ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষায় বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৩১ মার্চ ২০১৮

 বর্ষায় বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ বর্ষা যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়াতে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের অনেকেরই আবাসস্থল ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে। ঘর নির্মাণের জন্য সেই পাহাড়গুলোকে কাটা হয়েছে যথেচ্ছভাবে। প্রবল বর্ষণে সেখানে ভূমিধসসহ নানা ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস। জাতিসংঘের এ সর্বোচ্চ কর্মকর্তা বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এদিকে, প্রথম দফার তালিকা অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও দ্বিতীয় দফায় আরও ১০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে মিয়ানমারকে হস্তান্তরের জন্য। শুক্রবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জাতিসংঘ মহাসচিবের এই বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উঁচু ভূমিতে পুনর্বাসন করা উচিত। কারণ সামনেই বর্ষা মৌসুম। সম্ভাব্য মানবিক বিপর্যয় এড়াতে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত দেড় লাখ রয়েছে যারা মারাত্মকভাবে বন্যা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সংবাদ কর্মীদের তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থানের মুখে গত বছরের আগস্ট মাস থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের এ পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। কোন ঘোষণা এখনও গৃহীত না হলেও অচিরেই এ ব্যাপারে সমাধানমূলক একটি সিদ্ধান্ত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআর কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে বিপর্যয় ঠেকাতে আগাম প্রস্তুতি নেয়া জরুরী। ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, আগামী জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুম। বর্ষা মৌসুমে দুই ইঞ্চি বৃষ্টিপাতেই রোহিঙ্গারা বন্যা এবং পাহাড় ধসের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। মহাসচিব বলেন, আমি বিশ্বাস করি, সমূহ বিপর্যয়ের আশঙ্কার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানিয়ে দেয়া আমার দায়িত্ব। ১০ হাজার রোহিঙ্গার নতুন তালিকা ॥ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে মিয়ানমারে হস্তান্তরের জন্য নতুন করে ১০ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা চূড়ান্ত করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রথমবারের ৮ হাজার ৩২ জনের যে তালিকাটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হস্তান্তর করা হয়েছিল সেখান থেকে মাত্র ৩৭৪ জনকে রাখাইনের বাসিন্দা বলে স্বীকার করে নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। প্রথম তালিকা অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার মধ্যে দ্বিতীয় তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করছে, প্রত্যাবাসন কাজ এখনও শুরু না হলেও অচিরেই শুরু হবে। দ্বিতীয় তালিকার মাধ্যমেও তা হতে পারে। নতুন তালিকাটি এপ্রিলের শেষে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে মিয়ানমারকে দেয়া হবে বলে জানা গেছে। মিয়ানমার সরকারের নানা অজুহাতে দফায় দফায় পিছিয়ে যাচ্ছে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম। সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একাধিক দফায় বৈঠকে সম্মতি অনুযায়ী রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কিছু আবাসন ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু এর মাঝে আশ্বাসে আশ্বাসে কালক্ষেপণের কাজটিও চলছে সুকৌশলে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ সহজ করতে টেকনাফ ও বান্দরবানের ঘুমধুমে দুইটি ট্রানজিট সেন্টার নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে। শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার আবুল কালাম বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ করতে আমরা কক্সবাজারের টেকনাফ ও বান্দরবানের ঘুমধুমে দুটি ট্রানজিট সেন্টার তৈরি করছি। দুই মাসের মধ্যে এই কেন্দ্রগুলো কাজ শুরু করবে। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে সীমান্তের জিরো লাইনে অবস্থান করা প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে প্রায় দেড়মাস আগে সরিয়ে নেয়ার প্রতিজ্ঞাও করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি সম্পাদনের পরবর্তী দুইমাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন কাজ শুরু করার কথা চুক্তিতে উল্লেখ থাকলেও মিয়ানমার তা উপেক্ষা করে চলেছে। গত বছরের ২৩ নবেম্বর দু’দেশের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন হয়েছে। সে হিসাবে ২৩ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরুর কথা ছিল। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে তৎপর থাকলেও মিয়ানমারের বিভিন্ন টালবাহনার কারণে চুক্তির চারমাসে একটি রোহিঙ্গা পরিবারকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে বললেও রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ভিটেবাড়িতে ‘আদর্শ বৌদ্ধ গ্রাম’ গড়ে তুলে সেখানে রাখাইন, চাকমা, মারমা এবং ম্রো ইত্যাদি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বসতি ঠিক করে দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাশূন্য বাফারজোন প্রতিষ্ঠা করতে সেখানে বৌদ্ধদের অর্থায়ন ও সেনা মদদে বিভিন্ন সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এতে আরও দীর্ঘ হচ্ছে প্রত্যাবাসন বা সেখানে রোহিঙ্গা জীবনের অনিশ্চয়তা।
×