ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপকথন-১২ ॥ দশম বিশ্বকাপ জার্মানি : ১৯৭৪

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৪ এপ্রিল ২০১৮

বিশ্বকাপকথন-১২ ॥ দশম বিশ্বকাপ জার্মানি : ১৯৭৪

একুশতম বিশ্বকাপের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে আরো অনেক আগেই। কাউন্ট ডাউন মানে দিন গোনা। সব প্রস্তুতি শেষের পথে। এখন অপেক্ষা চূড়ান্ত দৃশ্য অবতারণার। এ কথা সবার জানা, এবারের ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসছে রাশিয়ায়। এবারের ২১তম বিশ্বকাপে ৩২টি দল অংশ নেবে। কোন ৩২টি দল ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেবে সেটাও এখন সবার জানা হয়ে গেছে। রাশিয়ার ১২টি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ৬৪টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এবারের বিশ্বকাপ আয়োজন করছে রাশিয়া সে কথাও সবার জানা। ১৪ জুন রাশিয়ার মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী ও ১৫ জুলাই একই মাঠে নামবে সমাপনী (ফাইনাল) ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এ কথা সবার জানা, ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর বসে উরুগুয়েতে। মন্টিভিডিওতে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মন্টিভিডিও থেকে মস্কো। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৮৮ বছরের পথচলা নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন ‘বিশ্বকাপকথন’। লিখেছেন... প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও ক্রীড়ালেখক সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ মন্টিভিডিও টু মস্কো ১৯৭০ সালে ব্রাজিল তিন বার জয়ের ফলে জুলে-রিমে ট্রফি চিরতরে নিয়ে যাবার পর নতুন সাজে বিশ্বকাপের আসর বসে। তবে জুলে-রিমে ট্রফি ব্রাজিল নিয়ে যাওয়ায় সমাপ্ত হয় জুলে-রিমে ট্রফির অধ্যায়। নতুন আঙ্গিকে নতুন করে শুরু হয় বিশ্বকাপের নতুন আসর। নামকরণও হয় নতুন করে। এবারে বিশ্বকাপের নতুন নামকরণ হয় ‘ফিফা কাপ’। যথারীতি চার বছর পর ১৯৭৪ সালে ফিফা কাপের প্রথম আসর বসে। ফিফা কাপ শুরুর আগেই তৈরি করা হয় একটি নতুন বিশ্বকাপ। যার নাম দেয়া হয় ‘ফিফা কাপ’। এ বছর নতুন কাপের সঙ্গে সঙ্গে ফিফা পায় নতুন সভাপতিও। ইংরেজ ফিফা সভাপতি স্যার স্ট্যানলি রাউসের মেয়াদ শেষ হওয়ায় দায়িত্ব পান ব্রাজিলের জোয়াও হ্যাভালাঞ্জ। নতুন সভাপতি, সুতরাং নতুন নিয়ম। তিনি নিয়ম করলেন, কোন দল তিনবার কেন তিরিশবার চ্যাম্পিয়ন হলেও কাপ চিরতরে নিতে পারবে না। আর কোন দলকে মূল কাপ দেয়া হবে না। রেপ্লিকা দেয়া হবে। রেপ্লিকা হচ্ছে মূল কাপের আদলে হুবহু একটি কাপ। প্রথম ফিফা কাপের আয়োজনের দায়িত্ব পায় জার্মানরা। ঘুরে-ফিরে সেই ইউরোপ-আমেরিকা। ‘খাড়া বড়ি থোড়-থোড় বড়ি খাড়া’। এ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ১০টি