ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সোনার মেয়েদের স্বপ্ন আরও সূদুরপ্রসারী

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৩ এপ্রিল ২০১৮

সোনার মেয়েদের স্বপ্ন আরও সূদুরপ্রসারী

রুমেল খান ॥ সৎ পন্থায় সাফল্য অর্জন করতে এর জন্য শর্টকাট কোন রাস্তা নেই। সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছাতে গেলে অতিক্রম করতে হয় একটির পর একটি ধাপ। করতে হয় নিরন্তর সুকঠিন সাধনা। এর জন্য দরকার সঠিক-সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, সদিচ্ছা, আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য, পরিশ্রম-ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা, নিরবচ্ছিন্ন-দীর্ঘমেয়াদী উন্নত প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত অনুশীলন, প্রয়োজনীয় অর্থ এবং সবশেষে ভাগ্যদেবীর কিঞ্চিৎ কৃপা। এর সবই পাচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। কি অ-১৪, কি অ-১৫, কি অ-১৬, কি সিনিয়র জাতীয় দল ... প্রতিটি দলই পাচ্ছে অভাবনীয়-নজরকাড়া সাফল্য। এই যেমন রবিবার সফলতা পেল বাংলাদেশ অ-১৫ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল। হংকংয়ের মাটি থেকে ছিনিয়ে এনেছে চার জাতি আমন্ত্রণমূলক আন্তর্জাতিক যুব ফুটবলের শিরোপা, তাও আবার নিজেদের চেয়ে র‌্যাঙ্কিংয়ে ৩১ ধাপ এগিয়ে থাকা স্বাগতিক হংকংকে বিশাল ব্যবধানে (৬-০ গোলে) হারিয়ে। সাফল্যের ঝা-া উড়ানো ‘দ্য বেঙ্গল টাইগ্রেস দল বিমানযোগে ঢাকা ফিরছে সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায়। তবে এই সাফল্য কিন্তু মোটেও অপ্রত্যাশিত বা আকস্মিক সাফল্য ছিল না। মেয়েদের নিয়ে গত বছর তিনেক ধরেই ক্যাম্প চলছে সুযোগ্য কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের অধীনে। তাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তন, উন্নত নিউট্রিশন, ফিজিও, চিকিৎসা, ফিটনেস নিয়ে কাজ করা, বিদেশে গিয়ে প্রস্তুতি ম্যাচ ও অনুশীলন করা ... সবকিছুই হয়েছে এবং হচ্ছে। এর সুফলও এসেছে হাতে-নাতে। গত চার বছরে তিনটি বয়সভিত্তিক দল পাঁচটি শিরোপা জিতেছে। এর সুপ্রভাব পড়তে শুরু করেছে সিনিয়র বা জাতীয় দলেও। ২০১৬ মহিলা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মতো ফাইনাল খেলেছে জাতীয় দল। হয়েছে রানার্সআপ। আগামীতে এই আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শিরোপার স্বপ্নে বিভোর তারা। অবশ্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) মহিলা ফুটবল উইংয়ের স্বপ্নটা আরও বড়। তারা চায় আগামী চার বছরের মধ্যে ফিফা অ-২০ মহিলা বিশ^কাপের মূলপর্বে খেলা। ইতোমধ্যেই ফিফা অ-১৬ মহিলা বিশ^কাপের বাছাইপর্ব খেলেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। অংশ নিয়েছে এশিয়ার সেরা আট দল নিয়ে এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের মূলপর্বে। এ লক্ষ্যে প্রতি বছর তারা ১০-১৫টি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলবে। তবে আপাতত সে পথে কোচ ছোটন হাঁটছেন ধাপে ধাপে। চলতি বছর তার হাতে আছে আটটি টুর্নামেন্ট। যার একটির মিশন হংকং থেকে সফলভাবে করতে পেরেছে তার শিষ্যরা। বাকিগুলো হচ্ছে : মেতে এএফসির ফুটবল টুর্নামেন্ট (থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য), আগস্টে কনকাকাফ অ-১৫ ফুটবল (যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিতব্য), সাফ অ-১৫ এবং অ-১৮ টুর্নামেন্ট, সেপ্টেম্বরে এএফসি অ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব, অক্টোবরে এএফসি অ-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব এবং ডিসেম্বরে সিনিয়র সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের আসর। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের টুর্নামেন্টে খেলার আমন্ত্রণ একেবারে সদ্যই পেয়েছে বাফুফে। তাছাড়া এটি ক্যালেন্ডারেও ছিল না। তবে সুযোগ পেয়েও আগামী ১৮ আগস্ট থেকে ইন্দোনেশিয়ায় জাকার্তায় অনুষ্ঠিতব্য এশিয়ান গেমস ফুটবলে খেলতে পারছে না মহিলা ফুটবল দল। বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুরুষ নয়, এই আসরে অংশ নেবে মহিলা দল। কিন্তু বাফুফের তৎপরতায় এই সিদ্ধান্ত পাল্টে দেয় বিওএ। যদিও কারণ হিসেবে জানানো হয়Ñ পারফর্মেন্স নয়, মূলত আর্থিক সঙ্কটের কারণেই এই সিদ্ধান্ত। তবে এ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছেন কোচ ছোটন। এশিয়ান গেমসে খেলতে না পারার আক্ষেপ নেই তার। বরং অন্যান্য সামনের আসরকে টার্গেট করে এরই মধ্যে ভাল প্রস্তুতি নিতে চান তারা। বলা হয়ে থাকে ফুটবলে অধিনায়ক কেবল নামেই অধিনায়ক, আসলে তিনি খেটে খাওয়া শ্রমিক ছাড়া কিছুই নন! আসল অধিনায়ক যদি কাউকে বলতে হয়, তাহলে তিনি হচ্ছেন কোচ। তার দিক-নির্দেশনায়, পরিচালনায়-পরিকল্পনায় দলের জয় বা ড্র নির্ধারিত হয়। ফুটবল দলকে যদি একটা জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা হয, তাহলে নিঃসন্দেহে সে জাহাজের ক্যাপ্টেন হচ্ছেন কোচ। শিপ ক্যাপ্টেন এবং ফুটবল কোচের মধ্যে আরেকটি মিল আছে। জাহাজডুবি হলে দায়ী করা হয় ক্যাপ্টেনকে, তেমনি দলের ভরাডুবি ঘটলে বা সাফল্য না ফেলে বলির পাঁঠা বানানো হয় এ কোচ মহাশয়কেই! ছোটন নিজে একসময় ছিলেন কৃতী ফুটবলার। ১৯৮৮-২০০২ পর্যন্ত খেলেছেন আরামবাগ, ফকিরেরপুল, ওয়ারী ও বিআরটিসির হয়ে। অধিনায়কত্বও করেছেন প্রতিটি দলেরই। ১৯৯৩ সালে যখন ওয়ারীর হয়ে খেলতেন, তখন টিএ্যান্ডটি ক্লাবের কোচ হিসেবে প্রথম কাজ করেন। সেবার টিএ্যান্ডটি ক্লাব পাইওনিয়ার লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়! সেই থেকে শুরু। তারপর ১৯৯৬ সালে টিএ্যান্ডটি ক্লাবকে তিনি শিরোপা পাইয়ে দেন তৃতীয় বিভাগ ফুটবলেও। ২০০৬ সালে বাফুফে কোচ হিসেবে চাকরি হয় তার। ২০০৮ সালে মারদেকা কাপে জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ এসএ গেমসে তাম্রপদক জেতা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলেরও সহকারী কোচ ছিলেন ছোটন। মেয়েদের বয়সভিত্তিক দলগুলোর কোচ হিসেবে আছেন ২০০৯ সাল থেকে। সাফ গেমস, অলিম্পিক বাছাইপর্ব, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, এসএ গেমসÑ প্রতিটি আসরেই দলের সঙ্গে ছিলেন সাবেক ফুটবলার ছোটন। তিনটি বয়সভিত্তিক দল নিয়ে কাজ করেছেন ছোটন? সেরা দল কোনটি? গত ডিসেম্বরে একান্ত আলাপনে জনকণ্ঠকে ছোটন জানিয়েছিলেন, ‘স্কিল, ফিটনেস, স্ট্যামিনা, এটিচুড, স্কোরিং এ্যাবিলিটি ... সব মিলিয়ে অ-১৫ দলটিকেই বেশি ভাল মনে হয়।’ আগামীতে মহিলা ফুটবলকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে ছোটন কি করেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
×