ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ মোঃ জয়নাল আবদিন

অভিমত ॥ এ পথ শুধু এগিয়ে চলার

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১ এপ্রিল ২০১৮

অভিমত ॥   এ পথ শুধু  এগিয়ে চলার

‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’, ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’ কথাগুলো ছোটকালে আদর্শলিপি বইয়ে পড়েছি। আজকাল সেই আদর্শলিপিও নেই, আদর্শও নেই। যদিও এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেট, মোবাইল, ইউটিউব, টেলিভিশন, কম্পিউটার তথা পারিপার্শ্বিকতা থেকে অনেক কিছু শেখার সুযোগ আছে। কিন্তু তারা সততা, আদর্শের শিক্ষা কি নিতে পারছে? আজকের বাংলাদেশ এমনকি আজকের পৃথিবী যেটা সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে, তা হচ্ছে সততার অভাব। সারা বিশ্বেই সততা ও মানবতাহীন যে কর্মকা- চলছে তার বিরুদ্ধে এখনই সমগ্র বিশ্ববাসীর নড়েচড়ে বসা উচিত। বিশ্ব আজ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষ মঙ্গল গ্রহে আবাস গড়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন দল ও গোষ্ঠীগত কোন্দল, জঙ্গীবাদ, জাতিতে জাতিতে কলহ, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন, সৌদি আরব, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা নিধনের পেছনে মূলত সততা ও মানবতার অবক্ষয় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী এই কলহের সমাধান কি? সমাধান একটাই- সৎ ও মানবিক নেতৃত্ব। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, বিশ্বে যখনই অসৎ নেতৃত্ব এসেছে তখনই কোন না কোন জাতির উপর হামলা হয়েছে, জঙ্গীবাদের উত্থান হয়েছে কৌশলগত কারণে। কূটকৌশল কখনও কোন জাতিকে কিংবা বিশ্বকে শান্তির গন্তব্যে নিতে পারে না। একমাত্র সৎ নেতৃত্বই কোন জাতিকে, বিশ্বকে সুখময় করার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আমরা বাঙালী জাতি দুর্ভাগ্যবান এ কারণে যে- যিনি ছিলেন জাতির জনক, জাতির কা-ারি, সততা ও আদর্শের কা-ারি তথা সমগ্র পৃথিবীর শোষিতের পক্ষে তাঁকেই হত্যা করা হয়েছে নৃশংসভাবে। আসলে শুধু জাতির জনককে হত্যাই নরপশু ঘাতকদের উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী জাতির মূল চেতনা, প্রেরণা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে শেষ করে দিয়ে আবার সেই পাকস্তানী পশ্চাৎপদ রাজনীতিকে কায়েম করা। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গকে হত্যা করে বাঙালী সংস্কৃতি, শিক্ষা, ইতিহাসসহ প্রতিটি বাঙালীর মন ও মানসিকতা সব পাল্টে ফেলার যে নীল নক্সা করা হয়েছিল, তা থেকে বের হওয়াও আরেকটা অন্যতম যুদ্ধ। একটা মিথ্যাকে ঢাকার জন্য দশটা মিথ্যা বলা, একটা মিথ্যাকে দশবার বলে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা, এসবই চলেছে অনেক বছর। সে কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কখনও সামরিক স্বৈরশাসক, কখনও পাকিস্তানী ও স্বাধীনতাবিরোধী সমর্থনপুষ্ট শাসকশ্রেণী এ দেশের রাজনীতিকে করেছে কলুষিত এবং কঠিন। রাজনীতি ও ধর্মের নামে ব্যবসা, ভোগবিলাসই ছিল মূল তাদের মূল উদ্দেশ্য। দেশে সত্যিকার অর্থে ধর্মচর্চা, সুস্থ রাজনীতি চর্চা হয়ে উঠেছিল কঠিন। প্রগতির বিকাশ না হয়ে শুরু হয়েছিল ধর্মান্ধতা, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিকাশ। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতির জনকের স্বপ্ন পূরণের শপথ নিয়ে এসেছেন বাঙালীর কা-ারি হয়ে- যিনি সৎ, সাহসী, দেশপ্রেমিক ও কর্মঠ। ইতোমধ্যেই তিনি দেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে ‘ভিশন ২০২১’ ও ‘ভিশন ২০৪১’ কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। জীবনবাজি রেখে তিনি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা তার চারপাশের দুষ্টচক্র থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে সততার আদর্শকে তুলে ধরেছেন। যেখানে, সারা বিশ্ব আজ দুর্নীতি, স্বার্থপরতা, মানবতাহীনতায় নিমজ্জিত, সেখানে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারপ্রধান হিসেবে সততায় বিশ্ব শীর্ষে অবস্থান, বিশ্বসেরা প্রধানমন্ত্রী হওয়া বাঙালীর নোবেল পুরস্কারের চেয়েও বড় পাওয়া। তার উপর প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা নিধনে তিনি তাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে বাঙালীর যে ইমেজ তৈরি করেছেন, তা বিশ্ববাসী চিরকাল স্মরণ রাখবে সন্দেহ নেই। পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কাজ নিজ খরচে করে বাঙালীর আত্মবিশ্বাসকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা সেটা স্বাধীনতার পর বাঙালীর সবচেয়ে বড় পাওয়া। যে নিক্সন বাঙালীকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে কটাক্ষ করেছিলেন আজ তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই লজ্জায় মুখ লুকাতেন। কিন্তু এই মূল্যবান অর্জনকে জাতির ভাগ্য উন্নয়নের নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। আমাদেরও তার মতো সৎ ও আদর্শবান হতে হবে, তার আদর্শকে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। হাজার হাজার প্রকল্প হাতে নিয়ে জাতিকে একটি আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তা বিরল। কিন্তু সবাই সহযোগিতা না করলে, প্রকল্পগুলোকে সার্থকভাবে বাস্তবায়ন না করলে শুধু জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে কখনও একটা দেশের সার্বিক উন্নয়ন করা সম্ভব না। উন্নত দেশ গড়তে হলে দেশের মানুষকেও উন্নত মানসিকতাসহ দায়িত্বশীল হতে হবে। যেমন ধরা যাক; ঢাকা শহর পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারটি। ঢাকা শহর পরিষ্কার রাখার উদ্যোগ কম নেয়া হয়নি। কিন্তু এ রকম আরও হাজারটি প্রকল্প হাতে নিলেও শহর পরিষ্কার রাখা সম্ভব না যদি মানুষ দায়িত্ব নিয়ে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলার পরিবর্তে উপযুক্ত জায়গায় না ফেলে। দায়িত্বহীনতার কারণে অবশ্যই শাস্তির বিধান থাকতে হবে এবং শাস্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। আর জাতি ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ তখনই তৈরি হবে যখন দেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। সেই শ্রদ্ধাবোধ থেকেই দেশপ্রেম তৈরি হবে। দেশপ্রেম থেকেই তৈরি হবে দায়িত্ববোধ। আজ জননেত্রী শেখ হাসিনা সমস্ত প্রতিকূলতা ছিন্ন করে, মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে সততার তলোয়ার হাতে নিয়ে এসেছেন। তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেছেন, জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার করেছেন এবং করছেন, একাত্তরের দালাল ও রাজাকারদের বিচার করেছেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেছেন। বাংলাদেশ আজ বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসেছে। দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়ার বিচার হয়েছে, দুর্নীতির দায়ে আওয়ামী লীগেরও অনেকেরই বিচার হয়েছে এবং হবে। দেশে সেইদিন সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাবে যেদিন মানুষ দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নিয়ে মিছিল করবে না বরং সততার পক্ষে শক্তি জোগাবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে সততায় শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত। এমন একটি সৎ ও কর্মঠ নেতৃত্বই একটি জাতির উন্নত, সুখী, সমৃদ্ধশালী হওয়ার প্রথম এবং প্রধান সোপান। কিন্তু এর বিপরীত ধারাও আছে যারা স্বাধীনতা কিংবা সততায় বিশ্বাস করে না বরং সুযোগের অপেক্ষায় থেকে নিজের স্বার্থকে হাসিল করার জন্য। যাদের কাজ নিয়ম তৈরি করা নয়, নিয়ম ভেঙ্গে ফেলা। আজ, স্বাধীনতার ৪৮ বছরে এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা এবং শক্ত প্রতিরোধ গড়াও জরুরী। একটু ভেবে দেখুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পক্ষ নিয়েছিলেন বলে, জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন বলেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় তাঁকে হত্যা করেছিল। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতিকে বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বলেই হয়ত তার ওপর ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল! কিন্তু কই আরও যারা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল তাদের ওপর তো এমন আঘাত আসেনি। টার্গেটটা কোথায়? টার্গেটটা নিশ্চিত করে ন্যায়, নিয়ম, সততা ও স্বাধীনতার চেতনার ওপর! সুতরাং এই সহজ সূত্রটিকে বোঝার এখনই সময়। অনেকগুলো বছর আমরা নষ্ট করেছি নষ্টামো রাজনীতির অনুসারী হয়ে। এখন সময় স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে সুস্থ রাজনীতির ধারায় আসার। আর স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়, জোর যার মুল্লুক তার নয়, বিচার মানে তালগাছ আমার নয়, যখন তখন রাস্তা অবরোধ করে করে মিছিল, গাড়ি ভাঙচুর কিংবা আগুন জ্বালিয়ে দেয়া নয়। স্বাধীনতার মানে, সুস্থ চিন্তার সফল বাস্তবায়নসহ সততা, ন্যায্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলা। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে সকল সুস্থ, স্বাভাবিক ও সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ হোক, দেশ এগিয়ে যাক, একটি মানবিক প্রগতিশীল উন্নত বাংলাদেশ গঠিত হোক সেই কামনা। লেখক : সহকারী অধ্যাপক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×