আসরের মধ্যে ৬ বার ইউরোপে বাকি ৪ বার ল্যাটিনে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে সেই আমেরিকা-ইউরোপের গ-িতেই বিশ্বকাপ আটকে থাকল বিশ্বকাপ ফুটবল। এবারেও যথানিয়মে ফিফার ১৪০টি সদস্য দেশের ভোটে আয়োজক নির্বাচিত হলো জার্মানি। যদিও আরও অনেক আগেই বিশ্বকাপের আয়োজকের দায়িত্ব পাওয়া উচিত ছিল জার্মানদের। কথায় বলে, ‘সবুরে মেওয়া ফলে’। ফলেছেও তাই। দেরিতে আয়োজক হয়েছে এবং কাপও জিতেছে তারা। এবারও দশম বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলল আগের মতোই ১৬টি দেশ। এই ১৬টি দেশ নির্বাচন করা হয় বাছাইপর্বের ৯৯টি দেশের মধ্যে থেকে। ওশেনিয়া অঞ্চল থেকে অস্ট্রেলিয়া এবারই প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেল। অঞ্চলভিত্তিক দলগুলো হলো ॥ ইউরোপ অঞ্চল : ইতালি, প. জার্মানি, পূর্ব জার্মানি, নেদারল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া, সুইডেন, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, স্কটল্যান্ড; অঞ্চল কনমোবল : ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, চিলি; কনকাকাফ : হাইতি; আফ্রিকা অঞ্চল : জায়ারে; এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চল থেকে অস্ট্রেলিয়া দশম বিশ্বকাপে অংশ নেয়। বাছাই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ২২২টি ম্যাচ। আর মূল পর্বে ১৬টি দল খেলল ৩৮টি ম্যাচ। জার্মানির ৯টি স্টেডিয়ামে এই ৩৮টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। নবম বিশ্বকাপের মতো এবারও আবার গ্রুপিং করা হয়। গ্রুপ পর্বে ১৬টি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপে ৪টি করে দল অংশ নেয়। তবে এবারে নিয়মের একটু রদ-বদল করা হয়। আগে গ্রুপ পর্বের পর কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পরিবর্তে দ্বিতীয় রাউন্ড করা হয়। অর্থাৎ গ্রুপ পর্বের ১৬টি দলের ৮টি দল অর্থাৎ দুই ৪ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ দল দুই পর্বে দ্বিতীয় রাউন্ডে রবিন লিগ খেলবে। দ্বিতীয় রাউন্ডের দুই গ্রুপের শীর্ষ দুই দল ফাইনাল খেলবে। কোন কোয়ার্টার-ফাইনাল বা সেমি-ফাইনাল হবে না। অনেকে মনে করেন ব্রাজিলকে আটকানোর জন্য এ নিয়ম করা হয়। ফলশ্রুতিতে যা হবার তাই হলো। নিয়মের যাঁতাকলে চ্যাম্পিয়ন হতে পারল না ব্রাজিল। গ্রুপ পর্বে ১৬টি দলকে ৪ গ্রুপে ভাগ করা হয় এভাবে: এ গ্রুপ : পূর্ব জার্মানি, প. জার্মানি, চিলি ও অস্ট্রেলিয়া; বি গ্রুপ : ব্রাজিল, যুগোশ্লাভিয়া, স্কটল্যান্ড ও জায়ারে; সি গ্রুপ : উরুগুয়ে, নেদারল্যান্ড, সুইডেন ও বুলগেরিয়া; ঘ গ্রুপ : ইতালি, আর্জেন্টিনা, পোল্যান্ড ও হাইতি এ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। এরপর চার গ্রুপের গ্রুপ থেকে ৮টি দল দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে। প্রথম