ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চার জাতি আন্তর্জাতিক নারী ইয়ুথ ফুটবল, শিরোপা উৎসর্গ মুক্তিযোদ্ধাদের

এবার হংকং জয় লাল-সবুজ জার্সির মেয়েদের

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২ এপ্রিল ২০১৮

এবার হংকং জয় লাল-সবুজ জার্সির মেয়েদের

রুমেল খান ॥ ‘শোনো নারী/তুমি চাইলেই পারো সব/চোখ বুজে কেন?/কেন রবে মুখ চেপে আঁচলে/তোমরাই তো জলতরঙ্গে সুর-তাল-লয় এনেছো’... যেখানে পুরুষরা চরমভাবে ব্যর্থ, সেখানে নারীরা দারুণভাবে সফল। বলছি ফুটবলের কথা। চর্মগোলকের এই খেলাটিতে সাম্প্রতিক সময়ে যেখানে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে পুরুষ ফুটবল, আসছে না কোন সাফল্য, সেখানে নারী ফুটবলের অভাবনীয় সাফল্য সত্যিই তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো। এই তো রবিবার যেমন আরেকবার তাক লাগিয়ে দিল বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৫ জাতীয় নারী ফুটবল দল। হংকংয়ে চার জাতি আসরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ দল। সিউ সাই ওয়ান স্পোর্টস গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত ‘অলিখিত’ ফাইনালে তারা গোলবন্যায় ভাসিয়ে দেয় স্বাগতিক হংকংকে। ৬-০ গোলে তাদের হারিয়ে জেতে কাক্সিক্ষত শিরোপা। খেলার প্রথমার্ধেই বিজয়ী দল এগিয়ে ছিল ৩-০ গোলে। দলের জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ফরোয়ার্ড তহুরা খাতুনের। সে করে নয়নাভিরাম আরেকটি হ্যাটট্রিক। এছাড়া ১টি করে গোল করে সাজেদা খাতুন, শামসুন্নাহার এবং আনুচিং মগিনি। দিনের অপর ম্যাচে ইরান ১-১ গোলে ড্র করে মালয়েশিয়ার সঙ্গে। এই ড্রতে ইরান তৃতীয় ও মালয়েশিয়া চতুর্থ হয়ে আসর শেষ করলো। যদিও দু’দলের পয়েন্ট সমান। কিন্তু গোল গড়ে এগিয়ে থাকায় ইরান তৃতীয় হয়। টুর্নামেন্ট শেষে বাংলাদেশ দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন বলেন, ‘পুরো টুর্নামেন্টে মেয়েরা যেভাবে পারফর্মেন্স করেছে তাতে আমি খুবই সন্তুষ্ট। এই শিরোপা আমরা উৎসর্গ করতে চাই একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।’ শিরোপাজয়ী দলের অধিনায়ক-মিডফিল্ডার মারিয়া মান্দার প্রতিক্রিয়া, ‘হংকংয়ের মাটি থেকে প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক ট্রফি অর্জন করতে পেরে আমরা সবাই দারুণ খুশি। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সেইসব সমর্থকদের, যারা আমাদের ব্যাপক সমর্থন করেছেন এবং আমাদের জন্য প্রার্থনা করেছেন।’ হ্যাটট্রিকধারী ফরোয়ার্ড তহুরা খাতুনের অনুভূতি, ‘শিরোপা জেতায়, ফাইনালে হ্যাটট্রিক করায় এবং টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ায় আমি অনেক আনন্দিত। শেষ ম্যাচে গোল করে আমি কথা রেখেছি। আমরা হংকংয়ের বিরুদ্ধে সবাই নিজেদের শতভাগ নিংড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি এবং সফল হয়ে বাংলাদেশের জন্য ট্রফি আনতে পেরেছি। এজন্য সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ।’ দলের অপর মিডফিল্ডার শামসুন্নাহারের ভাষ্য, ‘টুর্নামেন্টের মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ারের পুরস্কার পেয়েছি বলে ভীষণ ভাল লাগছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগছে আমাদের দল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ায়।’ সোনার মেয়েরা হংকং থেকে বিমানযোগে দেশে (ঢাকা) ফিরবে ৩ এপ্রিল, রাত সাড়ে ১২টায়। প্রতিপক্ষকে নিজেদের মাটিতে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দই ভিন্ন। আর সেই আনন্দই পেল ছোটনের শিষ্যারা। প্রতিপক্ষ ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে এবং তাদের বিরুদ্ধে এর আগে কখনই খেলার অভিজ্ঞতা না থাকলেও বাংলাদেশ দলের আয়েশী জয় কুড়িয়ে নিতে কোন সমস্যাই হয়নি। যদিও তারা মাঠে নেমেছিল বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেই। সিঙ্গেল লীগ পদ্ধতির টুর্নামেন্ট বলে ফাইনাল বলে কিছু ছিল না। তাই শেষ ম্যাচে শিরোপা জিততে বাংলাদেশের দরকার ছিল কমপক্ষে ড্র। সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের জন্য নিশ্চিতভাবেই ম্যাচটি ছিল ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচ। কিন্তু