ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জেফ বেজস ॥ বিশ্বে প্রথম ‘সেন্টি বিলিওনিয়ার’

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৩ এপ্রিল ২০১৮

জেফ বেজস ॥ বিশ্বে প্রথম ‘সেন্টি বিলিওনিয়ার’

কোথায় গিয়ে থামবেন তিনি? দ্য মটলে ফুলের অভিমত ২০১৮ শেষে তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৮১ বিলিয়ন ডলারে! আবার এমনও হতে পারে ‘মটলে ফুল’-কে ফুল বানিয়ে নাম লেখাবেন দেউলিয়ার খাতায়। তার বেলায় অসম্ভব নয় কিছুই। তিনি যে জেফ বেজস! ১৯৮২, ১৮ বছরের তরুণ জেফরি প্রেস্টন বেজস, মায়ামি হেরাল্ডকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলছিলেন তার স্বপ্নের কথাÑ মহাকাশকে তিনি এনে দিতে চান সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয়। দৃঢ়বিশ্বাসী উচ্চারণ, ‘আমি মহাকাশে নির্মাণ করতে চাই মানব বসতি। যেখানে বাস করবে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন মানুষ।’ সময় গড়িয়েছে, শিক্ষাজীবন শেষে যোগ দেন ওয়াল স্ট্রিটে। ভালই করছিলেন। সাফল্যও ছিল হাতের নাগালে। কিন্তু ১০টা-৫টা ধরাবাধা জীবন আর যার হোক বেজসের নয়। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেন নামবেন বই বিক্রির ব্যবসায়। তাও অনলাইনে! প্রতিষ্ঠানের নাম ‘এ্যামাজন’। এর বেশি বলবার প্রয়োজন বোধকরি নেই। বলছি জেফ বেজসের কথা। জুলাই ৫, ১৯৯৪ সালে এ্যামাজন ডটকম দিয়ে যাত্রা শুরু করা বেজসের বর্তমান সম্পদ ১২৪.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (সূত্র : ফোর্বস, মার্চ ৫, ২০১৮)। শুরুর গল্পটাও বেশ মজার। মনে অনলাইনের বিশাল সম্ভাবনার কথা উঁকি দিচ্ছিল অনেকদিন ধরেই। নিউইয়র্ক থেকে সিয়াটল ভ্রমণ পথে মস্তিষ্কে ডালপাল মেলে এ্যামাজনের ধারণা। ছেড়ে দেন ডি.ই.শ এ্যান্ড কোং-এর উচ্চ বেতনের চাকরি। অনলাইনে বই বিক্রির ধারণার কথা তিনি যখন প্রাক্তন বস শ-কে জানান, শ-এর মন্তব্য ছিল, ‘খুব ভাল আইডিয়া। বিশেষ করে তার জন্য, যার হাতে এ মুহূর্তে উচ্চ বেতনের কোন চাকরি নেই!’ বেজস কিন্তু নিজের কাছে ছিলেন পরিষ্কার। তার ভাষায়,‘ ৮০ বছরে পা দিয়ে আমি কি ওয়াল স্ট্রিট ছাড়ার জন্য অনুতপ্ত হব? না, কখনই না। বরং অনুতপ্ত হতাম ইন্টারনেটের অপার সম্ভাবনা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে।’ এ্যামাজন নিয়ে লাভের মুখ দেখতে সময় লেগেছে ছয় বছর। হাল ছাড়ার বান্দা নন বিধায় লেগে ছিলেন। সাময়িক মুনাফার চেয়ে তার লক্ষ্য ছিল, একটি টেকসই, দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। জীবন থেকে শিখেছেন আর তা কাজেও লাগিয়েছেন বেজস। শূন্য হাতে শুরু করে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। এ্যামাজনকে নিয়ে গেছেন শীর্ষস্থানে। সম্পদ আহরণের ইঁদুর দৌড়ে সবাইকে পেছনে ফেলেছেন নিজ যোগ্যতায়। ঝুঁকি নিতে দ্বিধা ছিল না কখনই। ব্যর্থতা এসেছে। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সময়ের দাবি মাথায় রেখে মনোযোগী হয়েছেন নতুন ধারণা উদ্ভাবনে এবং তা রূপ দিয়েছেন বাস্তবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বরাবরই পছন্দ করেন বেজস। ঝুঁকি নিয়ে পরীক্ষামূলক প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দেও সমান আগ্রহী। ভাবুন ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কথা। শুরুতে ক্লাউড কম্পিউটিং ছিল এ্যামাজনের ছোট একটি শাখা। ঠিক সময়ে এই ক্লাউড কম্পিউটিং নিয়ে টেক্কা দিয়েছেন গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো জায়ান্ট কোম্পানিগুলোকে। এ খাতের অন্য কোম্পানিগুলো বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করার আগেই বেজস নিজের দখলে নিয়ে নেন শত কোটি ডলারের বাজার । নিয়ত পরিবর্তনশীল গ্রাহক চাহিদা বিবেচনায় বেজস যেমন বাজারে এনেছেন নিত্যনতুন পণ্য। অনেক ক্ষেত্রেই আবার নিজের পণ্য দিয়ে বদলে দিয়েছেন গ্রাহকের অভ্যেস, রুচি। উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে এ্যামাজনের কিন্ডেল ই-বুক রিডার। এটি বাজারে আসার পর অনেক কমে গেছে মানুষের