ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ উপলক্ষে সেমিনারে মন্তব্য

রাজনীতিক ও আমলাদের যোগসাজশে দুর্নীতি বেড়েই চলেছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২ এপ্রিল ২০১৮

রাজনীতিক ও আমলাদের যোগসাজশে দুর্নীতি বেড়েই চলেছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজনীতিক ও আমলাদের পারস্পরিক যোগসাজশে দুর্নীতি বাড়ছে। এর মাত্রাও দিনদিন বেড়েই চলছে। এটি ভাঙতে না পারলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া যাবে না বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ উপলক্ষে সংস্থা আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বিএফইউজের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিপিএটিসির প্রাক্তন রেক্টর এ জেড এম শফিকুল আলম। ‘জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ব্যবস্থাপনা : দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের প্রধান নিয়ামক’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, পলিটিশিয়ান ও প্রশাসনের লোকদের (আমলা) যোগসাজশে দুর্নীতি এখন দিন দিন বাড়ছে। এটা ভাঙতে না পারলে আমরা এগুতে পারব না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়ে ৮২ দিনের দায়িত্বে আমার অভিজ্ঞতা হলো প্রশাসনে যারা থাকেন (আমলা) তারা কীভাবে মন্ত্রী পর্যায়ের লোকজনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, দুদকের উচিত চিহ্নিত নামকরা দুর্নীতিবাজদের শুধু ডেকে না এনে, তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে তা গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সমাজে দুর্নীতিবিরোধীদের বার্তা পৌঁছে দেয়া। দুদকের উচিত প্রশাসনের নিয়োগ বাণিজ্য, পদায়ন ও বদলি বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরা। পানামা পেপারস এবং প্যারাডাইস পেপারসে অনেকের নাম এসেছে। এ বিষয়ে দুদকের কার্যক্রম মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে জানানো যেতে পারে। ভারতের সুপ্রীমকোর্টের একটি রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে ড. রেজা বলেন, পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ছাড়া দুর্নীতি দমন বা প্রতিরোধ করা কঠিন। ভারতে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের এবং তার পোষ্যদের সম্পদের উৎসসহ বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে। আমাদের দেশেও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা হলফনামা দিয়ে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। আর কেউ যদি মিথ্যা হলফনামা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন, তাহলে এদের প্রতি জনগণ আস্থা রাখবে কীভাবে? সভাপতির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, সবাইকে অনুধাবন করতে হবে, সব দুর্নীতিই দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ নয়। মানিলন্ডারিং আইন ও দুদক আইন সংশোধনের মাধ্যমে বেসরকারী ব্যক্তিবর্গের জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা, অর্থ-পাচার সংক্রান্ত অপরাধসমূহ দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে তফসিল-বহির্ভূত করা হয়েছে। ফলে পানামা পেপারস কিংবা প্যারাডাইজ পেপারসে দুর্নীতিতে যেসব বেসরকারী ব্যক্তির নাম এসেছে তাদের অনুসন্ধান করা কমিশনের জন্য কিছুটা জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও কমিশন দেশের স্বার্থে এবং জনগণের প্রত্যাশাকে সামনে রেখে অবৈধ সম্পদ খোঁজার মাধ্যমে তাদের অবৈধ সম্পদ পাচারের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমলারা যদি চেয়ারের মায়া ত্যাগ করে আইনানুগভাবে তাদের সব দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে কারও পক্ষেই দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। অনৈতিক যোগসাজশ ছাড়া কোন দুর্নীতি সংঘটিত হতে পারে না। পদ্ধতিগত সংস্কার ছাড়া আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি নির্মূল করার খুব বেশি একটা সহজ পথ নেই। অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা হাফিজউদ্দীন খান বলেন, দুর্নীতি দমন করতে হলে জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন থাকতেই হবে। কিন্তু দেশের বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা অনুপস্থিত। জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন গড়তে হলে সরকারী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলি, পদায়নে শৃঙ্খলা এবং পদোন্নতির স্বচ্ছ এবং বৈষম্যহীন নীতিমালা প্রয়োজন। প্রাক্তন মন্ত্রী ড. মিজানুর রহমান শেলী বলেন, মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে, স্কুল থেকে আমাদের হারিয়ে যাওয়া পুরনো মূল্যবোধ জাগাতে হবে। রাষ্ট্রের প্রাণ-ভোমরা হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন অসম্ভব। সংসদ সদস্য একেএম রহমতউল্লাহ বলেন, রাজনীতিবিদদের এবং প্রশাসনিক কর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এরা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে না পারলে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল মজুমদার বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে দুর্নীতি হয় এবং এর মাধ্যমেই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দুর্নীতিবিরোধী দুদকের সব উদ্যোগের সঙ্গে আমি আছি এবং থাকব। চূড়ান্ত যুদ্ধে দানবরা পরাজিত হয়ে মানবরা বিজয়ী হবেই। সেমিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, সাংবাদিক সোহরাব হোসেন, অধ্যাপক জেরিনা জামান খান, অধ্যাপক আবুল কাশেম মজুমদার, চ্যানেল-৭১ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু, প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ও দুদক কমিশনার এ এফ এম আমিনুল ইসলাম প্রমুখ। উল্লেখ্য, দুর্নীতিবিরোধী গণসচেতনতা তথা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে গত ২৬ মার্চ থেকে দুদক দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালন করছে। শুধু ঢাকা নয় দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, নগর, মহানগর পর্যায়েও দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে।
×