ড্র নয়, বড় ব্যবধানে জিতেই সাফল্য অর্জন করলো ‘দ্য বেঙ্গল টাইগ্রেস’ দল। চার জাতির এই আসরে ৩ খেলায় সর্বোচ্চ ৯ পয়েন্ট পেয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। বাকি দুই খেলায় তারা মালয়েশিয়াকে এবং ইরানকে হারায় যথাক্রমে ১০-১ এবং ৮-১ গোলে। পক্ষান্তরে ৩ খেলায় ৬ পয়েন্ট পেয়ে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলো স্বাগতিক হংকংকে। বাকি দ্ইু খেলায় তারা ইরান ও মালয়েশিয়াকে একই ব্যবধানে (১-০) হারায়। চ্যাম্পিয়ন হবার দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। ২ খেলার তাদের পয়েন্ট ছিল ৬। তবে সমান ম্যাচে সমান পয়েন্ট ছিল স্বাগতিক হংকংয়েরও। কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে গোল গড়ে অনেক পিছিয়ে ছিল তারা। যেখানে বাংলাদেশের গোলগড় ছিল +১৬, যেখানে হংকংয়ের গোলগড় ছিল মাত্র +২। তবে গোল হজমের ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে ছিল বাংলাদেশের চেয়ে। যেখানে বাংলাদেশ খেয়েছিল দুই গোল, সেখানে হংকং তখনও কোন গোল হজম করেনি। কিন্তু অলিখিত ফাইনালে তাদের সেই দর্পচূর্ণ করে দেয় আঁখি-ঋতুপর্ণা-মনিকারা। সেই সঙ্গে তাদের উপহার দেয় টুর্নামেন্টের প্রথম হারের বিস্বাদও। আশ্চর্য হলেও সত্যি, টুর্নামেন্টে মোট ৬ ম্যাচে চার দল যেখানে গোল করেছে ৩০টি, সেখানে শিরোপা জেতার পাশাপাশি লাল-সবুজবাহিনীই করেছে ২৪ গোল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩টি করে গোল করেছে বাকি দলগুলো। টুর্নামেন্টে যে তিনটি হ্যাটট্রিক হয়েছে তার প্রতিটিই করেছে বাংলার বাঘিনীরা। এর দুটিই তহুরা খাতুনের। আরেকটি মিডফিল্ডার শামসুন্নাহারের। তহুরা আবার টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতাও বটে। তার গোলসংখ্যা ৮ (আন্তর্জাতিক ফুটবলে এটা তার চতুর্থ হ্যাটট্রিক এবং মোট গোলসংখ্যা ২৪)। দ্বিতীয় স্থানে থাকা শামসুন্নাহারের গোলসংখ্যা ৬। তৃতীয় স্থানটিও বাংলাদেশের, তাও যুগ্মভাবে। আনুচিং মগিনি ও আনাই মগিনি। দুই বোনের গোলসংখ্যা সমান ৩টি করে। বিদেশের মাটিতে এটি বাংলাদেশের মেয়েদের তৃতীয়, অ-১৫ দলের দ্বিতীয় এবং সার্বিকভাবে জেতা পঞ্চম শিরোপা। এর আগে তারা ২০১৫ সালে নেপালে ‘এফসি অ-১৪ বালিকা আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ’ এবং ২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে একই দল একই আসরের শিরোপা জিতেছিল। এছাড়া ২০১৬ সালে এএফসি অ-১৬ আসরের আঞ্চলিক বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে সাফ অ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছিল দেশের মাটিতে। বলাই বাহুল্য, প্রতিটি দলের ও শিরোপা জয়ের মূল কারিগর ছিলেন কোচ ছোটন। হংকংয়ের এই আসরে বাংলাদেশ যে তিনটি দলকে হারিয়েছে তাদের সবাই কিন্তু ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে সিনিয়র পর্যায়ে বাংলাদেশের (র‌্যাঙ্কিং ১০২) চেয়ে অনেক ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। যেমন ২২ ধাপ এগিয়ে মালয়েশিয়া (র‌্যঙ্কিং ৮০), ৩১ ধাপ এগিয়ে হংকং (র‌্যাঙ্কিং ৭১) এবং ৪৪ ধাপ এগিয়ে ইরান (র‌্যাঙ্কিং ৫৮)। প্রতি ম্যাচেই বাংলাদেশ দলের একাধিক ফুটবলার গোল করে। ৩ ম্যাচে ৭ ফুটবলার করে মোট ২৪ গোল। এ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কারÑ গোল করার ক্ষেত্রে দল নির্দিষ্ট কারুর ওপর নির্ভরশীল নয়। আরও লক্ষণীয়, এই সাতজনের আবার চারজনই ডিফেন্ডার। মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে ছোটনের শিষ্যাদের কেউই হ্যাটট্রিক করতে পারেনি (হ্যাটট্রিক বঞ্চিত হয় তিনজন) এবং ১০টি গোল করে সাত ফুটবলার। ইরানের বিরুদ্ধে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দুই ফুটবলার (হ্যাটট্রিক বঞ্চিত হয় একজন) এবং ৮টি গোল করে চার ফুটবলার। আর হংকংয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে এক ফুটবলার এবং ছয় গোল করে চার ফুটবলার। আগামী মাসে থাইল্যান্ডে একটি ফুটসাল টুর্নামেন্ট খেলতে যাবে বাংলাদেশের মেয়েরা। এ ধরনের টুর্নামেন্টে এর আগে খেলেনি তারা। এই নতুন চ্যালেঞ্জ জিতে কী তারা আবারও দেশের ফুটবলপ্রেমীদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে?
×