যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থান ও বাস্তব জীবনে তার তাৎপর্য

মৃত্যু থেকে যিশু খ্রিস্টের পুনরুত্থান স্মরণার্থক দিন আজ। ৯৪ খ্রিস্টাব্দের কথা। যীশু খ্রিস্টের সর্বকনিষ্ঠ শিষ্য যোহন তখন একজন অশীতিপর বৃদ্ধ। খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসের কারণে ভূমধ্যসাগরের পাটমস দ্বীপে দ্বীপান্তরের শাস্তি ভোগ করছেন। ডমিশিয়ান তখন রোমের সম্রাট। খ্রিস্টিয়ানদের উপরে তাঁর এক পূর্বসূরি নীরোর ভয়ঙ্কর নিধনযজ্ঞের কথা কে না শুনেছে? কোন কোন ক্ষেত্রে ডমিশিয়ানের পৈশাচিকতা তাকেও হার মানিয়েছে। তিনিই প্রথম রোম সম্রাট যিনি নিজেকে ‘প্রভু ও ঈশ্বর’ বলে ঘোষণা করে প্রজাদের কাছ থেকে পূজা দাবি করেছেন। কিন্তু খ্রিস্টিয়ানদের বিশ্বাস যেহেতু, ঈশ্বরপুত্র পুনরুত্থিত খ্রিস্টই প্রভু, তাই তারা জাগতিক কোন শাসককে ‘প্রভু ও ঈশ্বর’ বলে স্বীকার করতে রাজি নয়। ফলে খ্রিস্টিয়ানদের উপরে নেমে আসে অকথ্য অত্যাচার। নির্বাসিত যোহন যখন একদিন ঐশধ্যানে মগ্ন তখন তিনি পান এক অদ্ভুত দিব্যদর্শন। খ্রিস্টের এই বাণী শুনতে পেলেন তিনি : ‘ভয় করিও না, আমি প্রথম ও শেষ ও জীবন্ত; আমি মরিয়াছিলাম, আর দেখ, আমি যুগপর্যায়ের যুগে যুগে জীবন্ত; আর মৃত্যুর ও পাতালের চাবি আমার হস্তে আছে’ (প্রকাশিত বাক্য ১ঃ১৭-১৮)। খ্রিস্টের পুনরুত্থান সেই শাশ্বত জীবনেরই মৃত্যুহীন উচ্চারণ। যুগে যুগে এই অভয়ও অমিয় বাণীই খ্রিস্টের অনুসারীদের সকল প্রেরণা ও আশার উৎস হয়ে রয়েছে। খ্রিস্টের পুনরুত্থানই তাদের কেন্দ্রীয় বিশ্বাস, তাদের সমস্ত বিশ্বাস সূত্র তারই প্রতিধ্বনি। ছোট বড় নানা কারণে চার্চ শতধাবিভক্ত হলেও পৃথিবীর সকল খ্রিস্টিয়ানদের একমাত্র ঐশতাত্ত্বিক নির্ভরবিন্দু ও প্রচারের সারমর্ম মৃত্যু থেকে খ্রিস্টের পুনরুত্থান। সাধু পৌলের কথায় ‘খ্রিস্ট যদি উত্থাপিত না হইয়া থাকেন, তাহা হইলেত আমাদের প্রচারও বৃথা, তোমাদের বিশ্বাসও বৃথা’ (১ করিন্থীয় ১৫ঃ১৪)। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে খ্রিস্টের পুনরুত্থান কিভাবে এলো? পুনরুত্থান তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যুর দান। ক্রুশের নাটকে আপাত পরাজিত খ্রিস্ট মৃত মানুষ, কিন্তু পুনরুত্থনের গৌরবে তিনি বিজয়ী বীর, শাশ্বত জীবন্ত ঈশ্বরপুত্র। ঈশ্বরের অবতাররূপে তিনি মানুষের ইতিহাসে ও অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। ঈশ্বর তাঁর মধ্য দিয়ে মানুষের জন্য স্বর্গীয় প্রেমকে চূড়ান্তভাবে মূর্ত করেছেন। তাঁর অলৌকিক জন্ম, অপমানজনক মৃত্যু ও আলোকদীপ্ত পুনরুত্থানের সকল ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত সাধন করেছেন। মানুষ কোন সৎকর্ম ও সাধনার বলে ঈশ্বরের কাছে ধার্মিক হতে পারে না। সৎকর্ম ইত্যাদি ঈশ্বরের সঙ্গে তার সঠিক সম্পর্কে থাকার ফল, তার কারণ নয়। কারণ আমাদের সৎকর্মের