ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভুল থেকে শিখি, সামনে তাকাই ॥ মার্ক জাকারবার্গ

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৩ এপ্রিল ২০১৮

ভুল থেকে শিখি, সামনে তাকাই ॥ মার্ক জাকারবার্গ

ক্যামব্রিজ এনালাইটিকা কেলেঙ্কারিতে বিশ্বজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে ফেসবুকের তথ্য ফাঁস, উদ্বিগ্ন ব্যবহারকারীরা। আর ফেসবুক মানেই মার্ক জাকারবার্গ। ফেসবুকের মুখ, সিইও। কিছুটা দেরিতে হলেও বিষয়টি নিয়ে মুখ খুললেন তিনি। জানিয়েছেন এমন কিছু বিস্ফোরক তথ্য যা বলেননি আগে কখনই। কথা বলেছেন নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি শেরা ফ্র্যাঙ্কেল ও কেভিন রোজের সঙ্গে। অনুবাদ- আকিল জামান ইনু ফ্র্যাঙ্কেল- ফেসবুকের তথ্য ভা-ারে ক্যামব্রিজ এনালাইটিকার অনুপ্রবেশ বিষয়ে ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়া কি আপনাকে অবাক করেছে? জাকারবার্গ- ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিষয়টি সবসময় সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অন্যতম দায়িত্ব সেটি নিশ্চিত করা। একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে একজন ব্যবহারকারী যখন তার ছবি, ভিডিও বা টেক্সট মেসেজ সেটা ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ বা ইনস্টাগ্রাম যেখানেই পোস্ট করুক, এ বিশ্বাস নিয়েই পোস্ট করেন যে, এটি কেবল তারাই দেখবেন যাদের জন্য আপনি পোস্ট করেছেন। আর সেই তথ্য যখন এমন কারও হাতে পরে যা ব্যবহারকারীর কাম্য ছিল না তখন অবশ্যই সেটি একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় এবং বিষয়টি নিয়ে শোরগোল ওঠাই স্বাভাবিক। ফ্র্যাঙ্কেল : প্রতিক্রিয়া জানাতে আপনার কিছুটা দেরির কারণ কি এই যে, আপনি আপনার পোস্টে উল্লেখ করা বিষয় তিনটি বিবেচনা করছিলেন? জাকারবার্গ : প্রথমত, আমি চাচ্ছিলাম যা ঘটেছে সে বিষয়ের একটি পরিষ্কার চিত্র পেতে। আমি যাতে আরও আগে মুখ খুলি তা নিয়ে আমার ওপর চাপ ছিল। কিন্তু আমি চেয়েছি আমরা যা বলব, যেন সম্পূর্ণ সত্য হয় তা নিশ্চিত করতে। দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো; আমরা সমস্যাটির সমাধান করতে চেয়েছি যাতে এমনটা আর না ঘটে। এমন নয় যে, এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন আমরা আর হব না, সেটার সমাধানও আমাদের করতে হবে। আমাদের সামনে যখন একটি নির্দিষ্ট সমস্যা আছে আমাদের অন্তত সেটির সমাধান করতেই হবে। আমরা এমন ব্যবস্থা নিচ্ছি যাতে কোগান যা করেছেন সেটি অন্য কেউ না করতে পারেন। ২০১৪তে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু এ সপ্তাহে আমরা দেখেছি পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট ছিল না, আরও কিছু কাজ করার ছিল। আমরা এখন সেসব বিষয়ে কাজ করছি। আমাদের কেবল একটি সমস্যা সমাধান করলেই হচ্ছে না। বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে ক্যামব্রিজ এনালাইটিকা বা কোগানের মতো অন্য কেউ থাকতে পারে যারা আমাদের তথ্যভা-ারে অনুপ্রবেশ করে আমাদের অজ্ঞাতে তথ্য বিক্রি