ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাল্টে যাচ্ছে কারাগার ॥ সংশোধনাগারে রূপান্তরের পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৩ এপ্রিল ২০১৮

পাল্টে যাচ্ছে কারাগার ॥ সংশোধনাগারে রূপান্তরের পরিকল্পনা

মশিউর রহমান খান ॥ দিনে দিনেই পাল্টে যাচ্ছে কারাগার। কারাগারকে সংশোধনাগারে রূপান্তরিত করতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে বর্তমান সরকার। শুধু শাস্তি প্রয়োগের স্থান নয় কারা কর্তৃপক্ষ কারাগারকে উন্নত বিশ্বের ন্যায় প্রকৃত সংশোধনাগারে রূপান্তরে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ব্যয় করছে হাজার কোটি টাকা। মূলত বন্দীর হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তর করতে চায় কারা বিভাগও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারা উন্নয়নে একান্ত আগ্রহের কারণে ও কারা কর্তৃপক্ষের ঐকান্তিক চেষ্টায় অতি দ্রুততার সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে কারাগারের ভেতরের বাইরের দৃশ্য। কারাগারে বইছে পরিবর্তনের নতুন হাওয়া ও পাল্টাচ্ছে অনেক কারা নিয়ম- কানুন। একইসঙ্গে শত বছর আগের তৈরি কারাবিধি ও জেলকোড সংশোধন বা সংস্কার না হওয়ায় ও সারাদেশের কারাগারের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বন্দী থাকার কারণে বন্দীদের শত সুবিধা তৈরি সত্ত্বেও কারাগারকে প্রকৃত সংশোধনাগারে পরিণত করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। কারাগারের উন্নয়নে কারাবন্দীর সঙ্গে স্বজনদের মোবাইল ফোনে কথা বলার সুবিধা চালু ও সাজাকৃত সশ্রম দ-প্রাপ্ত বন্দীদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রির লভ্যাংশের অর্ধেক বন্দীকে প্রদান, কক্সবাজারে উন্মুক্ত কারাগার তৈরির উদ্যোগ সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। যা কারাগারের উন্নয়নের প্রকৃষ্ট উদাহারণ। একইসঙ্গে কারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের আন্তর্জাতিকমানের করে গড়ে তুলতে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের আওতায় নিরাপত্তা রক্ষায় কারা কর্মকর্তাদের ‘কারেকশনাল অফিসার’ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। বর্তমানে কারারক্ষীসহ সকল শ্রেণীর যোগ্য কর্মচারীদের জাতিসংঘের মিশনে প্রেরণেরও উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। ‘রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’ কারাগারের এ মূলমন্ত্রকে পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে সত্যিকারার্থেই মনযোগ দিয়েছে কারা অধিদফতর। এরই অংশ হিসেবে ২০১৪ সাল থেকে নিয়মিত কারা সপ্তাহ পালন করে নিজস্ব পরিকল্পনায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নসহ সরকারের নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বন্দীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ এ বন্দী প্রশিক্ষণ ও পুর্নবাসন স্কুল স্থাপন, বন্দীর প্রশিক্ষণের জন্য ডিজিটাল প্রিন্টিং প্রেস ও কারা বেকারি চালু, টাঙ্গাইল কারাগারে প্রথমবারের মতো বন্দীর সঙ্গে স্বজনদের মোবাইল ফোনে কথা বলার পদ্ধতি চালু করা বন্দী জীবনে এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। আটককৃত সকল বন্দীর তথ্য সংরক্ষণের জন্য নিজস্ব উদ্যোগে ‘ইনমেইড ডাটাবেইজ’ তৈরির উদ্যোগ, আটক সকল বন্দীকেই অপরাধী হিসেবে না ভাবতে কারাবন্দীদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় তথা বন্দী দরবার নিয়মিতকরণ করা, কারাবন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কম্বলের পরিবর্তে মাথায় বালিশ সরবরাহ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া আটক নারীদের সঙ্গে থাকা ৬ বছরের নিচের শিশুদের জীবন নির্বিঘœ করতে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের আনন্দভুবন ডে কেয়ার সেন্টার নির্মাণ ও পার্ক তৈরি করা