ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চেন স্টোরগুলোর গ্রাহক সেবা

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৩ এপ্রিল ২০১৮

চেন স্টোরগুলোর গ্রাহক সেবা

দেশে আজ উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রাচীন ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বরং এক ধরনের মানি মেট্রিক সোসাইটিতে জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। সময় ও সাশ্রয়ী মূল্যের প্রত্যাশায় অনেকে বাজারে না গিয়ে চেন স্টোরে যাচ্ছে। অধুনা কিছু চেন স্টোর দেশে গড়ে উঠেছে। এগুলোতে আবার একটি কিনলে আরেকটি ফ্রি দিচ্ছে। লোভনীয় অফার অথচ তলে তলে গলাকাটা দাম রাখছে। এমন হারে দাম রাখছে যে, মানুষের বোঝার উপায় নেই। ধরুন বাজারে আদার দাম ১২০ টাকা যখন কেজি তখন তারা বিক্রি করছে ২৮০ টাকা কেজি। আবার চালের দাম বাজারে যখন ৫০ টাকা কেজি তখন বিক্রি করছে ৬৬ টাকা করে। ব্যবসার নানা ফন্দি-ফিকির আছে। এদের দেখার কেউ নেই। এমনকি এদের কোন আউটলেটে ক্রেডিট কার্ডে ডাবল পেমেন্ট হয় অনেক কষ্টে সে টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হই। আসলে আজকাল মানুষ সময় বাঁচাতে চায়। এদিকে বিভিন্ন আকর্ষণীয় ও লোভনীয় অফার এদের মধ্যে হামবড়া ভাবের সৃষ্টি করছে। অভিযোগ রয়েছে একটি চেন স্টোর কোম্পানির বিরুদ্ধে, তারা কাওরানবাজার থেকে মাছ কিনে তাতে ফরমালিন মেশায়। তবে সবচেয়ে বড় কথা তাদের ব্যবহার। ভিডিও ফুটেজের যথেচ্ছ ব্যবহার করে নিরীহ ক্রেতাদের তারা ব্ল্যাকমেইল করে। এমনও দেখা গেছে সকালে মাল কিনে নিয়ে গেছে। বাসায় গিয়ে টের পেয়েছে মাল দেয়নি। বিকেলে দোকানে গেছে সোজাসাপটা জবাব মাল দেয়া যাবে না। শুধু তাই নয় তারা ক্রেতাদের প্রতি নিরীহ পেলে মানসিক নির্যাতন পর্যন্ত পিছপা হয় না। স্বাভাবিক বাজারমূল্যের অতিরিক্ত দাম দিয়ে তারা যেভাবে মানুষের পকেট কেটে চলেছে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ক্রেতার অধিকার স্বার্থ ক্ষুণœ হলেও দেখার কেউ নেই। আবার তারা বিভিন্ন সময় পণ্য কিনলে তাদের কার্ড দেয় সেটিও আরেক ধরনের ধান্ধা। ধান্ধাবাজিতে চেন স্টোরগুলোর অধিকাংশই ভরে গেছে। যেমন ধরুন একটি পণ্যের দাম থাইল্যান্ডে দশ বাথ। অথচ এটি বিক্রি করে ১৮০ থেকে ২৪০ টাকায়। ইচ্ছামাফিক পণ্য বিক্রি করলেও তারা দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। এদের অপকর্মের শেষ নেই। এমনকি মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য আবার একটি কিনলে একটি ফ্রি বলে বিক্রি করে। তাদের এ ধরনের অন্যায় আচরণ যারা সময় ও সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে যান তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে কেবল বেআইনী কাজকারবার করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং গ্রাহক হয়রানি করে থাকে। ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঝে-মধ্যে ফাইন করে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আবার তারা গ্রাহকদের ঠকায়। তারা বিভিন্ন পণ্যের বহুধাবিভক্তকরণ করে গ্রাহকদের অর্থের ক্ষতি করে থাকে। সাশ্রয়ী মূল্যে ক্রয়ের কথা বলে লুম্পেন বুর্জোয়ার মতো আচরণ করে। এমনকি গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের পাশাপাশি মিথ্যা বদনাম চোর অপবাদ দিতে দ্বিধা করে না। এ ধরনের চেন স্টোরগুলো কিভাবে আচার-আচরণ করে চলেছে তা দেখার জন্য পর্যাপ্ত আইনের অভাব এবং ক্ষমতালোভী একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে ঙষরমঢ়ড়ষরংঃরপ (ওলিগোপলিস্টিক) নেচারের কার্টেলের মাধ্যমে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী কর্মকর্তা বেনিয়াবৃত্তিতে আবদ্ধ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এ ধরনের অসাধু কর্মকা- দেশের ও জাতির ক্ষতি করছে। তারা যে ধরনের কর্পোরেট বাণিজ্য শুরু করেছে তাতে যদি সঠিক মাত্রায় যাচাই-বাছাই না করা হয় তবে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা যাচ্ছে। মাঝখান থেকে প্রতি সপ্তাহান্তে কিছু পণ্যের দাম কমিয়ে অন্য দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে তারা আদায় করে নেয়। তারা যে ধরনের আচার-আচরণ করে, তাদের কর্মচারী-কর্মকর্তারা ন্যূনতম সৌজন্যতাবোধ দেখানোর প্রয়াস পায় না। তারা ভাল যুবক-যুবতীর ভুলের ক্ষেত্রে এমনকি চোরের অপবাদ দিতে দ্বিধা করে না। তাদের এরিয়া সেলস ম্যানেজারসহ আউটলুক ব্যবস্থাপকদের ব্যবহার হচ্ছে লর্ডদের মতো। দেশে বেসরকারী ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠুক। কিন্তু তাই বলে পেশাদারিত্বের অভাব অন্যায্যভাবে দাম উসুল করে নেয়া! ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ডাবল পেমেন্ট করা, নিরীহ ক্রেতার ভুলের সুযোগ নিয়ে চোর অপবাদ দেয়া, দ্রব্যের জন্য বললে অপেক্ষার প্রহর গণনা করা, ধীরে ধীরে দাম বাড়িয়ে দেয়া, মাছে ফরমালিন মেশানো তারপরও চেন স্টোরগুলো দেশের প্রচলিত আইন-কানুনের তোয়াক্কা করে না। ফলে এ চেন স্টোরগুলোর কারণে অনেক সময়ে বর্তমান সরকারের আমলে দ্রব্যের দাম বাড়ছে বলে প্রতীয়মান করার অপপ্রয়াস গ্রহণ করেছে। আবার দ্রব্যের পরিমাণ কম দিলে তখন আর ফেরত দেয় না। বরং তারা এমনভাবে ফুলে-ফেপে উঠেছে যে, বেনিয়াবৃত্তি আর গ্রাহকসেবার বদলে এখন গ্রাহক হয়রানি হচ্ছে। অধিক দাম নেয়ার জন্য তাদের কোন ধরনের জবাবদিহিতা নেই। দেশে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় বেসরকারী খাতে চেন স্টোরসমূহ গড়ে ওঠা দরকার। তারা অনেক সময়ে ক্রেতাদের মানসম্মান নিয়ে হয়রানি করে থাকেন। ফরমালিন মেশানো আইনত দ-নীয় হলেও অনেক চেন স্টোর এখনও এ ধরনের কাজ করে চলেছে। দেশে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ অধিকার না থাকায় এমন ধরনের সুযোগ এই চেন স্টোরগুলোয় গড়ে উঠেছে। একজন গ্রাহক জানালেন যে, কার কাছে কমপ্লেইন করবে? তাদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কোন পন্থা যে নেই। আবার