করছে। আমদের নিশ্চিত করতে হবে এটা যাতে আর না ঘটে। সে জন্যই আমরা এতটা সময় নিচ্ছি। আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করছি। নিজেদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছি। আমরা নিশ্চিত করতে চাই কোগান যা করেছে আর কেউ যেন তা না করতে পারে। তৃতীয় আরেকটি বিষয়, ব্যবহারকারীদেরও এটি বুঝতে হবে তারা কি ধরনের এ্যাপস অনুমোদন করছেন। অনেকেই ৫ বা ১০ বছর ধরে ফেসবুক ব্যবহার করছেন। হয়ত কোন এক সময় তারা এমন কোন এ্যাপস অনুমোদন করেছেন যার কথা তারা ভুলে গেছেন। কাজেই আমরা এমন একটা ব্যবস্থা নিচ্ছি যে, ব্যবহারকারীরা গত তিন মাসে ব্যবহার করেননি এমন এ্যাপসগুলো যেন তাদের তথ্য না পায়। আমরা এ সম্পর্কিত একটি টুল নিয়ে কাজ করছি। তবে ব্যবহারকারীদেরও সচেতন হতে হবে। কেভিন : ক্যামব্রিজ এনালাইটিকার হাতে যে ৫০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর তথ্য চলে গেছে, ফেসবুক কি তাদের বিষয়টি জানাবে? জাকারবার্গ : হ্যাঁ। এমনকি ডাটা শেয়ার হতে পারে এমন যে কাউকে আমরা বিষয়টি জানাব। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে তিন থেকে চার বছর আগে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যাদের তথ্য হাতিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের সবার সম্পর্কে আমরা কতটা নিশ্চিত হতে পারছি। বিষয়টিতে রক্ষণশীল না হয়ে আমাদের উপায় নেই। তার পরও বলছি আমরা নিশ্চিত না হলেও, অনুমানের ভিত্তিতে হলেও যাদের তথ্য শেয়ার হয়েছে তাদের বিষয়টি জানাব। রাশিয়ার বিভ্রান্তিকর তথ্য সম্পর্কিত তদন্তে আমরা যা করেছিলাম এবারও এমন একটি টুল তৈরি করছি যেখান থেকে কেউ জানতে পারবেন তার ডাটার নিরাপত্তার বিষয়ে। কেভিন : ঠিক কতগুলো এ্যাপস আপনাদের তদন্তাধীন আছে জানাবেন? জাকারবার্গ : সংখ্যাটি হাজারের ঘরে। ফ্যাঙ্কেল : এই এ্যাপস ডেভেলপারদের কি তদন্তের বিষয়টি জানানো হয়েছে? জাকারবার্গ : আমি যখন পোস্ট করেছি তখন থেকেই। কেভিন : ডেভেলপারদের ব্যবহারকারীদের তথ্য জানতে চাওয়া সম্পর্কে আপনি একটি চুক্তির কথা বলেছিলেন। সেই চুক্তির শর্ত কেমন হবে। আর চুক্তি ভঙ্গের জন্য শাস্তির বিধানই বা কেমন হবে? জাকারবার্গ : বিষয়টি স্পর্শকাতর। তবে বিষয়টি ডেভেলপারদের জন্য আগের মতো সহজ থাকছে না এটা বলতে পারি। টেকনিক্যালি একে এক ধরনের চুক্তি বলা যায়। আমি সংবেদনশীল তথ্য জানতে চান এমন ডেভেলপারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর জোর দিতে চাই। যারা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত সংবেদনশীল তথ্য জানতে চান, আমি নিশ্চিত করতে চাই যে, তাদের সঙ্গে ব্যবহারকারীর পরিষ্কার বোঝাপড়া আছে। ফ্র্যাঙ্কেল : ক্যামব্রিজ এনালাইটিকা এখন নিষিদ্ধ হলেও তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয় কোন চিন্তা কি আছে? জাকারবার্গ : প্রথমেই আমাদের ফার্মটি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ করতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে, তাদের কাছে আমাদের ব্যবহারকারীদের নতুন কোন তথ্য নেই, তারা যা মুছে ফেলেছে