ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হংকংয়ে চার জাতি আন্তর্জাতিক ইয়ুথ ফুটবল টুর্নামেন্ট ॥ তহুরার আরেকটি নয়নাভিনাম হ্যাটট্রিক র‌্যাঙ্কিংয়ে ৩১ ধাপ পিছিয়ে থেকেও দুর্দান্ত জয় মারিয়াদের সর্বোচ্চ গোলও তহুরার এই আসরে ৩ খেলায় পূর্ণ ৯ পয়েন্ট ও সর্বোচ্চ ২৪ গোল বাংলাদেশের বিদেশের মাটিতে এটি;###;মেয়েদ

হংকংকে বিধ্বস্ত করে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ২ এপ্রিল ২০১৮

হংকংকে বিধ্বস্ত করে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

রুমেল খান ॥ না, আশঙ্কাটা ছিল নিতান্তই অমূলক। পচা শামুকে পা তো কাটেইনি বরং শামুকই হয়েছে কচুকাটা। প্রতিপক্ষকে নিজেদের মাটিতে হারিয়ে শিরোপা জেতার মজাই আলাদা। সেই মজাটাই পেল দলটি। শেষ ম্যাচে ফেবারিট হলেও তাদের ভয় ছিল দুটি। এক. প্রতিপক্ষ ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ৩১ ধাপ এগিয়ে। দুই. প্রতিপক্ষ অচেনা, তাদের বিরুদ্ধে এর আগে কখনই ও কোন পর্যায়েই খেলা হয়নি। কিন্তু সেই ভয়কে তুড়ি মেরে জয় করেছে গোলাম রব্বানী ছোটনের সুযোগ্য শিষ্যারা। চার জাতি অ-১৫ নারী ফুটবল আসর ‘জকি ক্লাব গার্লস ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ ইনভাইটেশনাল ফুটবল টুর্নামেন্টে’ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। শিরোপা জয়ের পথে তাদের এক পা বাড়িয়ে দেয়া ছিল আগেই। সিঙ্গেল লীগ পদ্ধতির টুর্নামেন্ট বলে ফাইনাল বলে কিছু ছিল না। তাই শেষ ম্যাচে শিরোপা জিততে বাংলাদেশের দরকার ছিল কমপক্ষে ড্র। আর সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের জন্য নিশ্চিতভাবেই ম্যাচটি ছিল ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচ। কিন্তু ওসব ড্র-ফ্র’র ধার ধারেনি ‘দ্য বেঙ্গল টাইগ্রেস’ দল। সিউ সাই ওয়ান স্পোর্টস গ্রাউন্ডে রবিবারের ‘অলিখিত’ ফাইনালে তারা রীতিমতো শোচনীয়ভাবে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে স্বাগতিক হংকংকে। ৬-০ গোলে স্রেফ উড়িয়ে দেয় তারা। খেলার প্রথমার্ধেই বিজয়ী দল এগিয়ে ছিল ৩-০ গোলে। দলের জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ফরোয়ার্ড তহুরা খাতুনের। গত ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও সে করেছে চোখ ধাঁধানো আরেকটি হ্যাটট্রিক। এছাড়া ১টি করে গোল করে সাজেদা খাতুন, শামসুন্নাহার এবং আনুচিং মগিনি। দিনের অপর ম্যাচে ইরান ১-১ গোলে ড্র করে মালয়েশিয়ার সঙ্গে। এই ড্রতে ইরান তৃতীয় ও মালয়েশিয়া চতুর্থ হয়ে আসর শেষ করলো। যদিও দু’দলের পয়েন্ট সমান। কিন্তু গোল গড়ে এগিয়ে থাকায় ইরান তৃতীয় হয়। চার জাতির এই আসরে ৩ খেলায় সর্বোচ্চ ৯ পয়েন্ট পেয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। বাকি দুই খেলায় তারা মালয়েশিয়াকে এবং ইরানকে হারায় যথাক্রমে ১০-১ এবং ৮-১ গোলে। পক্ষান্তরে ৩ খেলায় ৬ পয়েন্ট পেয়ে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলো স্বাগতিক হংকংকে। বাকি দ্ইু খেলায় তারা ইরান ও মালয়েশিয়াকে একই ব্যবধানে (১-০) হারায়। চ্যাম্পিয়ন হবার দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। ২ খেলার তাদের পয়েন্ট ছিল ৬। তবে সমান ম্যাচে সমান পয়েন্ট ছিল স্বাগতিক হংকংয়েরও। কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে গোল গড়ে অনেক পিছিয়ে ছিল তারা। যেখানে বাংলাদেশের গোলগড় ছিল +১৬, যেখানে হংকংয়ের গোলগড় ছিল মাত্র +২। তবে গোল হজমের ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে ছিল বাংলাদেশের চেয়ে। যেখানে বাংলাদেশ খেয়েছিল দুই গোল, সেখানে হংকং তখনও কোন গোল হজম করেনি। কিন্তু অলিখিত ফাইনালে তাদের সেই অহঙ্কার ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় আঁখি-ঋতুপর্ণা-মনিকারা। সেই সঙ্গে টুর্নামেন্টের প্রথম হারের তেতো স্বাদটিও। শিরোপা জেতার পাশাপাশি একাধিক অর্জন-প্রাপ্তি নিয়ে ফিরছে লাল-সবুজবাহিনী। টুর্নামেন্টে তারাই করেছে সবচেয়ে বেশি গোল ২৪টি। অথচ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩টি করে গোল করেছে বাকি দলগুলো। টুর্নামেন্টে যে তিনটি হ্যাটট্রিক হয়েছে তার প্রতিটিই করেছে বাংলার বাঘিনীরা। এর দুটিই আবার ‘ময়মনসিংহের মেসি’ খ্যাত ফরোয়ার্ড তহুরা খাতুনের। আরেকটি মিডফিল্ডার শামসুন্নাহারের। তহুরা আবার টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতাও বটে। তার গোলসংখ্যা ৮। দ্বিতীয় স্থানে থাকা শামসুন্নাহারের গোলসংখ্যা ৬। তৃতীয় স্থানটিও বাংলাদেশের, তাও যুগ্মভাবে। আনুচিং মগিনি ও আনাই মগিনি। দুই বোনের গোলসংখ্যা সমান ৩টি করে। বিদেশের মাটিতে এটি বাংলাদেশের মেয়েদের তৃতীয়, অ-১৫ দলের দ্বিতীয় এবং সার্বিকভাবে জেতা পঞ্চম শিরোপা। এর আগে তারা ২০১৫ সালে নেপালে ‘এফসি অ-১৪ বালিকা আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ’ এবং ২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে একই দল একই আসরের শিরোপা জিতেছিল। এছাড়া ২০১৬ সালে এএফসি অ-১৬ আসরের আঞ্চলিক বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছিল দেশের মাটিতে। বলাই বাহুল্য, প্রতিটি দলের ও শিরোপা জয়ের মূল কারিগর ছিলেন কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। এখানে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। হংকংয়ের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ যে তিনটি দলকে হারিয়েছে তাদের সবাই কিন্তু ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে সিনিয়র পর্যায়ে বাংলাদেশের (র‌্যাঙ্কিং ১০২) চেয়ে অনেক ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। যেমন ২২ ধাপ এগিয়ে মালয়েশিয়া (র‌্যাঙ্কিং ৮০), ৩১ ধাপ এগিয়ে হংকং (র‌্যাঙ্কিং ৭১) এবং ৪৪ ধাপ এগিয়ে ইরান (র‌্যাঙ্কিং ৫৮)। প্রতি ম্যাচেই বাংলাদেশ দলের একাধিক ফুটবলার গোল করে। ৩ ম্যাচে ৭ ফুটবলার করে মোট ২৪ গোল। এ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার- গোল করার ক্ষেত্রে দল নির্দিষ্ট কারুর ওপর নির্ভরশীল নয়। আরও লক্ষণীয়, এই সাতজনের আবার চারজনই ডিফেন্ডার। মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে ছোটনের শিষ্যাদের কেউই হ্যাটট্রিক করতে পারেনি (হ্যাটট্রিক