ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণজাগরণ মঞ্চ কর্মী এই শাবি ছাত্র জঙ্গীদের টার্গেট!

জাফর ইকবালকে হত্যা চেষ্টার প্রতিবাদই মাহিদ হত্যার কারণ ॥ ছিনতাই ঘটনা সাজানো নাটক

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩ এপ্রিল ২০১৮

জাফর ইকবালকে হত্যা চেষ্টার প্রতিবাদই মাহিদ হত্যার কারণ ॥ ছিনতাই ঘটনা সাজানো নাটক

গাফফার খান চৌধুরী ॥ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক মাহিদ আল সালাম পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার। পরিবারের দাবি, ছিনতাইয়ের ঘটনার সূত্র ধরে ছিনতাইকারীরা মাহিদকে হত্যা করেনি। হত্যাকা-টি ছিনতাই বলে চালিয়ে দিতেই ছিনতাইয়ের নাটক সাজানো হতে পারে। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের হত্যাচেষ্টার ঘটনায় প্রতিবাদ করার সূত্র ধরেই মাহিদকে হত্যা করা হতে পারে। জাফর ইকবালের মতো মাহিদও গণজাগরণ মঞ্চে জড়িত থাকার কারণে হত্যার টার্গেট হয়ে থাকতে পারে। হত্যাকা-ে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা জড়িত থাকতে পারে। যদিও তদন্তকারী সংস্থা সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল জনকণ্ঠকে বলেন, মাহিদ হত্যায় জড়িত রাসেল নামের আরও একজন গ্রেফতার হয়েছে। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এখন পর্যন্ত তদন্তে ছিনতাইয়ের সূত্র ধরেই মাহিদকে হত্যা করার তথ্য মিলেছে। হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত শাকিল নামের একজন পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পরিবারের দাবির বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। জাফর ইকবাল বা গণজাগরণ মঞ্চের সূত্র ধরেও মাহিদকে হত্যা করা বিচিত্র নয়। এমন বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তদন্তে। তবে গ্রেফতারকৃতরা বারবারই ছিনতাইয়ের সূত্র ধরেই হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে বলে দাবি করে আসছে। গত ২৫ মার্চ রবিবার কালরাতে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা বাস টার্মিনালে ছুরিকাঘাতে নিহত হন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে সদ্য পাস করা মেধাবী ছাত্র মাহিদ আল সালাম (২৮)। দিনাজপুর জেলার বাসিন্দা রিক্সাচালক জয়নাল আবেদীন মাহিদকে গুরুতর আহত অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই মাহিদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় মাহিদের চাচা সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ টি এম হাসান জেবুল বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয় চার জনকে। এ বিষয়ে দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, রিক্সাচালকের দেয়া তথ্য মোতাবেক মীর্জা আতিক ও তায়েফ মোঃ রিপন নামের দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়। বাকি দুই জন শাকিল ও রাসেল পলাতক। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আতিক বিচারক মামুনুর রশীদ সিদ্দিকীর আদালতে ১৬৪ ধারায় হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়। রিপনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মাহিদ হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার হয়েছে। তদন্তে এখন পর্যন্ত চার জনের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। হত্যায় জড়িতদের মধ্যে রাসেল নামের আরও একজন গ্রেফতার হয়েছে। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গ্রেফতারকৃত তিন জনের মধ্যে তায়েফ মোহাম্মদ রিপন বেসরকারী সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ (ব্যাচেলর অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন) শেষ পর্বের ছাত্র। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের ছিনতাইকারী হওয়ার ঘটনাটি রীতিমতো ভাবনার বিষয়। বিশেষ করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত আর্থিকভাবে অবস্থাশালী পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করে থাকে। তার বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কসবায়। আর রিমান্ডে থাকা রাসেল উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেনি। তার বিরুদ্ধে পাঁচটি ছিনতাই মামলা আছে। তার মধ্যে দুইটি মামলায় সে ৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। বাকি তিনটি মামলা বিচারাধীন। বাড়ি সিলেটের বারোখালীতে। গ্রেফতারকৃত অপরজন মীর্জা আতিক মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। দাখিল (এসএসসি) পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তার বাড়িও সিলেট রেলস্টেশনের কাছে বার্থখোলা এলাকায়। আর পলাতক শাকিলের বাড়িও সিলেটের বার্থখোলায়। তারা পেশাদার ছিনতাইকারী বলে স্বীকার করেছে। তারা অনেক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে তাদের হাতে আরও কেউ হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়নি। এ বিষয়ে নিহতের ফুপু হোসনে আরা খানম চিনুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, মাহিদ হত্যায় জামায়াত-শিবির-জঙ্গীদের জড়িত থাকা বিচিত্র নয়। যদিও মাহিদকে ছিনতাইকারীরা হত্যা করেছে বলে একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। ঘটনাটি আরও গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করলে হয়তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসা বিচিত্র নয়। তিনি আরও জানান, মাহিদের পিতা মরহুম মুক্তিযোদ্ধা এম এ সালাম এ্যাডভোকেট। মাহিদ মাভৈ আবৃত্তি সংগঠনের সদস্য ছাড়াও গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিল। চার ভাই বোনের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। বড় বোন ডাঃ ফারহানা সালাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। ছোট বোন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক আফসানা সালাম বর্তমানে ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। একমাত্র বড় ভাই ইংল্যান্ড প্রবাসী ছাইদ আল সালাম। আর মা এ্যাডভোকেট আমিনা সালাম। তিনি বলছেন, গত ৩ মার্চ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে অধ্যাপক জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার পর সিলেট ও ঢাকার প্রতিটি অনুষ্ঠানে জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছিল মাহিদ। তার জের ধরে এবং গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক থাকার কারণেও সে হত্যার টার্গেট হতে পারে। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর থেকেই জঙ্গীদের হাতে একের পর এক খুন ও হামলার শিকার হতে থাকেন ব্লগার, লেখক, প্রকাশকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। তারই ধারাবাহিকতায় ব্লগার রাজিব, সিলেটের বাসিন্দা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন সামাদ, বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দ্বীপ, ব্লগার অভিজিত রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয়, কলাবাগানে জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু তনয় হত্যা, মোহাম্মদপুরে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা করে তিনজনকে আহত করা, ২০১৫ সালের ১২ মে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যাসহ বহু ঘটনা ঘটে। তারই ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা এবং মাহিদ হত্যার ঘটনা ঘটেছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।
×