ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ফুলের শুভেচ্ছায় সিক্ত

ভক্ত অনুরাগীদের গভীর প্রেমে পূর্ণ সন্জীদা খাতুন

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৪ এপ্রিল ২০১৮

ভক্ত অনুরাগীদের গভীর প্রেমে পূর্ণ সন্জীদা খাতুন

মোরসালিন মিজান লাল একখানা টিপ কপালে পরে এসেছিলেন সন্জীদা খাতুন। মনের ভেতরে যে রং, যে আগুন, এইটুকুন টিপে দিব্যি প্রকাশিত। কী যে ভাল লাগছিল দেখে! ৮৫ বছর পূর্ণ করেছেন। দীর্ঘ জীবন। তারও বেশি সংগ্রাম। বাঙালীর মানস গঠনে, সংস্কৃতির সেবায় এখনও নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে। কিন্তু এত যার অবদান তাকে আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ খুব কম পাওয়া যায়। মনে মনে কৃতজ্ঞতার বোধ। মুখ ফুটে বলা হয় না। মঙ্গলবার হলো। এদিন চমৎকার সুযোগ করে দেয় বাংলা একাডেমি। সন্জীদা খাতুনের জন্মদিবস সামনে রেখে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় বিশেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের। একাডেমির আয়োজন বটে। বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা একরকম ছুটে এসেছিলেন। সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। সবাই ফুল দিয়ে প্রিয় সন্জীদা খাতুনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। চলে স্মৃতিচারণ। কবিতা থেকে পাঠ করেন কেউ। কেউ বলেন গানে গানে। এভাবে স্বল্পতম সময়ে দারুণ মূর্ত হয়ে ওঠেন সন্জীদা খাতুন। তাকে নিয়ে যে আলোচনা, সেটি বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এভাবে বিশেষ তাৎপর্যের হয়ে ওঠে আয়োজনটি। সময়ের আগে চলা সন্জীদা খাতুন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন আগেভাগেই। দর্শক সারিতে বসেছিলেন প্রথমে। দেশের বড় বড় মানুষেরা তাকে খুঁজে নিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করছিলেন। তিনিও মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে দিচ্ছিলেন। এভাবে মোটামুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল জন্মদিনের অনুষ্ঠান। এর এক পর্যায়ে বাংলা একাডেমির সভাপতি আনিসুজ্জামান তাকে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। এ সময় তাদের পাশে ছিলেন নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। এর কিছুক্ষণ পর যোগ দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সংবর্ধিত অতিথিকে উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেন তিনি। বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে পঁচাশিটি গোলাপের গুচ্ছ তুলে দেয়া হয় সন্জীদা খাতুনের হাতে। এভাবে ফুলের শুভেচ্ছা, স্মৃতিচারণ, গান কবিতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে অনুষ্ঠান। এদিন অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সৈয়দ হাসান ইমাম, রামেন্দু মজুমদার, মফিদুল হক, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, গোলাম কুদ্দুছ, বেগম আকতার কামাল এবং সন্জীদা খাতুনের দৌহিত্রী সায়ন্তনী তৃষা। তবে নাগরিক সমাজের পক্ষে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যে শংসাবচন পাঠ করেন তাতে সন্জীদা খাতুনের জার্নিটা সম্পর্কে বেশ খানিকটা জানা যায়। সংস্কৃতির সাধককে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, সাহিত্য ও সঙ্গীতের অধ্যায়ন ও অনুশীলন, সেইসঙ্গে বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে সংযোগ আপনার ব্যক্তিত্বের গড়নে যে বিশিষ্টতা যুক্ত করেছিল তার স্বার্থক প্রকাশ ঘটে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীকে ঘিরে পূর্ব বাংলার বাঙালী জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জাগরণে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর যাত্রাপথে নানা বাধা-বিঘœ-বঞ্চনা উপেক্ষা করে আপনি সঙ্গীতের মাধ্যমে চিত্তের জাগরণ প্রয়াসে কেবল অটল ও একাগ্র থাকেননি, আরও কতভাবেই না সৃষ্টিশীল কাজের অনন্য সব উদাহরণ তৈরি করে বিস্তার ঘটিয়েছেন সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক পরিসরের। তিনি বলেন, অধ্যাপনা ও অধ্যয়নের যুগল-সাধনায় আপনি উচ্চ শিখর স্পর্শ করেছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ বিশ্লেষণে জুগিয়েছেন নতুন মাত্রা, ধ্বনি ও কবিতার সম্মিলন বিচারে আপনার উপলব্ধি সৃষ্টিরস অনুধাবনে নব বিস্তার ঘটিয়েছে। আপনি বাঙালী সংস্কৃতির সম্পদ, শিল্পের সুষমা ও শক্তির প্রকাশক, সঙ্গীতে নিহিত সর্বজনীন কল্যাণবোধ আপনি সবার হৃদয়ে সঞ্চারিত করে চলেছেন। সকলের পক্ষ থেকে বিন¤্র শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পাঠ শেষ করেন তিনি। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী অদিতি মহসিন, লাইসা আহমেদ লিসা প্রমুখ। সব গান কবিতা বক্তব্য গভীর মনোযোগের সঙ্গে শ্রবণ করেন সংবর্ধিত অতিথি। নিজের মাঝে নিজেই মগ্ন হন। আবার যেন হারিয়ে যান কোথায়। এত এত প্রশংসা। জবাবে কী বলবেন তিনি? সে কথা ভেবেই হয়ত ছলছল করছিল চোখ। তবে মুখে বলার সময় খুব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। বলেন, আমি জানি কারও সম্পর্কে বললে বেশি বলতে হয়। অনেকে বেশি বলেছেন। যেমনটি কেউ মারা গেলে বলা হয়। এরপর প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, জন্মদিন মানে কী? আরেকটা বছরে পড়া। আরও একটি সংগ্রাম। এভাবে ছোট্ট কথায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। এদিন সন্জীদা খাতুনের কণ্ঠে গান শোনারও সুযোগ হয়। খালি কণ্ঠে তিনি গেয়ে যান- না বাঁচাবে আমায় যদি মারবে কেন তবে?/কিসের তরে এই আয়োজন এমন কলরবে...। শেষ করতেই করতালী। শেষ করতেই গুনগুন- তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী,/অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি...। অনুষ্ঠান সাঙ্গ হয়। গান কানে বাজে। শেষ হয় না!
×