ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হত্যাচেষ্টাকারীর পরিবারের বাইরে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি

জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হতে চলেছে

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১ এপ্রিল ২০১৮

জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হতে চলেছে

শংকর কুমার দে ॥ বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টায় হামলার ঘটনায় পুরো মার্চ মাসেও হত্যাকারী ফয়জুল হাসান, তার পরিবার ও স্বজনদের বৃত্ত বলয়ের মধ্যে তদন্ত সীমাবদ্ধ থাকার কারণে আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হামলাকারী ফয়জুল, তার বাবা, মা, মামা, ভাই, এক বন্ধু এই ছয়জন ছাড়া আর কেউ গ্রেফতার বা কোন মহলের সম্পৃক্ততা না আসায় বহুল আলোচিত এই মামলার তদন্তই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকী জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টার পরিকল্পনার সঙ্গে হামলাকারী ফয়জুলকে দীর্ঘদিন ধরে যারা মোটিভেটেড করেছি তারা কীভাবে এই হামলা করা হবে, আর কারা তার সঙ্গে জড়িত ছিল, কারা কীভাবে ছক কষে ছিল তদন্তে তা দৃশ্যমান না হওয়ায় রহস্য ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। গত ৩ মার্চ সিলেটের এই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে ফয়জুল হাসান নামের এক যুবক যাকে সেলফ রেডিক্যালাইডজড বলেছেন পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। হামলাকারী ফয়জুলকে সেলফ রেডিক্যালাইজড অর্থাৎ নিজের উদ্যোগে অভিহিত করার পর থেকেই তদন্তের যেই বৃত্ত বলয়ে আবন্ধ হয়ে পড়েছে তা থেকে দীর্ঘ গোটা মার্চ মাসেও বেরিয়ে আসতে পারেনি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। দেশব্যাপী বহুল আলোচিত জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় হামলার ঘটনার রহস্য উম্মোচনের তদন্ত করছে পুলিশের পাশাপাশি, র‌্যাব, সিআইডি, পিবিআই এবং ঢাকার কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে তার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেছেন, আমাকে নাস্তিক বলো ? আমি কোরান শরিফ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে পড়েছি। সেখানে একটি আয়াত আছে, তুমি যদি একজনকে মারো, তুমি সারা মানবজাতিকে হত্যা করছ। কেমন করে তারা এত বড় দায়িত্ব ঘাড়ে নেয়। কে তোমাদের এসব বুঝিয়েছে। যারা বুঝিয়েছে, তারা নিশ্চিন্তে আছে। আর তুমি, যে কী না রিমান্ডে আছ, তোমার মা, ভাই, বাবা রিমান্ডে যারা এসব কথা বলো, তারা এসো আমার সঙ্গে কথা বলো। হামলাকারী ফয়জুলের ওপর তার কোন ক্ষোভ নেই উল্লেখ করে তাদের পৃষ্ঠপোষক ও মদদদাতাদের খুঁজে বের করার কথা বলেন। ফয়জুল হাসান নামে এক যুবকের হামলায় আহত অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১২ দিন চিকিৎসা শেষে গত ১৪ মার্চ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবাল সিলেট যাওয়ার পথে ঢাকায় বিমান বন্দরে সিলেটে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অনেক কথা বলেন জনপ্রিয় এই লেখক। জাফর ইকবাল এই প্রসঙ্গ তুলে হামলাকারীর উদ্দেশে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘কে তোমাদের বিভ্রান্ত করে ? কে তোমাদের বুঝিয়েছে ? যারা তোমাদের বুঝিয়েছে তারা নিশ্চিন্তে আরামে বসে আছে। তাদের ছেলেমেয়েরা লেখা পড়া করছে। তুমি যার কথা শুনে এ কাজে নেমেছ, তার কোন অসুবিধা হচ্ছে না অথচ তুমি জেলখানায় আছ, রিমান্ডে আছ। তোমার বাবা-মা-ভাই-বোন রিমান্ডে আছে। এটা কী একটা জীবন হলো ? কেন এই জীবন বেছে নিয়েছ ? জাফর ইকবাল তার ওপর হামলার জন্য সেদিন হামলাকারী ফয়জুলের পৃষ্ঠপোষক, মদতদাতা বা তার সহযোগীদের কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ জাফর ইকবালও বিশ্বাস করেন হামলাকারী ফয়জুল একা নয়, তার সঙ্গে পৃষ্ঠপোষক, মদতদাতা, সহযোগী আছেন। যদি জাফর ইকবলের বিশ্বাসই সত্য হয় তাহলে হামলাকারী ফয়জুলের নেপথ্যে যারা বা যেই মহল রয়েছে তারা পর্দার অন্তরালে রয়ে গেছে, যা আজও তদন্তে এখনও পর্যন্ত তা দৃশ্যমান হয়নি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরা হলেন, হামলাকারী ফয়জুল হাসান, তার বাবা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফজলুর রহমান, ভাই এনামুল হাসান ও ফয়জুলের বন্ধু সোহাগ মিয়া। এর মধ্যে আট দিনের রিমান্ড শেষে গত ১৮ মার্চ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে হামলাকারী ফয়জুল হাসান। এর আগে ১৫ মার্চ পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে ফয়জুলের বাবা আতিকুর রহমান আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। গত ২০ মার্চ আদালতে জবানবন্দী দেন ফয়জুলের ভাই এনামুল হাসান। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর হাসান ওরফে ফয়জুরকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধকারী হিসাবে ফেরিওয়ালা সোহাগ মিয়া গত ১৯ মার্চ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে আদালতে। এই ছয়জন এখন কারাগারে বন্দী। এর পর থেকে নতুন করে কেউ গ্রেফতার নেই, তদন্ত ও যেখানে ছিল সেখানেই থমকে আছে। প্রসঙ্গত, গত ৩ মার্চ বিকেলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি) ক্যাম্পাসে একটি অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালে ওপর হামলা চালায় ফয়জুল। ঘটনাস্থল থেকেই তাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ওই দিন রাতেই ফয়জুলকে প্রধান আসামি করে জালালাবাদ থানায় মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন। শনিবার জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী অফিসার (আইও) সিলেটর জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুর রহমান বলেন, জাফর ইকবাল হত্যার চেষ্টার মামলায় এখন পর্যন্ত ছয়জন গ্রেফতার হয়েছে। নতুন করে গ্রেফতার নেই। তদন্তে এখনও পর্যন্ত এতটুকুই অগ্রগতি। মামলার চার্জশিট কবে দেয়া হতে পারে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, জাফর ইকবাল হত্যার চেষ্টার মামলার তদন্ত অনেক বড় বিষয়, বলার মতো সময় হয়নি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) বা আনসার আল ইসলাম এই হত্যা চেষ্টার নেপথ্যে সম্পৃক্ত রয়েছে মনে করেই তদন্ত শুরু করেছে তদন্তকারীরা। কারণ ২০১৩ সালে এই জঙ্গী সংগঠনটির হিটলিস্টে নাম পাওয়া যায় জাফর ইকবালের। তারপর তার কাছে কাফনের কাপড় পাঠায় এই জঙ্গী সংগঠনটি। ২০১৬ সালে জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন হককে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হত্যার হুমকি দেয় এই জঙ্গী সংগঠনটি। জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টার ঘটনায় এ পর্যন্ত হাতে নাতে ধরা পড়া হামলাকারী ফয়জুল হাসান ছাড়াও তার মা, বাবা, ভাই, চাচা, মামা, বন্ধু এই ছয়জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কারা, কীভাবে, কেন, হত্যার চেষ্টার ঘটনা ঘটিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে ব্যর্থতা বা অবহেলা ছিল কী না, পর্দার অন্তরালের নেপথ্যের মদদদাতাদের চিহ্নিত করার জন্য তদন্তকরা হচ্ছে। এ ছাড়া জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলার ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও কাজ শুরু করেছে। কিন্তু ফলাফল হচ্ছে, হামলাকারী ফয়জুল ও তার পরিবারের মধ্যেই তদন্ত আটকে আছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, অধ্যাপক জাফর ইকবালের হত্যা চেষ্টার ঘটনাটির বিষয়ে সিলেটের জালালাবাদ থানায় অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলাটির তদন্ত পুলিশের হাতে থাকলেও ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি), গোয়েন্দা সংস্থা। জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি, কাফনের কাপড় পাঠান, হিটলিস্টে নাম থাকার ঘটনায় জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী সিলেটের জালালাবাদ থানায় জিডি করেন তারা। জাফর ইকবালকে হত্যার হুমকি, কাফনের কাপড় পাঠান, হিটলিস্টে নাম আসা ও যেভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, ঠিক অনুরূপভাবে প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার অভিজিত রায়সহ অন্তত ১৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। একমাত্র ব্লগার রাজীব হত্যাকা- ছাড়া এই ১৪ জন প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক হত্যাকারীদের আইনে সোপর্দ করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ব্যর্থতার কারণেই এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল থেকেই ২৩ জনের পুলিশ টিম পালাক্রমে তাদের সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরা দিয়ে নিরাপত্তা দিয়ে আসছে সরকার। ঘটনার সময়ে জাফর ইকবালকে রক্ষা করতে গিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিতদের সঙ্গে দুই পুলিশ কনস্টেবল আহতও হয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান জনপ্রিয় লেখক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. অধ্যাপক জাফর ইকবাল।
×