ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফিরিয়ে দাও চোখ

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ৪ এপ্রিল ২০১৮

ফিরিয়ে দাও চোখ

রবীন্দ্রনাথ উচ্চকণ্ঠেই বলেছিলেন, ‘অন্ধজনে দেহ আলো।’ হওয়া উচিতও তাই। কিন্তু দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের যদি অন্ধ করে দেয়া হয় চিকিৎসার নামে, তখন আলো নিভে আসে তাদের। চিকিৎসা খাতের করুণ চিত্রই উঠে আসে এই বর্বর কর্মকাণ্ডে। চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক হাসপাতালে চোখের ছানি অপারেশন করতে গিয়ে কুড়িজন রোগীর চোখ হারানোর ঘটনা কষ্টদায়ক, দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত বৈকি। শুধু তাই নয়, এটা গুরুতর ও ভয়াবহ অপরাধের পর্যায়েও পড়ে। এমন করুণ ক্রন্দনমথিত ঘটনা ভুক্তভোগীদের জীবনযাপন ও বেঁচে থাকাকে দুর্ভোগে পরিণত করেছে। অপরাধীরা সমাজের কীট হিসেবেই চিহ্নিত হবে। কিন্তু যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা না হলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে বেড়াবেই। অবশ্য হাইকোর্ট চক্ষু শিবিরে চিকিৎসা নিয়ে ‘চোখ হারানো’ প্রত্যেককে এককোটি টাকা করে কেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে নাÑ তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে। একই সঙ্গে ওই চিকিৎসা কেন্দ্রে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে কার্যকর, উপযুক্ত ও নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে দায়সারাভাবে অস্ত্রোপচার করায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, হাইকার্টের রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। রুলে দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরচালক, চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল হাসপাতাল, ডাক্তার মোহাম্মদ শাহীনসহ সংশ্লিষ্ট দশজনকে জবাব দিতে বলা হয়েছে। আগামী ছয় মে শুনানি হবে। সুপ্রীমকোর্টের একজন আইনজীবী এ রিট আবেদন করেন। ঘটনায় জেলা সিভিল সার্জন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল আই কেয়ার এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বলা হচ্ছে, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া সাপেক্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের কী ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়া যেতে পারে তা নির্ধারণের পাশাপাশি দায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হিসেবে লাইসেন্স বাতিল করা হবে। বিস্ময় জাগে, লাইসেন্স বাতিল কোন শাস্তি হতে পারে কি? ভিন্ন নামে আবার চালু করা কঠিন নয়। এমন দুর্বল সিদ্ধান্ত ক্ষতিগ্রস্তদের কোন উপকারে আসবে না, বরং অপরাধীদের রক্ষা করবে। পুরোপুরি ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসবের মালিকরা সাধারণত প্রভাবশালী। তাই অপরাধ ধামাচাপা পড়ে যায়। এ রকম বহু উদাহরণ রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্বল বিধি ব্যবস্থার কারণে এসব অপরাধের কূলকিনারা হয় না। তবে তাদের উচিত এমন ব্যবস্থা নেয়া, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কষ্টদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এমনিতেই বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা শিবিরের নামে লেন্স বাণিজ্য চলে। এমনকি চিকিৎসকের পরিবর্তে সহকারী দিয়ে অপারেশনসহ অন্যান্য কারণে রোগীদের প্রায়ই চোখ হারাতে হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গার ঘটনা প্রমাণ করল স্বাস্থ্য খাতে তেমন সুফল অর্জিত হয়নি। নানামুখী তৎপরতা, উদ্যোগ ও আন্তরিকতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবাকে যুগোপযোগী ও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান অনিয়ম, দুর্নীতির পাশাপাশি অর্থের অপ্রতুলতাও একটি কারণ। বলা যায়, স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন এবং সুখ একই সূত্রে গাঁথা। স্বাস্থ্য খাতকে দুর্বল রেখে আর যাই হোক মানবসম্পদকে কার্যকর করা কঠিন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে সামান্যও উৎকণ্ঠিত নয় এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম নয়, চুয়াডাঙ্গার ঘটনা তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই ঘটনা হাল্কাভাবে নেয়া সঠিক হবে না। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পূরণের পাশাপাশি দায়ীদের শাস্তির নিশ্চয়তা প্রদানে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বিরাজমান অস্বাস্থ্যকর অবস্থার বিলোপ সাধন করে জনগণকে উপযুক্ত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা মৌলিক কর্তব্য অবশ্যই।
×