সঙ্গে থাকে আমাদের অহংকার। আর অহংকার হলো বড় পাপ এবং অন্য অনেক পাপের মূল। তাই একমাত্র বিশ্বাসে আত্মসমর্পণের দ্বারাই মানুষ ঈশ্বরের দয়া ও অনুগ্রহে তাঁর সঙ্গে সঠিক সম্পর্কে বাস করতে পারে যার ফলশ্রুতিতে তার হৃদয়ের হয় আমূল পরিবর্তন ও সে অন্য মানুষের সঙ্গেও সুসম্পর্কে বাস করতে পারে। ঈশ্বরে বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণই চাবিকাঠি, কারণ সৎকর্ম, সাধনা ও জ্ঞান যে সকলের সাধ্যের মধ্যে থাকে না! নিষ্পাপ ঐশপুত্র খ্রিস্টের আত্মদানেই ঈশ্বরের অসীম প্রেম প্রকাশিত হয়েছে। ত্যাগ ও প্রেমের গুরু খ্রিস্ট ক্রুশের কন্টকাকীর্ণ পথেই পুনরুত্থানের গৌরবে উদ্ভাসিত হলেন। অনেকের কাছে তা দুর্বোধ্য বলে মনে হবে। প্রমাণের অন্বেষী ইহুদীদের কাছে তা ছিল বিঘ্নের বিষয়, আর জ্ঞানের পুজারী গ্রীকদের কাছে তা ছিল মূর্খতা। কিন্তু তার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে ঈশ্বরের জ্ঞান। পাপী মানুষের প্রতি স্বর্গীয় অনুগ্রহে ঈশ-মানব খ্রিস্ট মৃত্যুর রাজ্যে প্রবেশ করে মৃত্যুকে জয় করলেন। মানুষের পরিত্রাণের জন্য ঈশ্বরের প্রেমের কারণেই তিনি তাঁর বাধ্য ছিলেন। ‘পিতা আমাকে এই জন্য প্রেম করেন, কারণ আমি আপন প্রাণ সমর্পণ করি, যেন পুনরায় তাহা গ্রহণ করি। কেহ আমা হইতে তাহা হরণ না, বরং আমি আপনা হইতেই তাহা সমর্পণ করি। তাহা সমর্পণ করিতে আমার ক্ষমতা আছে, এবং পুনরায় তাহা গ্রহণ করিতেও আমার ক্ষমতা আছে; এই আদেশ আমি আপন পিতা হইতে পাইয়াছি’ (যোহন ১০ঃ১৭-১৮)। যেহেতু খ্রিস্ট ছিলেন নিষ্পাপ, তাই মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তাঁর মৃত্যুই ছিল একমাত্র ঈশ্বর নিরূপিত ব্যবস্থা। পাপের কোন অভিজ্ঞতা যাঁর মধ্যে ছিল না তাঁকেই ঈশ্বর মানুষের পাপের জন্য যজ্ঞরূপে হত হতে দিলেন। তাই নিষ্পাপ-নিষ্কলঙ্ক যীশুর যজ্ঞই পাপমুক্তির জন্য পবিত্র ঈশ্বরের কাছে একমাত্র শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ। ক্রুশীয় অপমানজনক মৃত্যু মানুষের পাপের ভয়াবহ বাস্তবতাকে তুলে ধরে। সেই বাস্তবতার কারণেই তাঁর আত্মদান ছিল ঈশ্বরের মনঃপূত ও পবিত্র দান। তাই পুনরুত্থান তার প্রমাণ যে, ঐ দান ও ত্যাগের কোন ক্ষয় নেই। খ্রিস্টের পুনরুত্থানের রহস্যকে বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হয় এ পৃথিবীতে খ্রিস্টের আগমন, তাঁর সাধিত সমস্ত আশ্চর্য কাজ, তাঁর পুনরুত্থান- সব কিছুই হয়েছে পবিত্র আত্মার শক্তিতে। পবিত্র আত্মাই ঈশ্বর। নিরাকার ঈশ্বর একজনই; কিন্তু তিনি পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মারূপে তিন ব্যক্তিসত্তায় বিরাজমান যেন তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের কাছে অর্থবহ ও বোধগম্য হয়। তাই পিতার প্রেম পুত্রে প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই প্রকাশের ধারাবাহিকতা ও তার ফল পবিত্র