সমুদ্র হক ॥ হিজড়া, বেদে ও হরিজনসহ দেশের দলিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও মানবসম্পদে পরিণত করতে সরকারীভাবে বহুমুখী কর্মসূচী নিয়ে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে উপবৃত্তি প্রদান। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বাড়িয়ে আয়বর্ধনমূলক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসা। পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষা প্রদান। বগুড়া সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোঃ সহিদুল হক খাঁন জানান, দেশে এই প্রথমবারের মতো হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আবাসনের মাধ্যমেও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতর প্রথম পর্যায়ে পাইলট স্কিমের আওতায় বগুড়াসহ দশ জেলায় হিজড়াদের আবাসনের ব্যবস্থা করছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বগুড়ার মাটিডালিতে হিজড়া আবাসনের জন্য দুই একর জমি দেখা হয়েছে। এই বিষয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। শীঘ্রই নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার বগুড়ায় হিজড়া, বেদে রবিদাসী (মুচি) বেহারাসহ দলিত সম্প্রদারের মধ্যে দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচী শুরু হয়েছে। ৫০ দিনের এই প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিজনকে দশ হাজার টাকার উপকরণ সহায়তা দেয়া হবে। এ ছাড়াও প্রতিদিন তারা ৩শ’ টাকা করে ভাতা পাবেন। বগুড়ায় এবারের প্রশিক্ষণে হিজড়া জনগোষ্ঠীর ৫০ জন ও বেদে রবিদাসী ও বেহারা সম্প্রদায়ের ৫০ জন অংশগ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য, ২০১২-১৩ অর্থবছর হতে বগুড়ায় প্রতি বছর এ ধরনের প্রশিক্ষণে এ পর্যন্ত ৫শ’ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে কর্মজীবী করে তোলা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক জানালেন, এ বছর কম্বল বুনন ও পাটজাত দ্রব্যের শপিং ব্যাগ তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে কম্বল ও শপিং ব্যাগের চাহিদা বেশি থাকায় প্রশিক্ষণ শেষে দ্রুত উৎপাদনে গিয়ে পণ্য বাজারজাত করতে পারবে।
সূত্র জানায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর হতে দেশে দলিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান ছাড়াও ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ও তাদের আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে ৫০ বছরের অধিক বয়সী অক্ষম/দুস্থ দলিত সম্প্রদায়কে বিশেষ বয়স্ক ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদফতরের সূত্র জানায়, জরিপে দেখা গেছে দেশে ৪৩ লাখ ৫৮ হাজার দলিত জনগোষ্ঠী আছে। হরিজন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৮৫ লাখ এবং বেদে জনগোষ্ঠী ৭ দশমিক ৮০ লাখ। বেদে সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে মাল বেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারী, বরিয়ালসান্দা, গাইন বেদে, ইত্যাদি। অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মধ্যে আছে জেলে, সন্ন্যাসী, ঋষি, বেহারা, হাজাম, নিকারী, পাটনী, মেথর, ডোম রাউত ইত্যাদি।
এ ছাড়াও দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় হিজড়া জনগোষ্ঠী আছে। বগুড়ায় এই সংখ্যা ৬শ’ এমনটি জানিয়ে সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক সহিদুল ইসলাম খাঁন জানান, চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাদের দৈহিক বা জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ কোন শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। সমাজে এই জনগোষ্ঠী হিজড়া নামে পরিচিত। যার ইংরেজী পরিভাষা ‘ট্রান্সজেন্ডার’। সামাজিক বৈষম্যের কারণে হিজড়া জনগোষ্ঠী নাগরিক অধিকার, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ে স্বাভাবিক অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কখনও তারা সমাজের বোঝা হচ্ছে। এই জনগোষ্ঠীসহ সকল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করে আত্মনির্ভরশীল করে সমাজে সমঅধিকার সাম্যতার ভিত্তিতে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার।