ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শুভেচ্ছায় সিক্ত দেশে ফেরা বাংলার বাঘিনীরা

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৪ এপ্রিল ২০১৮

শুভেচ্ছায় সিক্ত দেশে ফেরা বাংলার বাঘিনীরা

রুমেল খান ॥ ১০-১, ৮-১, ৬-০ এই সংখ্যাগুলো দেখে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, কী এগুলো? হংকংয়ে জকি কাপে বাংলাদেশ জাতীয় অ-১৫ নারী দলের শেষ তিন ম্যাচের গোল তালিকা। এভাবেই গোলবন্যায় মেতে চ্যাম্পিয়ন ট্রফিটি নিজেদের করে নিয়েছে বাংলার বাঘিনীরা। শুধু এটিই নয়। গত চার বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে সাফল্যের সুখবর আনছে এই কিশোরীরা। গত বছর ডিসেম্বরে সাফ ফুটবলে অ-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসরেরও শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছিল এই একই দল। ওই প্রতিযোগিতায় নিজেদের কোন গোল হজম না করেই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ দল (করে ১৩ গোল)। এর আগে ২০১৫ ও ১৬ সালে পরপর দুই বছর এই কিশোরীরাই এএফসি অ-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে অপরাজিত শিরোপা এনে দিয়েছিল বাংলাদেশকে (নেপাল ও তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত)। গত ডিসেম্বরের সাফ অ-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং এবারের জকি কাপে সবমিলিয়ে টানা সাত ম্যাচ অপরাজিত আছে গোলাম রব্বানী ছোটনের সুযোগ্য শিষ্যারা। জকি কাপে চার দল ছয় ম্যাচ খেলে যে ৩০ গোল করেছে, তার ২৪টি করেছে কেবল বাংলাদেশেই। শুধু তাই নয়, সর্বোচ্চ হ্যাটট্রিকধারী, সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং আসরের সেরা খেলোয়াড়Ñ সবাই বাংলাদেশ দলেরই। ফিফার র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ফুটবল দলের অবস্থান যখন প্রায় দ্বিশতকের কাছাকাছি, তখন মেয়েদের ধারাবাহিক এই সাফল্য ফুটবলপ্রিয় মানুষের মনে আশার আলো জ্বেলেছে। চার জাতি আমন্ত্রণমূলক কিশোরী টুর্নামেন্টের আসর শেষে সোমবার দিবাগত রাতে বিমানযোগে দেশে ফিরেছে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের সোনার মেয়েরা। হংকং জয় করে বিমানবন্দরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কাছ থেকে উষ্ণ ফুলেল (রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুল দিয়ে) শুভেচ্ছা পেল ‘দ্য বেঙ্গল টাইগ্রেস’ দল। সেই সঙ্গে তাদের করানো হলো মিষ্টিমুখও। বিমানবন্দরে আরও উপস্থিত ছিলেন বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ। এমন সাফল্যে খুশি মারিয়া-তহুরারা। আর ওমেন্স ফুটবলের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ বললেন, অ-২০ বিশ্বকাপেই চোখ তাদের। আরও বলেন, বিশ্বকাপ খেলার পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক ধাপ এটি। এদিকে মঙ্গলবার বাফুফে ভবনে মেয়েরা দেখা করে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিনের সঙ্গে। সালাউদ্দিন মেয়েদের সাফল্যের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানান। সেই সঙ্গে তাদের আরও বেশি কঠোর পরিশ্রম করার পরামর্শ দেন। এদিকে বিমানবন্দরে তাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে চ্যানেল আই। তারা মহিলা দলের প্রত্যেককে দশ হাজার টাকা করে পুরস্কারও দিয়েছে। তবে বরাবরের মতো এবারও পুরস্কার দেয়ার ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয়। সোমবার রাতে বিমানবন্দরে তিনি তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ছয় হাজার ডলার অর্থ পুরস্কার ঘোষণা দেন। অথচ গত ডিসেম্বরে ঢাকায় এই মেয়েরাই যখন সাফ অ-১৫ আসরে চ্যাম্পিয়ন