হয়েছে। এর বাইরেও প্রতিটি পুরনো কারাগারে ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ বন্দীর খাদ্যাভাস পরিবর্তন ও খাবারের মানোন্নয়ন করেছে। খাওয়ার অযোগ্য চালের ভাত দেয়া হলেও বর্তমানে তা পাল্টে ভাল চালের ভাত, স্বাস্থ্যসম্মত তরকারী, খাবারের অনুপযোগী ডাল বাদ দিয়ে উন্নতমানের ডাল সরবরাহ করছে। একইসঙ্গে খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ ও মাংসের অনুপস্থিতি থাকায় মাছ মাংসের পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে অতি দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তনশীল কারাগারের ভেতরে বাইরে পাল্টে যাওয়া দৃশ্য দেখে পূর্বের রাজনৈতিক, রাষ্ট্রদ্রোহী বা বিভিন্ন মামলায় কারাগারে আসা পুরাতন বন্দীরা নতুন করে প্রবেশের পরই সার্বিক পরিবেশ দেখে থমকে যাচ্ছেন। কারাগারের ভেতরে বাইরে পরিবর্তনের কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। বন্দীর স্বার্থে চলমান সকল সমস্যা চিহ্নিত করে ব্রিটিশ আমলে ১৮৯৪ সালের প্রিজন্স এক্ট সময়োপযোগী করে সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরপরই বর্তমান জেলকোড পরিবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে। অপরদিকে কারাভ্যন্তরে আটক বন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতে নতুন নতুন ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ করা হচ্ছে। ভিআইপি, অসুস্থ ও আদালতের নির্দেশপ্রাপ্ত বন্দীদের আনা নেয়ার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ২টি হাই সিকিউরিটিযুক্ত ওয়েব বেইজড প্রিজন ভ্যান ক্রয় করা হয়েছে। এছাড়া বৃহৎ আকারের ও বিশাল বাজেটের অধিক বন্দী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নতুন নতুন কারাগার স্থাপন, বন্দীর খাবারের মান উন্নতকরণ, প্রিজন্স ক্যাশ বা পিসির টাকায় আটক বন্দীর ইচ্ছেনুযায়ী ভালমানের খাবারের সরবরাহ করা, প্রতিটি বন্দীর সঠিক পরিমাণ খাবার প্রাপ্তি নিশ্চয়তা প্রদান, অস্বাস্থ্যকর ও পুরনো কম্বলের পরিবর্তে উন্নতমানের স্বাস্থ্যসম্মত কম্বল সরবরাহ করা হচ্ছে। আটক প্রায় ৭০ হাজার বন্দীর মধ্যে প্রতিটি বন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্থায়ী সমাধান করতে স্থায়ীভাবে ডাক্তার নিয়োগের কথা ভাবছে। বন্দীর থাকার স্থান সঙ্কট কাটাতে বিশাল আয়তনের নতুন নতুন কারাগার নির্মাণ করছে। ফলে থাকার স্থানের সঙ্কট অনেকাংশে কমে এসেছে। কারাগারে অপরাধী হিসেবে প্রবেশ করলেও বাহিরে গিয়ে স্বাবলম্বী হতে বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণ প্রদান ও সরকারী সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। টাইলস ফিটিং, জুতা তৈরি, বেকারি পণ্য তৈরি, নারীদের জন্য সেলাই ও বিউটিফিকেশন কোর্স চালু করা, নতুন নতুন কুঠির শিল্প তৈরির প্রশিক্ষণ, কারাভ্যন্তরে গার্মেন্টস স্থাপনসহ মোট ৩৮টি ট্রেডে বন্দীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। প্রথমবারের মতো কারাবন্দী কর্তৃক উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করে মিনি প্যাভিলিয়ন ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার গ্রহণ করেছে কারা বিভাগ। এর ফলে প্রতিবছর শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে কয়েক হাজার বন্দী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাইরে এসে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। প্রশিক্ষিত কর্মক্ষম হয়ে গড়ে উঠার ফলে বন্দী অপরাধীরা বাইরে এসে সমাজের মূল ধারায় ফিরতে এসব প্রশিক্ষণ বিশেষ ভূমিকা পালন করছে ও সমাজে অপরাধের হার কমতে শুরু করছে। শুধু কারাবন্দীর কল্যাণই নয় কারাগারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের জীবনমানেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। প্রথমবারের মতো কারারক্ষীদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের পর চাকরীতে যোগদানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দীর্ঘবছর আটকে থাকা যোগ্য কয়েক হাজার কারা কর্মকর্তা কর্মচারীর পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। সাড়ে সাত হাজার বন্দীর দেশের সবচেয়ে পুরনো কারাগার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার মাত্র একদিনে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা ছাড়াই কেরানীগঞ্জে সফলভাবে স্থানান্তর করা কারা ইতিহাস ভঙ্গ করেছে। এত সংখ্যক বন্দী এত কম সময়ে নিরাপত্তার মাধ্যমে স্থানান্তর করা যা এশিয়ায় প্রথম। কেরানীগঞ্জ কারা কমপ্লেক্স এলাকায় বঙ্গবন্ধু কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে একইসঙ্গে পুরান ঢাকার বকশিবাজারে কারা ইনস্টিটিউট স্থাপন করে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিভিন্ন প্রকার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের স্থানটিকে পুরনো ঐতিহ্যবাহী কিছু ভবনকে ঠিক রেখে স্থানটিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে কারা কল্যাণ ভবন, সবুজ বেষ্টিত বিশেষ পার্ক, সুইমিং পুল, বঙ্গবন্ধু কারা স্মৃতি যাদুঘর ও জাতীয় চার নেতা স্মৃতি যাদুঘর ছাড়াও কারা যাদুঘর স্থাপনসহ পুরান ঢাকার বিনোদনের অন্যতম স্থানে রুপান্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুশাসন প্রতিপালনে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছে কারা অধিদফতর। এছাড়া চাকরিতে উৎসাহ বাড়াতে কারা কর্মচারীদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ এথলেটিক্স টিম গঠন ও নিয়মিত জাতীয় প্যারেডে অংশগ্রহণ করছে কারা বিভাগ। দেশের সকল কারাগারের সম্পত্তি রক্ষায় প্রত্যেক কারাগারের সীমানা দেয়াল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সারাদেশে আটক প্রায় ৭০ হাজার বন্দী ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রথমবারের মতো কেরানীগঞ্জে কারাবন্দীর পাশপাশি কারা কর্মকর্তা কর্মচারীর সুচিকিৎসায় ৩ শত শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। একইস্থানে নতুন আরেকটি মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। নারী কারারক্ষীদের সুবিধার্থে আবাসন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ, পুরুষ কারারক্ষীদের জন্য পুরুষ ব্যারাক নির্মাণ, ৩ হাজার ১০৭টি নতুন পদ তৈরি, নতুন প্রায় ৫ হাজারের বেশি জনবল নিয়োগসহ জাতিসংঘের আওতায় নিরাপত্তা রক্ষায় কারা কর্মকর্তাদের প্রেরণ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এছাড়া কারারক্ষী, হাবিলদার, সুবেদারসহ সংশ্লিষ্টদের ইউএন মিশনে প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কারাগারের দায়িত্বরতদের মূল বেতনের অতিরিক্ত ৩০ ভাগ ঝুকি ভাতা প্রবর্তন, কারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্প ও স্বাস্থ্য বীমা চালু, কর্মচারীদের রেশনের খাবারের মান পরিবর্তনসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কারাসূত্র জানায়, কারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিভিন্ন প্রকার উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বহির্বিশ্বে প্রেরণ, কর্মকর্তা কর্মচারীদের সরকারী বেতন ভাতা বৃদ্ধি, উন্নত পরিধেয় পোশাকের ব্যবস্থা করা, নিরাপত্তা রক্ষায় ডিজিটাল নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবহার করা নিরাপত্তা প্রদান এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। যে কোন অভিযোগের বা দুর্ঘটনা এড়াতে, তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করতে ও কারা কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে কারা গোয়েন্দাদের সেনাবাহিনী কর্তৃক উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান ও আধুনিক প্রযুক্তিপন্য ব্যবহার করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে অধিদফতরের সঙ্গে দেশের সকল কারাগারের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বিশেষ সুবিধা সম্পন্ন কেন্দ্রীয় আইটি সেলের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকারের যে কোন নির্দেশনা সকল কারাগারে পৌঁছাতে প্রতিটি কারাগারে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু করাসহ বন্দীর সঙ্গে অবৈধ ও নিষিদ্ধ পন্য নিয়ে প্রবেশ রোধে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা রক্ষা করছে। এজন্য দেশে প্রথমবারের মতো অত্যাধুনিক ‘বডি স্ক্যানার’ লাগেজ স্ক্যানার, হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ে গেইট স্থাপন, প্রতিটি কারাগারের ভেতরে ও বাইরের সীমানায় ও স্বাক্ষাতকক্ষসহ নিরাপত্তা নিশ্চিদ্র করতে অসংখ্য ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। ফলে কারাগারের নিরাপত্তায় এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ বাস্তবায়নে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার ফলে দ্রুতই পৌঁছে যাচ্ছে সকল নির্দেশনা ও আর সঙ্গে সঙ্গেই তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে। কারাসূত্র জানায়, কারাবিধি লঙ্ঘন করে যে কোন কারা কর্মকর্তা কর্মচারী কোন প্রকার নীতি বহির্ভূত কাজ করলেই শাস্তি প্রদানসহ চূড়ান্ত প্রয়োজনে চাকরিচ্যুতই করা হচ্ছে। কারাসূত্র জানায়, শুধুমাত্র নিজে মাদক সেবন ও কারাভ্যন্তরে আটক বন্দীদের মাদক সরবরাহের অভিযোগে কমপক্ষে বিশজনের বেশি কারা কর্মচারীকে গত এক বছরে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিন জনকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করা হয়েছে বাকিদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কঠোর শৃঙ্খলা রক্ষার পাশপাশি কারাবন্দীদের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা প্রদানে কারা কর্তৃপক্ষ সদা তৎপর। কারাগারে মাদক ও মোবাইল ফোন প্রবেশে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ কারা নিরাপত্তাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। ২শ’ ২৮ বছরের ইতিহাসে চাকরিতে প্রবেশের জন্য কোন কারারক্ষীকে কারাগারের দায়িত্ব পালন করতে কোন প্রকার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হতো না। চাকরিতে নিয়োগ প্রাপ্তির দিন থেকেই হাতে একটি লাঠি নিয়ে কারারক্ষীকে দায়িত্ব পালন করতে হতো। ফলে পরবর্তী চাকরি জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষায় ও দায়িত্ব পালনে প্রতিনিয়ত সমস্যার সৃষ্টি হতো। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কারা অধিদফতর প্রতিটি কারারক্ষীকে নিয়োগের আগেই ৬ মাস প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছে। দায়িত্বরতদের উৎসাহ যোগাতে চাকরি থেকে অবসরের পর পেনশন নিয়ে কোন কারারক্ষী বা কারা কর্মকর্তাগণ যেনো বছরের পর বছর ঘুরতে না হয় ও চাকরি জীবনে নির্দিষ্ট সময়ে অধঃস্তনদের এসিআর প্রদানের জন্য উর্ধতনদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারা অধিদফতরকে বেশি কাজের স্বার্থে মূল ভবনকে উর্ধমুখী সম্প্রসারণ করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো ঢাকায় ১ হাজার আসনের কারা কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ করা, বন্দীর তথ্যসহ সংবাদ জানতে কারা মহাপরিদর্শক থেকে শুরু করে প্রতিটি জেলায় স্থায়ী কর্পোরেট মোবাইল নাম্বার প্রদান করা হয়েছে। ফলে বন্দী কারাগারে প্রবেশ কিংবা জামিনের বিষয়ে যে কোন ব্যক্তি এসব নাম্বারে ফোন করে সহজেই তথ্য পাচ্ছেন। মূলত কারাগার তথা বন্দীর উন্নয়নে কারা কর্তৃপক্ষ কর্মকা- চলমান থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৬ শতাংশ মাদকাসক্ত বা মাদক মামলায় অভিযুক্ত কারাবন্দীর প্রয়োজনে মাদক গ্রহণে তৎপর হয়ে বিভিন্ন পথে কারাভ্যন্তরে মাদক সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। যা বন্ধ করতে পারছে না কারা কর্তৃপক্ষ। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে কারাভ্যন্তরে বন্দীকে অধিক সুবিধা প্রদান, অসুস্থ না হয়েও কিছু ভিআইপি বা ধনী বন্দী বিনা কারণে বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসার নামে সময় ক্ষেপণের অভিযোগ থেকে মুক্তি মিলছে না। এছাড়া জনবল প্রয়োজনের তুলনায় না বাড়ানো, কারারক্ষীদের সাপ্তাহিক কোন ছুটি না থাকা, সংশোধনার হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যাপ্ত সংখক কারেকশনাল অফিসার নিয়োগের ব্যবস্থা করা, অতি জরুরী ভিত্তিতে প্রতিটি কারাগারে ডাক্তার, নার্স, ফার্মাসিস্ট বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ করা, সকল কারাগারে কারারক্ষীদের স্বাস্থ্যসম্মত সুন্দর আবাসন ও ব্যারাক নির্মাণ নিশ্চিত করা, সন্তানদের শিক্ষার জন্য সকল কারাগারে নিজস্ব স্কুলের ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা সমস্যার সমাধান অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। এ বিষয় সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে তবেই কারাগার প্রকৃতপক্ষে সংশোধনাগারে রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, কারাগারকে প্রকৃতপক্ষেই সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় আর অনুশাসনে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করছি। প্রতিটি বন্দীকে আমরা কারাভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সমাজে অপরাধ কমাতে কর্মীর হাতে রূপান্তর করতে চাই। বর্তমানে ৩৮টি ট্রেডে হাজার হাজার বন্দীকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বন্দীর চিকিৎসা প্রদানের ডাক্তারও নার্স নিয়োগ করা, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উন্নত চিকিৎসা দিতে ৩শ’ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ, নতুন নতুন কারাগার স্থাপন, বন্দীর নির্বিঘœ ঘুমের জন্য বালিশ প্রদানের উদ্যোগ, উন্নতমানের কম্বল সরবরাহ করা হচ্ছে। সশ্রম দ-প্রাপ্ত বন্দীদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রির লভ্যাংশের অর্ধেক বন্দীকে প্রদান, উন্মুক্ত কারাগার তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া উৎসাহ বৃদ্ধিতে কারাগারের স্টাফ ও বন্দীদের মাঝে খেলার আয়োজন করা হচ্ছে। কারাগারে মাদক ও মোবাইল প্রবেশ বন্ধ করতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, কারাভ্যন্তরে বন্দীর মানসিক সমস্যা কমাতে মোবাইল ফোনে স্বজনদের কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে পর্যায়ক্রমে সকল কারাগারে তা চালু করা হবে। নিরাপত্তা রক্ষায় দেশে প্রথমবারের মতো বডি স্ক্যানার ও লাগেজ স্ক্যানার, হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ে, আধুনিক শক্তিশালী জ্যামার ক্রয়সহ নানা প্রযুক্তি পণ্য কেনা হয়েছে ও হচ্ছে। আমরা বন্দীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডাল, চালের মান পরিবর্তন করেছি ও মাছ মাংসের পরিমাণ বাড়াতে কাজ করছি। জনাব ইফতেখার বলেন, প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের আওতায় নিরাপত্তা রক্ষায় ইতোমধ্যে ২ কারা কর্মকর্তাদের ‘কারেকশনাল অফিসার’ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। জনবল বৃদ্ধি, আটক মায়ের সঙ্গে শিশুদের বিনোদনের জন্য কারাভ্যন্তরে ডে-কেয়ার সেন্টার চালু ও শিশুপার্ক স্থাপন করা হয়েছে। মূলত কারাগারকে বন্দীর শাস্তি কার্যকরের স্থানই শুধু নয় সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণ প্রদান, অপরাধ থেকে ফেরাতে পরামর্শ প্রদানসহ নানা পদ্ধতিতে সমাজের মূল ধারায় আনতে কারা বিভাগ নিবিড়ভাবে কাজ করছে। মহৎ এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে তিনি সমাজের সকল স্তরের মানুষকে বন্দীর প্রতি অপরাধীমূলক মানসিক পরিবর্তনে কাজ করার আহ্বান জানান।
×