ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বনাশা প্লাস্টিক দূষণ

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৩ এপ্রিল ২০১৮

সর্বনাশা প্লাস্টিক দূষণ

১৯৬৭ সালে রাসায়নিক প্রকৌশলীরা পেট্রোলিয়াম থেকে হাইড্রো কার্বনের বিভিন্ন মলিকুলকে যুক্ত করে তন্তুতে রূপান্তরিত করেন যা দিয়ে ড্রিংক্সের বোতল থেকে শুরু করে বারবি ডল পর্যন্ত যে কোন কিছু তৈরি করা সম্ভব। তারপর থেকে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের উৎপাদন বছরে প্রায় ২০ লাখ টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে আজ ৩৮ কোটি টনে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বৈশ্বিক জিডিপি যে হারে বেড়েছে তার প্রায় তিনগুণ বেশি হারে বেড়েছে প্লাস্টিক উৎপাদন। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৫০-এর দশক থেকে যে ৬৩০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে তার মাত্র প্রায় ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে এবং আরও প্রায় ১২ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। বাকি প্লাস্টিক বড় বড় গর্তে ফেলে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে অথবা খোলা জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় উৎপাদিত প্লাস্টিকের সিংহভাগই হলো ডিসপোজেবল কফি কাপ, ড্রিংক্সের বোতল, খাবারের মোড়ক ও অন্যান্য প্যাকেট। ফেলে দেয়া এই জিনিসগুলো যদি সাগরে গিয়ে মেশে তাহলে ঢেউয়ের তোড়ে দূরের কোন সৈকতে জমা হয়ে সীলকে শ্বাসরুদ্ধ করতে পারে। লবণাক্ত পানি ও অতিবেগুনি রশ্মীর সংস্পর্শে এসে এগুলো খ-িত হতে হতে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হতে এবং তা মাছের পেটে ঠাঁই নিতে পারে। মাছের পেট থেকে সেগুলো ডিনারের প্লেটে আসতে খুব বেশিদূর পাড়ি দিতে হয় না। অনেক দেশ এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে প্লাস্টিক ব্যবহারের ওপর নানা বিধিনিষেধ দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। কেনিয়ায় কেউ প্লাস্টিকের ব্যাগ বিক্রি করলে তার ৪ বছর কারাদ- ও ৪০ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সমস্ত প্লাস্টিকের প্যাকেট ২০৩০ সালের মধ্যে পুনর্ব্যবহার্য করে তোলা এবং বর্তমান রিসাইক্লিংয়ের হার ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ বছরের মধ্যে ৫৫ শতাংশ করা। ২০১৫ সালে ব্রিটেন প্লাস্টিকের শপিংব্যাগের ওপর যে শুল্ক ধার্য করে তার ফলে সেগুলোর ব্যবহার এখন ৮৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। নিজের সুনাম ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কায় বড় বড় কোম্পানিও এগিয়ে আসছে। কোকাকোলা ১১০০০ কোটি প্লাস্টিকের বোতলসহ প্রতিবছর যত ড্রিংক্সের কন্টেনার ছাড়ে সেগুলো সংগ্রহ করে পুনর্ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইউনিলিভার, প্রোক্টার এ্যান্ড গ্যাম্বেলও আরও রিসাইকেল করা প্লাস্টিক ব্যবহারের অঙ্গীকার করেছে। ম্যাকডোনাল্ডসেরও একই পরিকল্পনা আছে। প্লাস্টিক যে পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দৃশ্যমান প্লাস্টিকের দূষণ এক পুরনো অভিযোগ। যেটা নতুন, তা হলো- মাইক্রোপ্লাস্টিক অদৃশ্য ও গুপ্তভাবে মানুষ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে। কিন্তু, সত্যটা এই যে প্লাস্টিকের পরিবেশগত পরিণতি সম্পর্কে কমই জানা আছে এবং যেটুকু জানা আছে তা দারুণ আশঙ্কাজনক নয়। কি পরিমাণ প্লাস্টিক তৈরি হচ্ছে এবং কোথায় গিয়ে তা শেষ হচ্ছে সে ব্যাপারে কি আমাদের নিশ্চিত কোন ধারণা আছে? গত বছর ‘সায়েন্স এডভান্সেস’ নামক এক সাময়িকীতে এই তথ্যটি বেরোয় যে; ১৯৫০-এর দশক থেকে উৎপাদিত অথচ পুড়িয়ে ফেলা বা রিসাইকেল করা হয়নি এমন কঠিন প্লাস্টিকের বর্জ্যরে পরিমাণ ৪৯০ কোটি টন। এগুলো মাটিতে পুঁতে চাপা