অথবা তাদের কাছে থাকতে পারে এমন তথ্য সম্পর্কে। আমরা বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি। এখানে সরকারী আনুষ্ঠানিকতার কিছু বিষয় রয়েছে। আমাদের আগে নিশ্চিত হতে হবে তারা অন্যায় সুযোগ নেয়নি, তার আগে তাদের বিবেচনার কোন সুযোগ আছে বলে মনে করি না। কেভিন : জানা যায় ক্যামব্রিজ এনালাইটিকা তথ্য ভা-ারে অনুপ্রবেশ করেছিল ২০১৫তে। তখন কেন আপনারা ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি? জাকারবার্গ : আমার ধারণা সময়টা ২০১৫-এর শেষদিকে। গার্ডিয়ানে কর্মরত সাংবাদিক আমাদের জানিয়েছিলেন যা আপনি এইমাত্র আমাদের বললেন। বিষয়টি কেবল ক্যামব্রিজ এনালাইটিকার নয়, বিষয়টি ছিল আলেক্সান্ডার কোগান সম্পর্কিত যিনি তাদের সঙ্গে ডাটা শেয়ার করেছিলেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই। আর এনালাইটিকাসহ আরও কয়েকটি পক্ষকে যাদের সঙ্গে কোগান ডাটা শেয়ার করতে পারেন বলে ধারণা তাদের নোটিস করি; আমরা তাদের আইনগতভাবে নিশ্চিত করতে বলেছিলাম তাদের কাছে কোন ডাটা নেই বা কোন অপব্যবহার করা হয়নি। তারা আমাদের বিষয়টি নিশ্চিত করে। ফ্র্যাঙ্কেল : ঘটনার আলোকে এটা কি বলা যায় তারা ডাটা মুছে দিয়েছে এমন প্রমাণ আপনারা চেয়েছিলেন? জাকারবার্গ : হ্যাঁ। আর তারা আমাদের ফর্মাল ও আইনগতভাবেও নিশ্চিত করেছিল। তবে এ পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে সেটি ছিল মিথ্যা। আবার বলি, আমরা এখনও আমাদের তদন্ত শেষ করিনি কাজেই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না তাদের কাছে আর কোন তথ্য নেই। আমি আপনাদের প্রতিবেদনগুলো পড়েছি। যেখানে বলা হয়েছে, সাংবাদিকরা প্রমাণ দেখেছেন যে তাদের কাছে আরও তথ্য আছে। সতর্ক সঙ্কেত হিসেবে আমাদের জন্য এটি যথেষ্ট, ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও। আমাদের ব্যবহারকারীদের তথ্যের নিরাপত্তাবিধান আমাদের দায়িত্ব। ফ্র্যাঙ্কেল : আপনারা কি ‘ডার্ক ওয়েব ডাটা’ ব্রোকারদের বিষয়ে সচেতন যাদের কথা সম্প্রতি এক রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে। এর বাইরেও রয়েছে কিছু স্বাধীন গবেষক যারা দক্ষতার সঙ্গে ডাটা কেনা-বেচা করছে তাদের নিয়ে? জাকারবার্গ : অবশ্যই, আমরা সে বিষয়েও তদন্ত করছি। কেভিন : ডিলিট ফেসবুক প্রচারণা নিয়ে আপনি কি উদ্বিগ্ন? জাকারবার্গ : খুব বেশিসংখ্যক মানুষ তাদের সঙ্গে একমত বলে আমি মনে করি না, তার পরও বিষয়টি সুখকর নয়। আমার ধারণা বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে ত্রটি আমাদের জন্য একটি বার্তা। আমি আরও মনে করি আমাদের সংশোধন করতে হবে। ফ্র্যাঙ্কেল : আমরা ২০১৮-এর মাঝামাঝির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এ সময়ের মধ্যে আপনারা এমন কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন যে, লোকে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে। যা ঘটেছে তা আর ঘটবে না।