আত্মার কাজে নতুন জীবন ও নতুন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। খ্রিস্টের পুনরুত্থানে বিশ্বাসের অর্থ হলো পবিত্র আত্মায় জীবনকে নতুন করার আহ্বানে সাড়া দেয়া। পাপের পুরনো জীবনকে কবর দিয়ে জগৎ ও জীবনকে নতুনভাবে গ্রহণ করা। এর জন্য প্রথমে চাই এ জগতে বিশ্বাসীর প্রকৃত মানবীয় মূল্যবোধ ও চেতনার পুনরুত্থান। পাপের ভয়াবহ বাস্তবতা বুঝে খ্রিস্টের আত্মত্যাগকে মেনে নিতে না পারলে তাঁর পুনরুত্থানের আনন্দ লৌকিকতায়ই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। খ্রিস্টের মৃত্যুর সঙ্গে যদি আমাদের লোভ ও স্বার্থ চিন্তার মৃত্যু না হয়, তাহলে তাঁর পুনরুত্থান আমাদের কোন নতুনত্ব এনে দিতে পারে না। সেই প্রথম যুগের বিশ্বাসীরা খ্রিস্টের মৃত্যুর জন্য নিজেদের পুরনো জীবনকে, অর্থাৎ তাদের পুরনো মানুষকে মৃত্যুসাত করেছিল বলেই পুনরুত্থানের আনন্দকে প্রকৃত অর্থেই উপলব্ধি করেছে। সকল সংকীর্ণতাকে বিসর্জন দিতে পারলেই ত প্রকৃত মনুষ্যত্বের জন্ম। T.S. Elliot এর কথায়, “Pain is the opposite of joy, But joy is a kind of pain. I believe the moment of birth Is when we have knowledge of death.” খুব সহজভাবে বলতে গেলে, বাইবেলে মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে দু’ভাবে ভাগ করা হয়েছেঃ (১) ধূলি বা মাটি, (২) ঈশ্বরের আত্মা। ধূলি হচ্ছে ইহজাগতিক, শারীরিক সত্তা; ঈশ্বরের আত্মা হচ্ছে মানুষের প্রাণবায়ু, অনন্তকালীন সত্তা যার বলে মানুষ ঈশ্বরের বিষয়ে চিন্তা করতে পারে, তার সঙ্গে কথা বলতে পারে ও সম্পর্ক রাখতে পারে। এখানেই প্রকাশ মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের নৈতিক গুণাবলীর অর্থাৎ যে সমস্ত গুণাবলী তিনি মানুষকে দান করেছেন, যেমন : প্রেম, পবিত্রতা, সততা, ন্যায্যতা, ধার্মিকতা, ইত্যাদি। এসব থেকেই মানুষের হয় মূল্যবোধ ও চেতনা। বাস্তব জীবনে খ্রিস্টের পুনরুত্থানে আমাদের সেই মূল্যবোধ ও চেতনার পুনরুত্থান হওয়ার আহ্বান আজ। মানুষ প্রকৃত মানুষ হয় তার চৈতন্য ও মূল্যবোধে। বাইবেলে ‘ভয় করিও না’- কথাটি ৩৬৬ বার ব্যবহার করা হয়েছে, যেন বছরের প্রতিদিনের জন্য ঈশ্বর তাঁর ভক্তদের একটি করে অভয়বাণী দিয়েছেন। লিপইয়ারেও প্রতিটি দিনের জন্য! আমাদের নিত্যদিনের বাস্তবতায় সুখ-দুঃখ ও আশা-নিরাশার অভিজ্ঞতায় যীশু খ্রিস্টের সেই অভয়বাণী স্বার্থক হোক্। দিকে দিকে অন্যায় ও অশুভ শক্তির বড় আস্ফালন ও পাঁয়তারা। সুন্দর ও সুন্দর জীবনের জন্য আমাদের মূল্যবোধের পুনরুত্থান। ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ত্যাগ ও আত্মদানের মানবিক সব মূল্যবোধ নতুন করে জেগে উঠুক, হোক তার পুনরুত্থান, এমন প্রার্থনা করি সকল মানুষের জন্য। সবাইকে জানাই ‘শুভ পুনরুত্থান’! লেখক : খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক ও সমাজ কর্মী