রাউন্ডের খেলার পর দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা শেষে দ্বিতীয় রাউন্ডের দলগুলোর অবস্থান : গ্রুপ ১ : নেদারল্যান্ডস, ব্রাজিল, পূর্ব জার্মানি, আর্জেন্টিনা; গ্রুপ ২ : প. জার্মানি, পোল্যান্ড, সুইডেন ও যুগোশ্লাভিয়া। অর্থাৎ দ্বিতীয় রাউন্ডে গ্রুপ-১ থেকে নেদারল্যান্ডস এবং গ্রুপ-২ থেকে প. জার্মানি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়। ব্রাজিল এ গ্রুপে রানার্স আপ হওয়ায় ফাইনাল খেলার সুযোগ হারায়। এবারও ফেবারিট ছিল ব্রাজিল। যদিও সব বিশ্বকাপের আগেই ব্রাজিল ফেবারিট হিসেবেই খেলা শুরু করে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে ফেবারিট হলেও আগেরবারের মতো ছিল না। পেলে, কার্লোস আলবার্তো, বিট্রোসহ দলের অনেক সুপার স্টার অবসরে চলে যাওয়ায় এবারের ব্রাজিল ততটা শক্তিধর ছিল না। তবে ব্রাজিলের চেয়ে জার্মানিকেই বেশি শক্তিশালী ভাবছিলেন অনেকে। কেননা জার্মান দলে আছেন বেকেনবাওয়ার, গার্ড মুলার, ব্রিটনারের মতো তুখোড় ফুটবলাররা। এ বিশ্বকাপের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল, নেদারল্যান্ডসের উত্থান। ডাচরা যে ফুটবল খেলে তার নাম ‘টোটাল ফুটবল’। এর আগে এ জাতীয় খেলা দেখেনি ফুটবল বিশ্ব। এটি ফুটবল ইতিহাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়। দর্শক লুফে নেয় এ নতুন ধরনের খেলা। অনেকে নেদারল্যান্ডসের ভক্ত-সমর্থকও বনে যায়। ‘টোটাল ফুটবল’র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোন খেলোয়াড় এক জায়গায় খেলবেন না। প্রয়োজনে মাঠের সবখানে থাকবে তার বিচরণ। আগে স্ট্রাইকারের কাজ ছিল কেবল গোল করা, ডিফেন্ডারের কাজ ছিল গোল হতে না দেয়া। নেদারল্যান্ড সে ধারণাকে বদলে দেয়। নেদারল্যান্ড ছাড়াও এ বিশ্বকাপে পোল্যান্ডের খেলাও দর্শকের নজর কাড়ে। গ্রুপ পর্বের ফলাফল ॥ গ্রুপ-এ : প. জার্মানি-১ চিলি-০; পূর্ব জার্মানি-২ অস্ট্রেলিয়া-০; পূর্ব জার্মানি-১ চিলি-১; প. জার্মানি-৩ অস্ট্রেলিয়া-০; চিলি-০ অস্ট্রেলিয়া-০; পূর্ব জার্মানি-১ প. জার্মানি-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : পূর্ব জার্মানি গ্রুপ রানার্স আপ : প. জার্মানি । গ্রুপ-বি : ব্রাজিল-০ যুগোশ্লাভিয়া-০; স্কটল্যান্ড-২ জায়ারে-০; যুগোশ্লাভিয়া-৯ জায়ারে-০; ব্রাজিল-০ স্কটল্যান্ড-০; ব্রাজিল-৩ জায়ারে-০; স্কটল্যান্ড-১ যুগোশ্লাভিয়া-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : যুগোশ্লাভিয়া গ্রুপ রানার্স আপ : ব্রাজিল। গ্রুপ-সি : সুইডেন-০ বুলগেরিয়া-০; নেদারল্যান্ড-২ উরুগুয়ে-০; নেদারল্যান্ড-০ সুইডেন-০; বুলগেরিয়া-১ উরুগুয়ে-১; নেদারল্যান্ড-৪ বুলগেরিয়া-১; সুইডেন-০ উরুগুয়ে-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : নেদারল্যান্ডস গ্রুপ রানার্স আপ : সুইডেন। গ্রুপ-ডি : ইতালি-৩ হাইতি-১; পোল্যান্ড-৩ আর্জেন্টিনা-২; পোল্যান্ড-৭ হাইতি-১; ইতালি-১ আর্জেন্টিনা-১; পোল্যান্ড-২ ইতালি-১; আর্জেন্টিনা-৪ হাইতি-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : পোল্যান্ড গ্রুপ রানার্স আপ : আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় রাউন্ড : গ্রুপ-১ : নেদারল্যান্ডস-৪ আর্জেন্টিনা-২; ব্রাজিল-১ পূর্ব জার্মানি-০; ব্রাজিল-২ আর্জেন্টিনা-১; নেদারল্যান্ড-২ ব্রাজিল-০; আর্জেন্টিনা-১ পূর্ব জার্মানি-১; নেদারল্যান্ডস-২ পূর্ব জার্মানি-০; দ্বিতীয় রাউন্ড : গ্রুপ-২ : প. জার্মানি-২ যুগোশ্লাভিয়া-০; পোল্যান্ড-১ সুইডেন-০; প. জার্মানি-৪ সুইডেন-২; সুইডেন-২ যুগোশ্লাভিয়া-১; প. জার্মানি-১ পোল্যান্ড-০; পোল্যান্ড-২ যুগোশ্লাভিয়া-১; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : প. জার্মানি গ্রুপ রানার্স আপ : পোল্যান্ড। তৃতীয় স্থান : পোল্যান্ড-১ ব্রাজিল-০ ফাইনাল : প. জার্মানি-২ নেদারল্যান্ডস-২ (ব্রিটনার, মুলার) (নিসকেন্স) চ্যাম্পিয়ন : প. জার্মানি রানার্স আপ : নেদারল্যান্ড তৃতীয় স্থান : পোল্যান্ড। মিউনিখের আরেকটি ‘অল-ইউরোপ ফাইনাল’-এ মুখোমুখি হয় স্বাগতিক প. জার্মানি বনাম টোটাল ফুটবলের জনক নেদারল্যান্ডস। নেদারল্যান্ডসের সামনে প্রথমবার কাপ ছোঁয়ার হাতছানি। অপরদিকে জার্মানদের দ্বিতীয়বার কাপ ছোঁয়ার তথা দেশের মাটিতে কাপ জেতার স্বপ্ন। সব মিলিয়ে মিউনিখে টানটান উত্তেজনা। ম্যাচের আগে প্রবল বর্ষণে মাঠ প্লাবিত। দমকল দিয়ে পানি ছেঁচে নির্ধারিত সময়ের ৩০ মিনিট পরে খেলা শুরু হয়। শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি নেদারল্যান্ডস। ব্রিটনার ও মুলারের গোলে পিছিয়ে পড়ে ডাচরা। যদিও শেষ দিকে নেদারল্যান্ডসের লিসকেম একটি গোল পরিশোধ করেন তাতে ডাচদের পরাজয় এড়ানো সম্ভব হয়নি। ফিফা কাপের প্রথম ট্রফি ওঠে প. জার্মান অধিনায়ক ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ারের হাতে। একই সঙ্গে ফিফার চালু করা প্রথম ‘ফেয়ার প্লে’ ট্রফিও লাভ করে জার্মানরা। এ বিশ্বকাপে তৃতীয়স্থানও পায়নি ব্রাজিল। তৃতীয়স্থান নির্ধারণী তারা হেরে যায় পোল্যান্ডের কাছে। ফলে তাদেরকে চতুর্থ স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। দশম বিশ্বকাপে প. জার্মানি নেতৃত্ব দেন ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ার আর নেদারল্যান্ডসের জোয়ান ক্রুয়েফ। এ বিশ্বকাপে মোট ৯৭টি গোল হয়। দশম বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোল করেন নেদারল্যান্ডসের লাটো। তিনি এ বিশ্বকাপে ৭টি গোল করে ‘টপ স্কোরার’ হন। হ্যাট্রিক করেন যুগোশ্লাভিয়ার বাজেভিক, পোল্যান্ডের জারমাশ। নবম বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন ইংল্যান্ডের রেফারি জ্যাক টেইলর। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ বাংলাদেশ ও ভারতে প্রকাশিত দুই শতাধিক বইয়ের লেখক e-mail : [email protected]
×