বঞ্চিত হয় তিনজন) এবং ১০টি গোল করে সাত ফুটবলার। ইরানের বিরুদ্ধে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দুই ফুটবলার (হ্যাটট্রিক বঞ্চিত হয় একজন) এবং ৮টি গোল করে চার ফুটবলার। আর হংকংয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে এক ফুটবলার এবং ছয় গোল করে চার ফুটবলার। এখন আবারও ফেরা যাক রবিবারের ‘অলিখিত’ ফাইনাল প্রসঙ্গে। ম্যাচের শুরু থেকেই হংকংকে আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে বাংলাদেশ। ৪ মিনিটেই উদ্বোধন করে ফেলে ‘গোলের শুভ হালখাতা।’ তহুরার গোলে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ (১-০)। এরপর একাধিক আক্রমণ করলেও সেগুলো সফল হয়নি। যখনই মনে হচ্ছিল প্রথমার্ধে এই স্কোরলাইন নিয়েই বিরতিতে যাবে দু’দল, তখনই আবার গোল এবং সে গোল অবশ্যই বাংলাদেশের। ৩৯ মিনিটে গোল করে আরেক খাতুন, সাজেদা (২-০)। পরের মিনিটেই আবারও গোল করে ব্যবধান ৩-০তে নিয়ে যায় লাল-সবুজরা। এবার গোলদাতা প্রথমজনই অর্থাৎ তহুরা। দ্বিতীয়ার্ধেও সমানতালে খেলতে থাকে বাংলাদেশের মেয়েরা। তবে হংকং কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলায় গোলের সন্ধান পাচ্ছিল না তারা। অবশেষে ৬৭ মিনিটে আবারও গোলবন্যা শুরু হয় তাদের। বিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে স্কোরলাইন ৪-০ করে দেয় শামসুন্নাহার। এ হচ্ছে সেই শামসুন্নাহার যার দেয়া একমাত্র গোলেই গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় নিজেদের মাটিতে ভারতকে হারিয়ে সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের অপরাজিত শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। ৭২ মিনিটে ফরোয়ার্ড আনুচিং মগিনি গোল করলে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় ৫-০ গোলে। জয় ততক্ষণে নিশ্চিতই হয়ে গেছে। কিন্তু নিশ্চিত হয়নি একজনের হ্যাটট্রিক। সেই হ্যাটট্রিক পূরণের অভিলাষ পূর্ণ করতে অবশ্য খুব বেশি সময় নেয়নি তহুরা। ৭৪ মিনিটে নিজের তৃতীয় গোলটি করে মাইলফলকটি ছুঁয়ে আনন্দে ফেটে পড়ে সে (৬-০)। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এটা তার চতুর্থ হ্যাটট্রিক এবং মোট গোলসংখ্যা ২৪। স্বাগতিকদের নাকাল হতে দেখে তহুরাদের মনে করুণ ভাব জেগেছিল কি না কে জানে, বাকি ১৬ মিনিটে তারা আর গোল করার চেষ্টা করেনি। শেষ পর্যন্ত রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজালে বিদেশের মাটিতে অপরাজিত শিরোপা জেতার উল্লাসে মাতোয়ারা হয় ছোটনের শিষ্যারা, সেই সঙ্গে দেশের ১৭ কোটি বাংলাদেশী ফুটবলপ্রেমীদের মনে এনে দেয় অনাবিল চিত্তসুখের উপলক্ষ। বাংলাদেশ দল ॥ গোলরক্ষক-মাহমুদা আক্তার, রূপনা চাকমা; ডিফেন্ডার-আঁখি খাতুন (সহ-অধিনায়ক), নিলুফা ইয়াসমীন নীলা, আনাই মগিনি, নাজমা, দীপা খাতুন, রুনা আক্তার, রুমি আক্তার; মিডফিল্ডার- মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, লাবনী আক্তার, তহুরা খাতুন, মুন্নী আক্তার, শামসুন্নাহার, সোহাগী কিসকু; ফরোয়ার্ড-ঋতুপর্ণা চাকমা, সাজেদা খাতুন, আনুচিং মগিনি, শামসুন্নাহার, কোচ-গোলাম রব্বানী ছোটন।
×