প্রতি শুক্রবার যে ধরনের ডিসকাউন্ট দেয়া হয় সেটা এক ধরনের লোক ঠকানোর মনোবৃত্তি। বিদেশে সুপার শপ এবং চেন স্টোরগুলো যেভাবে গ্রাহকসেবা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রাহকসেবা দিয়ে থাকে তা এদের ধারে-কাছেও নয়। আর লোক ঠকানো সেটা ওই সব শপিং মলে গেলে সচরাচর ঘটে না। আর আমাদের দেশে রাজা-মহারাজা কিংবা পাইক-পেয়াদার মতো গ্রাহকসেবা দিয়ে থাকে। এ ধরনের আচরণের প্রতিবাদ ও প্রতিকারের কেউ নেই। অবৈধভাবে চোরাচালানকৃত অনেক পণ্য বিক্রি করে সম্প্রতি একটি চেন স্টোরের আউটলুকে একজন ক্রেতা পণ্য কিনতে গিয়ে একটি পণ্য কিনে চলে আসছিল। ভুলে গিয়েছিল আরেকটি পণ্যের প্যাকেট করে রাখতে বলেছিল। সে যখন একটি পণ্যের দাম দিয়ে চলে আসছিল তখন ওই পণ্যটি তাকে ধরিয়ে দেয়া হয়। যেহেতু সে সচরাচর বাজার করে না, সে ভুলে গিয়েছিল দাম দেয়নি। এদিকে সে যে ইতোমধ্যে গাড়ির তেলের দাম দিয়ে দিয়েছে সেটাও মনে নেই। তারপর তাকে চরম অপমান করা হয়। যখন দেশের বাইরে থেকে এসে তার বাবা সরাসরি সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন গার্জিয়ানকে জানানো হলো না? কেননা মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। কিন্তু গার্জিয়ানকে না জানানো যে অপরাধ ম্যানেজার করেছে সেটি কহতব্য নয়। একজন যুবকের গায়ে মিথ্যা কলঙ্কের তিলক গ্রীন রোডের আউটলুক লাগাতে দ্বিধা করেনি। তারা যদি বুঝতে না পারে কোন্টা ইচ্ছাকৃত ভুল আর কোন্টা অনিচ্ছাকৃত ভুল তাহলে সেখানে ওই লোকদের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয়ার অর্থ কি? গার্জিয়ানকে না জানিয়ে কেবল ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে সত্য না বুঝে মিথ্যা বদনাম দিয়ে, দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের হয়রানি করার বিষয়টি আজ বিচার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশ থেকে অবৈধ পণ্য অনেক ক্ষেত্রে বিক্রি হচ্ছে। অতি মুনাফালোভীরা এ সমস্ত কাজ করছে। আমার বিশ্বাস আইনের প্রয়োগ ঘটলে এ চেন স্টোরগুলো তাদের বেনিয়াবিৃত্তি, গ্রাহক হয়রানি এবং দুর্বৃত্তায়নের কলাকৌশল থেকে বেরিয়ে আসত। যাদের নিয়োগ করা হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ৭০%-এর গ্রাহকসেবার মনমানসিকতা নেই বলে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে। মিথ্যা অপবাদ দেয়া হলেও তার কোন বিচার্য নেই। অথচ অন্য আউটলুক থেকে ক্রেডিট কার্ডে ডাবল পেমেন্ট হলেও সেটি কিন্তু জানানো হয়নি। সঠিক দামে সঠিক পণ্য কেনায় যাতে ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার, তথাকথিত ছাড় দেয়ার নাম করে অন্য পণ্যে দাম বাড়িয়ে অধিক লাভের ব্যবসা বন্ধ হওয়া উচিত। ভাল-মন্দ বোঝা, কর্মী প্রশিক্ষণ, বেনিয়াবৃত্তির পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। চেন স্টোরগুলোতে আইনের প্রয়াগ দরকার। লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ও অধ্যাপক [email protected]
×