ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিশের মোকামে বৈশাখী হাওয়া

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১ এপ্রিল ২০১৮

ইলিশের মোকামে বৈশাখী হাওয়া

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাঙালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ আসতে এখনও বাকি ১৪ দিন। এরই মধ্যে বরিশালের ইলিশের মোকামে লেগেছে বৈশাখী হাওয়া। উৎসব সামনে রেখে গত ৩ দিনে পাইকারি ও খুচরা বাজারে হঠাৎ এর দাম বেড়ে গেছে। ৩ দিন আগেও এক কেজি ওজনের ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছে ৫২ হাজার টাকায়। সেই ইলিশের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার টাকায়। সেই হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়ছে ১ হাজার ৭০০ টাকা। খুচরা বাজারে ওই মাছ বিক্রি করা হয় ২ হাজার থেকে ২২শ টাকা কেজি দরে। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইলিশ মজুদের ফলে মূলত এ মূল্য বৃদ্ধি বলে মনে করছেন সাধারণ ক্রেতারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলা বছরের শুরুর দিন ইলিশ ও পান্তা খাওয়া বাঙালীর নিয়মে পরিণত হয়েছে। বছরের অন্যান্য দিনগুলো বাদ গেলেও অন্তত এই দিন সকলে চায় তাদের আয়োজনে স্থান পাবে পান্তা-ইলিশের। আর সামুদ্রিক ইলিশ লবণাক্ত হওয়ায় বরিশাল অঞ্চলের মিঠা পানির রুপালি ইলিশের কদর একটু বেশিই। তাই বরিশাল অঞ্চলের ইলিশের চাহিদা সারা বছর, সারা দেশে। দেশের বাইরেও রয়েছে এর খ্যাতি। আর এ কারণেই বরিশালের ইলিশের বাজার সব সময় চড়া। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পহেলা বৈশাখের উত্তাপ। বরিশালের বাইরে থেকেও অনেকে আসতে শুরু করেছেন পহেলা বৈশাখের অনুসর্গ হয়ে ওঠা পান্তা ইলিশের ইলিশ সংগ্রহ করতে। সব মিলিয়ে বরিশাল নগরীর পোর্ট রোডের ইলিশ মোকামে লেগেছে বৈশাখী হাওয়া। নববর্ষ যত এগিয়ে আসছে, ইলিশের চাহিদা ততই বেড়ে যাচ্ছে। যে পরিমাণ ইলিশ আসছে তার দুই-তৃতীয়াংশ প্যাকেটজাত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাচ্ছেন আড়তদাররা। বরিশাল মোকামের আড়তদাররাও গোপন স্থানে প্যাকেট মজুদ করে রাখছেন। ফলে সরবারহ সঙ্কটের অজুহাতে প্রতিদিনই ইলিশের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৩০ চৈত্র পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে বলে ইলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও মৎস্য শ্রমিকরা জানান। শুক্রবার সকালে নগরীর পোর্টরোড মোকামে গিয়ে দেখা গেছে, ইলিশের আমদানি মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে সাধারণ ক্রেতাদের চেয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। ইলিশ কেনার দিক থেকেও তারাই ছিলেন এগিয়ে। ক্রয় করা ইলিশ ককশিটে বরফ দিয়ে প্যাকেটজাত করছেন শ্রমিকরা। প্রতিটি আড়ত ঘরের সামনে শত শত ককশিট প্যাকেটের স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই প্যাকেট ঢাকা পাঠানো হবে। নববর্ষ উৎসবে ঢাকায় ইলিশের চাহিদা আকাশচুম্বি। মূল্য পাওয়া যায় অনেক বেশি। ঢাকার আড়তদারদের চাহিদা অনুযায়ী বরিশালের আড়তদাররা প্যাকেটজাত করে প্রতিরাতে ট্রাকে ঢাকায় ইলিশ পাঠাচ্ছেন। নগরীর পোর্টরোড মৎস্য আড়তদার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অজিৎ কুমার দাস মনু জানান, মোকামে শুক্রবার পাইকারি দর ছিল সোয়া কেজি থেকে দেড় কেজির বড় সাইজের ইলিশের মণ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি কেজি ইলিশের পাইকারি দাম পড়ে ৩ হাজার টাকা। ৩ দিন আগে এই ইলিশের মণ ছিল ৮০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি কেজি ইলিশের পাইকারি দাম পড়ে ২ হাজার ২শ টাকা। তবে এ সাইজের ইলিশের আমদারি হয় খুব কম। যে পরিমাণ আসে তার সবটুকুই প্যাকেটজাত করে ঢাকায় পাঠানো হয়। তিনি বলেন, এক কেজি থেকে সোয়া কেজি সাইজের ইলিশের মণ ৮০ হাজার টাকা। প্রতি কেজি ইলিশের পাইকারি দাম পড়ে ২ হাজার টাকা। ৩ দিন আগে এই ইলিশের মণ ছিল ৬৫ হাজার টাকা। তখন প্রতি কেজির দাম ছিল ১৬৫০ টাকা। এক কেজি সাইজের ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছে ৭০ হাজার টাকায়। প্রতি কেজির দাম পড়েছে ১৭শ টাকা। অথচ ৩ দিন আগেও এই ইলিশের মণ ছিল ৫২ হাজার টাকা। প্রতি কেজি ছিল ১৩ শ টাকা। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ৭শ থেকে ৮শ গ্রাম ওজনের ইলিশের। আড়তদাররা এ সাইজের ইলিশকে বলেন এলসি সাইজ। ৩ দিন আগেও এ মাছের মণ ছিল ২৮ হাজার টাকার মধ্যে। শুক্রবার মোকামে মণ বিক্রি হয়েছে ১০ হাজার টাকা বেড়ে ৩৮ হাজার টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম দেড়শ টাকা বেড়েছে। মোকামের একাধিক ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা জানান, নববর্ষ উৎসবে এক কেজির সাইজ থেকে এলসি সাইজ পর্যন্ত ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। নববর্ষের আগে এর মণ লাখ টাকা অতিক্রম করবে বলে আশঙ্কা করছেন মোকামের ব্যবসায়ীরা। বরিশালসহ মফস্বল এলাকায় এ মাছের ক্রেতা থাকে না। এসব সাইজের ইলিশ প্যাকেটজাত করে ঢাকায় পাঠানো হয়। তাই মফস্বল শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নববর্ষ উৎসবে পান্তার সঙ্গে ভরসা হচ্ছে ভ্যালকা ইলিশ। ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজন সাইজের ইলিশকে স্থানীয় ভাষায় ভ্যালকা বলা হয় ইলিশ মোকামে। নববর্ষ যত এগিয়ে আসছে, এর দামও সাধারণ মানুষের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিন দিন আগে ভ্যালকার মণ ছিল ১৮ হাজার টাকার মধ্যে। শুক্রবার সেই ভ্যালকার মণ উঠেছে ২৪ হাজার টাকায়। প্রতি কেজির দাম ছিল ৬০০ টাকা। খুচরা বাজারে আরও ১০০/২০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হয়। হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে নগরীর পোর্টরোড মৎস্য আড়তদার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অজিৎ কুমার দাস মনু জানান, বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে ইলিশের চাহিদা ১০ গুণ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে মাছের আমদানি গত সপ্তাহের চেয়ে কিছুটা কমেছে। ঢাকা থেকে পাইকাররা এসে সমানে মাছ কিনছেন। এসব কারণে ইলিশের দাম উর্ধমুখী। তবে সিন্ডিকেটের বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে জানালেন, সভাপতি অজিৎ কুমার দাস মনু। তিনি বলেন, বরিশালে ফিশ প্রসেসিং বা হিমাগার নেই। তাই ইলিশ মজুদের প্রশ্নই উঠে না। নগরীর পোর্টরোড মোকামের ইলিশের আড়তদার আবুল কালাম আজাদ জানান, এক সপ্তাহ আগেও ৪০০ মণ ইলিশের আমদানি হয়েছে বরিশাল নগরীর পোর্টরোড মোকামে। তবে গত দু’তিন দিন ধরে মোকামে ইলিশের আমদানি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ মণ। এ কারণে দাম বৃদ্ধির দিকে। সামনের দিনগুলোতে আরও দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন তিনি। বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল দাস জানান, অভয়াশ্রমগুলোতে জেলেরা মাছ শিকার করতে না পারায় বাজারে ইলিশের সরবরাহ কিছুটা কম। তবে মে মাসের শুরু থেকেই ইলিশের বাজার স্বাভাবিক হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। ইলিশ মজুদের প্রসঙ্গে বিমল দাস বলেন, কোন ব্যবসায়ী মজুদ করছেন কিনা, তা তার জানা নেই। মজুদের বিষয়ে সরকারেরও কোন বিধি নিষেধ নেই। তারপরেও বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে এবার দাম সহনীয় থাকবে বলে আশা করছেন বিমল দাস।
×