ছাপা বই পড়ার প্রবণতা। বদলে দিয়েছে পাঠাভ্যাস। প্রিন্সটনের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েট জেফ বেজসের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১২ জানুয়ারি। তার জীবনে অনুপ্রেরণা মাতামহ লরেন্স প্রিস্টন। মাতামহের প্রভাবেই বেজস ঝুঁকে পড়েন কম্পিউটারে যা বদলে দিয়েছে তার জীবন। শৈশব, কৈশরে শখ ছিল নষ্ট জিনিস মেরামতের। সে সময় দেখে দেখে বানিয়েছেন সোলার কুকার, হোভারক্রাফট, রোবট, ইলেক্ট্রিক এ্যালার্ম। ছোট ভাইয়ের তার কক্ষে প্রবেশ ঠেকাতে কাজে লাগাতেন নিজের তৈরি করা এ্যালার্ম। আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাসের অধিকারী বেজসের কাছে সবার মতামত একসঙ্গে করে সিদ্ধান্ত নেয়ার চাইতে তার স্বাধীন চিন্তাধারার গুরুত্ব সবসময় বেশি। কৈশরে দেখা স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রকেট নির্মাণ কোম্পানি ‘ব্লু অরিজিন’। আর জুন ২০১৬তে জানিয়েছেন তার নতুন স্বপ্ন, তিনি চান সব হেভি ইন্ডাস্ট্রি স্থানান্তরিত হবে মহাকাশে। এপ্রিল ২০১৭তে রকেট প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের জন্য বিক্রি করেছেন এ্যামাজনের ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের শেয়ার। ঝুঁকি আছে জেনেও ৫ আগস্ট ২০১৩ এক ঘোষণায় জানান নগদ ২৫০ মিলিয়ন ডলারে কিনতে যাচ্ছেন ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’। তার চেনা জগত ইন্টারনেট তথা অনলাইন পাঠকদের ওপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক রূপ দিতে সময় নিয়েছেন তিন বছর। বোঝা যায়, নিজের শক্তির জায়গাটা তিনি ভালই জানেন। মার্চ ৬, ২০০৩ এক হেলিকপ্টর দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে ফঁাঁকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখানেও শেখার আছে, এটাই যে সম্ভব হলে হেলিকপ্টার এড়িয়ে যাও!’ জেফ বেজস এমনি। নির্লিপ্ত, আগ্রাসী এবং সবসময় সবকিছু থেকে কিছু না কিছু শিখছেন। বেজসকে ব্যাখ্যা করতে তার সম্পদের বিস্ময়কর উত্থান পতনের চিত্রটিতে নজর দেয়ার বিকল্প নেই। ৩৩ বছর বয়সে মিলিওনিয়র তালিকায় নাম লেখান ৫৪ মিলিয়ন ডলার নিয়ে। ঠিক দু’বছর পর ১৯৯৯তে ১০.১ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ে প্রথমবারের মতো নাম আসে ফোর্বসের বিলিওনিয়ার তালিকায়। পরের বছর ৪০% হ্রাস পেয়ে সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬.১ বিলিয়ন ডলার। পরবর্তী দু’বছরে তা নেমে আসে ১.২ বিলিয়নে। তারপর রূপকথা হার মানিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। অক্টোবর ২০১৬, ৬৬.৫ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ে হয়ে ওঠেন এই গ্রহের তৃতীয় শীর্ষ ধনী। মার্চ ৬, ২০১৮ বিশ্বে শীর্ষ ধনীর স্থানটি দখল করেছেন ১১২ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ সম্পদের অধিকারী হয়ে। ইতিহাসে তিনিই প্রথম ‘সেন্টি বিলিওনিয়ার’। গত এক বছরে সম্পদ বাড়িয়েছেন ৩৯ বিলিয়ন ডলার! কোথায় গিয়ে থামবেন তিনি? দ্য মটলে ফুলের অভিমত ২০১৮ শেষে তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৮১ বিলিয়ন ডলারে! আবার এমনও হতে পারে ‘মটলে ফুল’-কে ফুল বানিয়ে নাম লেখাবেন দেউলিয়ার খাতায়। তার বেলায় অসম্ভব নয় কিছুই। তিনি যে জেফ বেজস! ১৯৯৩-এ বিয়ে করেছেন সহকর্মী ঔপন্যাসিক ম্যাকেঞ্জি তুতলেকে। তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। টাইম ম্যাগাজিন ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন ১৯৯৯ সালে। ফরচুনের ‘বিজনেস পারসন অব দ্য ইয়ার’ ২০১২। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ ২০১৪তে তাকে দিয়েছে ‘বেস্ট পার্ফমিং সিইও অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর সম্মান। কোন স্বীকৃতি, সাফল্য, আর্থিক অর্জন জেফ বেজসকে প্রকাশে যথেষ্ট নয়। তিনি প্রকাশিত তার আত্মবিশ্বাসে, তার কর্মে। যে আত্মবিশ্বাসের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে জেফ বেজস আজ সারাবিশ্বে কোটি তরুণের অনুপ্রেরণার উৎস। আ, জা, ই
×