হলো তখন তিনি মাঠে নেমে একই ঘোষণা দিয়েছিলেন। অথচ আজ অবধি সেই টাকার মুখই দেখেনি মেয়েরা। ফলে প্রশ্ন উঠেছেÑ আগেরটাই পায়নি, এখন নতুন পুরস্কারের টাকা কবে পাবে মেয়েরা? আর আদৌ পাবে কী? এর কারণেই সমালোচিত ক্রীড়া উপমন্ত্রী জয়কে অনেকেই বলছেন ‘ঘোষণাস্বর্বস্ব ক্রীড়া উপমন্ত্রী’। জয়জয়কার দেশের নারী ফুটবলের। ক্রমান্বয়ে উন্নতির ধারায় থাকা কিশোরীরা তাদের সাফল্যের মুকুটে যোগ করলো আরও একটি পালক। এখন চাওয়া আরও বেশি টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগ। এর মধ্যে বাড়তি প্রেরণা হিসেবে থাকছে আগামী আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে কনকাকাফ অ-১৫ ফুটবল টুর্নামেন্ট। এএফসি থেকে মনোনয়ন পেলেই বাংলাদেশের মেয়েদের সামনে থাকবে ওই আসরে খেলার সুবর্ণ সুযোগ। হংকং থেকে রাতে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরেই যুক্তরাষ্ট্রে খেলার আমন্ত্রণের খবর পায় মেয়েরা। অপ্রত্যাশিত এমন খবর পেয়ে তারা তো অবাক। এই বছর এত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ভিড়ে যুক্তরাষ্ট্রে খেলার খবরটি তাই বাড়তি প্রেরণা হয়ে এসেছে তাদের জন্য। এ প্রসঙ্গে দলের কোচ বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসিয়ান, তারপর যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারলে সেটা বড় অর্জন। যুক্তরাষ্ট্র তো ফুটবলে শক্তিশালী দল। তাদের বিপক্ষে সেখানে খেলার সুযোগ থাকবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ওই অঞ্চলের অন্য শক্তিশালী দলগুলোও থাকবে। যদি আমরা যেতে পারি তাহলে মেয়েরা শেখার অনেক বড় সুযোগ পাবে। সঙ্গে নিজেদের পারফর্মেন্স দেখানোর, অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগও থাকবে।’ ছোটন আরও বলেন, ‘এই মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে আছে। কঠোর অনুশীলন করেছে। তারই ফল পেয়েছি হংকংয়ের টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। শিরোপা জেতার অনুভূতি বিশাল। ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। মেয়েরা যে ফুটবল খেলেছে তা এককথায় অসাধারণ। তারা বাংলাদেশের ফুটবলকে অনেক ওপরে নিয়ে গেছে। যারা ওখানে খেলা দেখেছে সবাই বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।’ আগামী ২ মে থেকে এএফসি ফুটসাল হবে থাইল্যান্ডে। ব্যাঙ্ককের আসরে ১৬ দেশ অংশ নেবে। বাংলাদেশের গ্রুপে ভিয়েতনাম, চাইনিজ তাইপে ও মালয়েশিয়া আছে। এ ধরনের আসরে বাংলাদেশ আগে কখনও খেলেনি। ‘থাইল্যান্ডে ফুটসাল অভিজ্ঞতা অর্জনে যাব। সাফ ও এএফসির আসরে ভাল খেলার লক্ষ্য তো আছেই। এছাড়া হংকংয়ের ট্রফি আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে থাকবে।’ হংকংয়ের টুর্নামেন্টসেরা খেলোয়াড় হয়েছে শামসুন্নাহার (জুনিয়র)। সে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে এভাবে, ‘প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে খেলতে গিয়ে খুব ভাল খেলেছি। এ জন্য খুব গর্ব হচ্ছে। অন্য দেশের মেয়েরা আমাদের দেখে বলেছে বাংলাদেশ এতো ভাল খেলে। আমাদেরও ভাল খেলা দরকার।’ ধারাবাহিক সাফল্যের কারণ হিসেবে কোচের নির্দেশনা ও ফিটনেসকেই চাবিকাঠি মানছে শিরোপা জয়ী অধিনায়ক মারিয়া মান্দা, ‘ফিটনেস ও মানসিকতা থাকলে সবকিছু সম্ভব। ছোটন স্যার আমাদের সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা সেভাবেই সবকিছু করেছি।’ বিদেশের মাটিতে এটি বাংলাদেশের মেয়েদের তৃতীয়, অ-১৫ দলের দ্বিতীয় এবং সার্বিকভাবে জেতা পঞ্চম শিরোপা। প্রতিটি দলের ও শিরোপা জয়ের মূল কারিগর ছিলেন কোচ ছোটন। এখন দেখার বিষয় মারিয়াদের আগামীদিনের পথচলা কেমন হয়।
×