জাকারবার্গ : এটি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিদেশী হস্তক্ষেপে বা মিথ্যা সংবাদের মতো কিছু ইস্যু আমাদের ২০১৬তে মোকাবেলা করতে হয়েছে। আর ভাল দিকটি হলো এ ধরনের সমস্যা রকেট সায়েন্স নয়। বিষয়টি কঠিন কিন্তু চেষ্টা করলে বিদেশী হস্তক্ষেপে বা মিথ্যা সংবাদের মতো বিষয়গুলো কমিয়ে আনা সম্ভব। বিগত কিছুদিনে বেশকিছু নির্বাচনের চিত্র আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। বিশেষ করে ফ্রান্সের নির্বাচন। আমাদের তৈরি নতুন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টুল প্রায় ৩০ হাজার ভুয়া এ্যাকাউন্ট শনাক্ত করে। আমার ধারণা এ্যাকাউন্টগুলো, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং মার্কিন নির্বাচনের মতোই কৌশল ঘাটাতে চেয়েছিল। আমরা ফ্রান্সে বিষয়টি ঠেকাতে পেরেছি। অন্তত বড় আকারে কিছু করা থেকে। ২০১৭তে এলাবামার নির্বাচনেও তাই ঘটেছে। সেখানে আমরা কিছু মেসিডিয়ান এ্যাকাউন্ট শনাক্ত করি যারা মিথ্যা সংবাদ প্রচারের সঙ্গে জড়িত। বিষয়গুলো আমি আগে কখনই প্রকাশ্যে মুখ খুলিনি। আপনারাই প্রথম যারা জানালেন। আমি নতুন পদ্ধতি নিয়ে সন্তুষ্ট তবে এটাও সত্য প্রতিপক্ষও বসে নেই। কাজেই আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে। ফ্র্যাঙ্কেল : টাইমস জানাচ্ছে, ফেসবুকের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা স্ট্যামস বছর শেষে বিদায় নিচ্ছেন। তো নিরাপত্তা নিয়ে বৃহত্তর কোন পরিকল্পনা? জাকারবার্গ : নিশ্চয়ই। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা নিশ্চিত করেছি আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সমন্বিত রূপ দেয়া। আলেক্স স্ট্যামসকে নিয়ে আমি এক কথায় বলব, তার মূল্যবান অবদান আছে, রাশিয়ার সঙ্গে বিদেশী হস্তক্ষেপ বিষয়ে সে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যক্তি। তার অবদান অসামান্য, আশা করি বর্তমান বিষয়েও আমরা তার সাহায্য পাব। কেভিন : ফেসবুকের হেড অব নিউজ এ্যাডাম মেসোরি ‘মিয়ানমার কা-ে’ ফেসবুকের ভূমিকা দেখে বলেছেন তাকে যাপন করতে হয়েছে বিনিদ্র রজনী। ফেসবুক নিয়ে এমন কিছু ঘটনায় আপনার ঘুম কি হারাম হয়েছে কখনও। বিশ্বজুড়ে ফেসবুকের কিছু ভূমিকায় আপনি কি অপরাধবোধে ভোগেন? জাকারবার্গ : ভাল প্রশ্ন। আমার ধারণা আপনিও জানেন, আমরা এখানে এমন কিছু করছি যা অভূতপূর্ব। আমরা দেশকালের সীমারেখা পেরিয়ে একটি বিশ্ব সমাজ গড়ে তুলতে চাইছি। সেটি করতে গিয়ে এমন কিছু সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে যা কেউ করেনি আজও। পথে নেমে কী ধরনের সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে তার সব তো আগে জানার কোন উপায় নেই। কিন্তু সামনে আসা প্রতিটি সমস্যা আমরা দায়িত্ব নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেছি এখনও করছি। এটাও সত্যি ফেসবুক নিয়ে চলার পথে আমি অনেক ভুল করেছি। লোক নির্বাচনে, টেকনিক্যাল বা ব্যবসায়িক ডিলে। আমাদের অনেক বিষয়েই কাজ করেনি। তার পরও আমি বিশ্বাস করি সামনে তাকাতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে। সামনে আসা সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হবে। আমার ধারণা ব্যবহারকারীরা সেটাই আশা করে আমাদের কাছে। (সংক্ষেপিত)
×