দিতে গেলে ৭০ মিটার গভীর ও ৫৭ বর্গকিলোমিটার জায়গা অর্থাৎ ম্যানহাটানের সমান এলাকা লাগবে। এগুলো যদি সবটাই জমিতে থাকত কিংবা সাগরের পানিতে ভেসে ভেসে সৈকতে এসে জমা হতো তাহলে সেগুলো সংগ্রহ করা যেত। কিন্তু এর চেয়ে বড় পরিবেশগত ভাবনার ব্যাপার হলো এই প্লাস্টিকের বেশিরভাগ সাগরে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেখানে স্রোতের দ্বারা ছড়িয়ে পড়ায় প্লাস্টিক পুনরুদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছেÑ বিশেষ করে যখন তা ভাঙতে ভাঙতে পরিণত হয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিকে। কম্পিউটার মডেলে দেখা যায় সাগরে ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা আছে। সাগরের লবণ ও সূর্যালোকে প্লাস্টিক ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও প্লাস্টিক যে পলিমার চেন দিয়ে গঠিত সেই পলিমার চেনগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্যান্য যৌগে পরিণত হয় না। সেই পলিমার যদি অধিক তাপমাত্রায় পোড়ানো হয় তা হলেই কেবল প্রধানত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও পানিতে পরিণত হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় প্লাস্টিক পরিবেশে পুঞ্জীভূত হয়। অনেকটা যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড জমা হয় বায়ুম-লে। প্লাস্টিক সাগরে চলে যায় বছরে সম্ভবত ১ কোটি টন। এই প্রবাহ যদি তাৎক্ষণিকভাবে ঠেকানো যায় তারপরও বিপুল পরিমাণ থেকে যাবে এবং এর প্রবাহ বন্ধ হবে না। সাগরের বেশিরভাগ প্লাস্টিক আসে পূর্ব এশিয়ার দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, কারণ সেখানে বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থার হয়ত অস্তিত্ব নেই কিংবা থাকলেও তা ত্রুটিপূর্ণ। গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে সাগরে যাবতীয় প্লাস্টিক বর্জ্যরে ৯০ শতাংশ দশটি নদী দিয়ে আসে। এগুলোর দুটি আফ্রিকায় এবং বাকিগুলো এশিয়ায়। ইয়াংসি নদী একাই ১৫ লাখ টন বর্জ্য সাগরে বয়ে নিয়ে যায়। বর্তমান হারে চলতে থাকলে ওজনের হিসাবে বিশ্বের জলরাশিতে যে পরিমাণ মাছ আছে ২০৫০ সাল নাগাদ তার চেয়ে বেশি প্লাস্টিক থাকবে। প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে যে ৩৬ লাখ টন কঠিন বর্জ্য ফেলা হয় তার প্রায় ১০ শতাংশই প্লাস্টিক। দূষিত বায়ুর কারণে বিশ্বব্যাপী বছরে ৭০ লাখ লোক মারা যায় যাদের প্রায় সবাই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের মানুষ। অন্যদিকে প্লাস্টিক দূষণকে কোন মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী করা হয় না। ল্যানসেটের এক রিপোর্টে দূষণঘটিত মৃত্যুর মোট সংখ্যা ৯০ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছর ৪৫ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে প্লাস্টিকের কথা মাত্র একবার বলা হয়েছে। প্লাস্টিক কতটা ক্ষতিকর সাগরে বেশিরভাগ প্লাস্টিক সমুদ্র স্রোতের ধারায় আবর্জনার বিশাল বিশাল স্তূপে গিয়ে শেষ হয়। সবচেয়ে বড় স্তূপটি দেখতে পাওয়া যাবে উত্তর আটলান্টিকে। মাঝ সমুদ্রের এই বলয়গুলো বিশেষভাবে প্রাণিসমৃদ্ধও নয় আবার সর্বশেষ জৈব বৈচিত্র্যময় নয়। সাগরের প্রাণিসমূহের ওপর প্লাস্টিকের প্রভাব নিয়ে খুব একটা গবেষণা হয়নি। তবে এক গবেষণাপত্রে ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারের কাছে কোয়ালের এক ধরনের যোগের সঙ্গে প্লাস্টিকের আবর্জনার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। গবেষকরা ৪টা প্রাণী শনাক্ত করেছেন সেগুলো হয় প্লাস্টিক পাকস্থলীতে গ্রহণ করেছে অথবা প্লাস্টিকের সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত হয়ে আছে। প্লাস্টিক তার গায়ে পানি লাগতে দেয় না। সে জন্য প্লাস্টিকের অনুকণাগুলো তাদের পরিপার্শ্বের নির্দিষ্ট কিছু