ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতে “ধন্য আশা কুহকিনীর” খেলা

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ৪ এপ্রিল ২০১৮

রাজনীতিতে “ধন্য আশা কুহকিনীর” খেলা

বাংলাদেশের কবি বলেছেন, “ধন্য আশা কুহকিনী”। একটি সাধারণ নির্বাচন সামনে নিয়ে দেশে এখন এই কুহকিনী আশার খেলা শুরু হয়েছে। এই খেলা এমন চমৎকার যে, খঞ্জ এখন সবল মানুষের মতো রাজপথে নেমে হাঁটতে চায়। আওয়ামী লীগ মনে করছে, দু’ দু’বার একটানা ক্ষমতায় থাকার পরও তারা হাসিনা-নেতৃত্বের ক্যারিজমা এবং দেশকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সুবাদে এবার অনায়াসে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের চোখেমুখে তাই আগাম বিজয়ের উল্লাস। বিএনপি-শিবির যদিও এখন ছত্রভঙ্গ, কিন্তু ফখরুল ও রিজভীর প্রাত্যহিক হুঙ্কার শুনে মনে হয়, তারা নির্বাচনে জিতেই আছেন। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নেত্রীকে জেলে আটকে রেখে সেই জয় ঠেকাবার চেষ্টা করছে। বিএনপির দোসর জামায়াতও নড়ে চড়ে উঠেছে। যারা মনে করেছিলেন, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি হয়ে যাওয়ার ফলে দলটি নেতৃত্বহীন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, তারা এখন দেখছেন সে ধারণা ঠিক নয়। জামায়াতের এখন নতুন নায়ক যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দণ্ডিত গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদের তিন ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আজমি, ব্যারিস্টার নজিবুর রহমান মোমেন ও আলী মাযরুর। দেশে জামায়াতের জনপ্রিয়তার টেস্ট কেস হিসেবে তারা মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নজিবুর রহমান মোমেনকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। এলাকায় মসজিদে, মিলাদ মাহফিলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ালে তারা জোর প্রচারণা চালাচ্ছে এবং জামায়াতের নারীকর্মীরা পবিত্র কোরআন বিতরণের আড়ালে ঘরে ঘরে এই নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়োজিত। জাতীয় পার্টির নেতা জেনারেল এরশাদ ঘোষণা করেছেন, তার দল ক্ষমতায় যেতে প্রস্তুত। দেশবাসীও জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় দেখতে ইচ্ছুক। জাতীয় পার্টি এবার তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দেবে। জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশে দলের কো-চেয়ারপার্সন ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ বলেছেন, “আমরা আর কারও ক্ষমতার সিঁড়ি হব না। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ক্ষমতায় যাব এবং জনগণের জন্য কাজ করব।” ইতোপূর্বে একটি বিদেশী গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে জাতীয় পার্টির নেতা জেনারেল এরশাদ বলেছেন, হাসিনা সরকারের মন্ত্রী পদ থেকে তার দলের সদস্যদের সরিয়ে এনে তিনি জাতীয় পার্টিকে বিএনপির বিকল্প দল হিসেবে দাঁড় করাতে চান। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ছোট ছোট দলগুলো নিয়ে তিনি সম্মিলিত জাতীয় জোট গঠন করেছেন। কিছুদিন ধরে এরশাদ সারাদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং কোন কোন এলাকায় তার দলের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীর নামও ঘোষণা করেছেন। জোট গঠন করেছে অথবা করতে যাচ্ছে, সিপিবি এবং বাসদও। তারা বাম মোর্চা গঠন করে সংসদের তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দেবে বলে জানা গেছে। এখন ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন), জাসদ (ইনু) কি করবে? তারা কি নতুন বাম মোর্চায় আসবে, না আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটেই থেকে যাবে? দেশের সব মহলেরই ধারণা, তারা মহাজোটে থেকে যাবেন। জামায়াত ও হেফাজত এক হয়ে বিএনপি জোটকে সমর্থন দিলে ভয়ের কথা ছিল। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল হেফাজতকে বিএনপি এবং জামায়াত দু’দল থেকেই দূরে রেখেছে। ইসলামী ঐক্য জোটও দ্বিধাবিভক্ত। এই অবস্থায় হেফাজত (জামায়াতকে বাদ দিয়ে) অন্যান্য ইসলামী দল নিয়ে আরেকটি ইসলামী ঐক্য জোট গঠন করে পুরনো বিভক্ত জোটকে কাছে টেনে এনে নির্বাচনী রাজনীতিতে কি ভূমিকা নেয় তা এখন দেখার রইল। আওয়ামী লীগ হেফাজত গ্রুপকে কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে সেটাই এখন প্রশ্ন। এখানে আরেকটি বিবেচ্য, হারাধনের দশটি ছেলের ছয়টি ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা, অলি আহমদ, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না, আসম আবদুর রব এবং তাদের ‘ওয়ান ম্যান’ পার্টিগুলো কী করবে? দেশে সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পুরনো সেøাগান নিয়ে তারা আবার তৃতীয় অথবা বিকল্প ধারার রাজনীতির নামে আরেকটি জোট গঠনের চেষ্টায় নামবেন কী? শোনা যাচ্ছে, এই লক্ষ্যে তারা ইতোমধ্যেই নেমে গেছেন। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ জোট ও বিএনপি জোটের বাইরে এই জোটগুলোকে ‘আশা কুহকিনী’ রাজনীতির মাঠে চরকির মতো ঘোরাচ্ছে। নির্বাচন এলেই এরা বুদবুদের মতো জেগে ওঠে এবং নির্বাচন চলে গেলেই বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায়। দেশের রাজনীতির একটা বাস্তব সত্য এরা অনুধাবন করতে পারছেন না যে, এই রাজনীতির একটা মোটা দাগে বিভাজন ঘটে গেছে। একটা দিকে রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ডান ও বাম দলগুলো। অন্যদিকে রয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিরোধী সাম্প্রদায়িক দল-সমষ্টি। এই সমষ্টিতে গিয়ে যদি আ স ম আবদুর রব বা কাদের সিদ্দিকীর মতো মুক্তিযুদ্ধের বীর যোদ্ধারাও গিয়ে জোটেন, তাহলে তারাও মুক্তিযুদ্ধের শত্রু শিবিরের লোক বলেই বিবেচিত হবেন। তাদের আগের পরিচয় মুছে যাবে। আমার ধারণা, বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে (এবং আসবে বলেই আমার বিশ্বাস) তাহলে যুদ্ধটা হবে আওয়ামী লীগ জোট ও বিএনপি-জোটের মধ্যেই। অন্যরা হবেন রণাঙ্গনের লাশ। ড. কামাল হোসেন, ডাঃ বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী বা বাম মোর্চার মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মতো নেতাও নির্বাচনে অংশ নিলে জামানত হারাতে পারেন, আবার টেনে টুনে দলছাড়া অবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে জয়ী হতেও পারেন। নির্বাচনে তাদের একমাত্র অবদান হবে, আওয়ামী লীগ জোটের ভোট কাটা এবং বিএনপিকে নির্বাচন জয়ে সাহায্য করা। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক বাকশাল নামে দল গঠন করে নির্বাচনে না নামলে ড. কামালের মতো নেতাও সামান্য ভোট মার্জিনে পরাজিত হতেন না। বাকশাল ভোট কেটেছিল আওয়ামী লীগের। ক্ষমতাসীন দলের নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণফোরাম, বিকল্পধারা, সিপিবি, বাসদ যে ভুলটা করছে, সেই ভুলটা ভারতে করেছে বামফ্রন্ট জোট এবং ব্রিটেনে করেছে লিবারেল ডেমেক্রাট পার্টি। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে বামফ্রন্ট কংগ্রেসের মনমোহন সরকারের ওপর সমর্থন প্রত্যাহার করে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বেরিয়ে আসে। তার পরিণতি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান, দিল্লীতে তাদের ক্ষমতা দখল এবং পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরাতে দীর্ঘকালের বাম শাসনের শোচনীয় পতন। ব্রিটেনে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ছিল একটি মধ্য পন্থার উদারনৈতিক পার্টি হিসেবে পরিচিত। লেবার পার্টির ন্যাচারাল এলাই এবং লেবার পার্টির সঙ্গেই সরকার গঠন করতো। ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করে লিবারেল পার্টি আরও জনপ্রিয় হয় এবং নিক ক্লিগের নেতৃত্বে দলটি এক নির্বাচনে ভাল ফল করে। টোরি দল সেই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় নেতা ক্যামেরন লিবারেল পার্টির সাহায্য কামনা করেন। নিক ক্লিগ ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদ পেয়ে তাদের সম্পূর্ণ বিরোধী নীতির টোরিদের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন এবং ব্রিটিশ রাজনীতিতে ধিক্কৃত হন। এখন লিবারেল ডেমোক্রাটদের রাজনৈতিক অবস্থান প্রায় শূন্যের কোঠায়। আওয়ামী লীগ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছে সেকথা বলব না। সেজন্যে সময় লাগবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে রাখার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ছাড়া কোন বিকল্প শক্তি নেই। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে দেশে আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা দূরের কথা, যারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতার জন্য তথাকথিত জোট গঠন করে মাঠে নেমেছেন তারাও নির্মূল হবেন। কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে গিয়ে বাম জোটের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় যে পরিণতি ঘটেছে, তার চাইতেও শোচনীয় পরিণতি ঘটবে বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ কর্তৃক সমর্থিত তথাকথিত জোট ও বাম জোটের। তাই যারা আগামী নির্বাচানের আগে ‘ধন্য আশা কুহকিনীর’ মায়ায় বন্দী হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে “কালনেমীর লঙ্কাভাগের” খেলায় নেমেছেন তাদের সময় থাকতে সতর্ক হতে বলি। লন্ডন ৩ এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২০১৮
×