওই আশরাফুলকে ওর ফিরে পেতে হবে। পুরোটা না হলেও ৮০ ভাগ ফিরে পেতে হবে।’ আশরাফুল নিজেও তাই এত দ্রুতই বড় স্বপ্ন দেখছেন না। জাতীয় দলে ফেরার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই সেঞ্চুরিগুলো করে উপকারও হয়েছে। মানুষের মুখে মুখে আবার আমার নামটি ফিরেছে। এখনও আমি জাতীয় দলে খেলার জন্য প্রস্তুত নই। সেজন্য পরের চার-পাঁচ মাস আমাকে প্রচুর কষ্ট করতে হবে। বিপিএল খেলার পরে আসলে বুঝতে পারব আবার বাংলাদেশ দলে খেলার মতো যোগ্যতা আমার হয়েছে কি না। এই মুহূর্তে বলব সেই যোগ্যতা আমার এখনও হয়নি।’
×