যৌগ আকৃষ্ট করতে পারে। পরীক্ষায় দেখা গেছে মাছেরা প্লাস্টিকের টুকরা গিলে ফেললে সেগুলোর সঙ্গে থাকা যৌগগুলো তাদের নাড়িভুঁড়ি থেকে বিশেষায়িত হয়ে মাংসে চলে যেতে পারে। অবশ্য এই বিষাক্ত উপাদানগুলো খাদ্যচক্রে গিয়ে জমা হয় কিনা। যেমনটি পারদ মাছের মধ্যে গিয়ে জমে, এটা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। মানুষের ডায়েটে প্লাস্টিক প্রবেশ করার একটাই মাত্র প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে বেলজিয়ামের বিজ্ঞানীদের পরিচালিত এক গবেষণায়। তারা ঝিনুকের মধ্যে প্লাস্টিকের খ-াংশ আবিষ্কার করেছেন। মাছের ক্ষেত্রে না হলেও এই দ্বিকোষ প্রাণীটির নাড়িভুঁড়িসহ সবকিছু খেয়ে ফেলা হয়। তবে প্লাস্টিক কোনভাবে মানুষের পেটে চলে গেলে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই বলে মনে করেন স্টিফানি রাইট নামে এক গবেষক। তার মতে, পলিমার রাসায়নিক দিক দিয়ে নিষ্ক্রিয় বিধায় এরা নিজেরা স্বাস্থ্যের প্রতি ঝুঁকি সৃষ্টি করে না। থেলেট ও বিসফেনলের মতো অতি প্রচলিত কিছু সংযোজিত উপাদান আছে। থেলেট পিভিসিকে নরম করে আর বিসফেনলে ভোগ্যপণ্যে ব্যবহৃত অনেক ধরনের প্লাস্টিককে শক্ত করে। এই উপাদান রাসায়নিক দিক দিয়ে মানবদেহের হরমোনের মতো। বেশি মাত্রায় এগুলোর সমাবেশ ঘটলে হরমোনের কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। কয়েক দশক ধরে এই দুটি উপাদান পাইপ থেকে শুরু করে শ্যাম্পুর বোতল পর্যন্ত সবকিছুর ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত। কারণ মানবদেহের সংস্পর্শের মধ্য দিয়ে এর নিরাপদ সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। বাড়ন্ত শিশুদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকার কারণে আমেরিকায় এখন খেলনা ও শিশু পরিচর্যার কিছু কিছু পণ্যে থালেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একটি সংস্থা প্লাস্টিকের কারণে সমুদ্রে সৃষ্ট আবর্জনার খরচ হিসাব করে দেখেছে যে বছরে সেটা ১৩০০ কোটি ডলার। এটা মূলত মৎস্য সম্পদ, পর্যটন ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাবের ব্যয়। প্লাস্টিক দূষণের সার্বিক সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যয় বছরে ১৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এর অর্ধেকটা প্লাস্টিক উৎপাদন ও পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনের জলবায়ুগত প্রতিক্রিয়া থেকে উদ্ভূত। এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় স্বাস্থ্য, ফসল ও পরিবেশের ওপর প্লাস্টিকের সঙ্গে সম্পর্কিত বায়ু, পানি ও মাটি দূষণের প্রভাব থেকে সৃষ্ট। এর সঙ্গে আছে বর্জ্য অপসারণের খরচ। ইউএনডিপির হিসাবে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের এবং জমি থেকে সার বৃষ্টিবিধৌত হয়ে নদ-নদী ও পরিশেষে সাগরে গিয়ে মেশার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ যথাক্রমে বছরে ৫ হাজার কোটি ডলার ও ২০ হাজার থেকে ৮০ হাজার কোটি ডলার। বায়ুম-লের কার্বন- ডাই-অক্সাইড পানিতে মিশে যে অম্লত্ব সৃষ্টি হয় তাতে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রে অম্লত্ব বৃদ্ধির কারণে ক্ষতির পরিমাণ বছরে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার হতে পারে। মানুষের সৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানি উষ্ণ হয়ে ওঠাজনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা কঠিন। তবে সেই ক্ষতি সুবিশাল হওয়ারই সম্ভাবনা। এই উচ্চতা বৃদ্ধির পেছনে প্লাস্টিকের ভূমিকা যে একেবারে কম তা মনে করার কারণ নেই। এক কিলোগ্রাম প্লাস্টিক বানাতে গেলে ২ থেকে ৩ কিলোগ্রাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়ে বায়ুম-লে গিয়ে মেশে। ইস্পাত তৈরিতেও একই পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×