ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভালুুকায় বিস্ফোরণে দগ্ধ তিন কুয়েট ছাত্রকে বাঁচানো গেল না

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৩১ মার্চ ২০১৮

ভালুুকায় বিস্ফোরণে দগ্ধ তিন কুয়েট ছাত্রকে বাঁচানো গেল না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মৃত্যুর কাছে পরাজয় মেনে নিলেন ওরা তিনজন। ভালুকায় বিস্ফোরণের আগুনে মারাত্মক দগ্ধ তিন বন্ধু -হাফিজ, দীপ্ত ও শাহিন চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) বস্ত্র প্রকৌশলী বিভাগের ওই তিন মেধাবী শিক্ষার্থী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির এসআই বাচ্চু মিয়া জানান, ছয়দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে শুক্রবার সকাল নয়টা ১০ মিনিটে বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন দীপ্ত সরকারের (২২) মৃত্যু হয়। আগের রাত দেড়টার দিকে চিকিৎসাধীন মারা যান হাফিজুর রহমান (২৪)। বুধবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দগ্ধ শাহীনও (২৪)। এর আগে ঘটনার দিন ২৪ মার্চ রাতে ওই ভয়াবহ বিস্ফোরণে দীপ্তদের বন্ধু তাওহীদুল ইসলাম তপু ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ব্যাপারে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির প্রধান সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জানান, শুরু থেকেই তাদের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ছিল। সিরাজগঞ্জের নুরুজ্জামান আকন্দের ছেলে শাহীন মিয়ার শরীরের ৮৪ শতাংশ, নওগাঁর বিল্লাল হোসেনের ছেলে হাফিজুর রহমানের ৫৮ শতাংশ এবং দীপ্তর শরীরের ৫৪ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। তাদের সবারই শ্বাসনালী পুড়ে যায়। এ ধরনের রোগীকে বাঁচানো খুবই ক্রিটিক্যাল। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওদের বাঁচানো গেল না। এদিকে বার্ন ইউনিটে কয়েকদিন ধরে ২০-২৫ বন্ধু সর্বদা তাদের বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করলেও বন্ধুদের ভালবাসাকে উপেক্ষা করে ওরা চলে গেল। রাতদিন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে টাকা, রক্ত ও ওষুধসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিল বন্ধুরা। গত ২৪ মার্চ রাতে ময়মনসিংহের ভালুকায় বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে হাফিজ, দীপ্ত ও শাহিন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে প্রহর গুনছিলেন। তাদের সুস্থতায় নির্ঘুম রাত আর ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করেছেন সহপাঠীরা। তবু ওদের বাঁচাতে পারলেন না বন্ধুরা। বন্ধুহারা ওদের কান্নায় ভারি হয় বার্ন ইউনিটের পরিবেশ। গত ২৪ মার্চ রাতে ময়মনসিংহের ভালুকায় একটি ছয়তলা ভবনের তৃতীয় তলায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ছাত্র শাহীন মিয়া, হাফিজুর রহমান ও দীপ্ত সরকার। একই বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা যান আরেক সহপাঠী তাওহীদুল ইসলাম। পরেরদিন বাকি তিনজনকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। জানা গেছে, নিজেদের অসহায় নিম্নবিত্ত পরিবারের হাল ধরার আশায় গত ফেব্রুয়ারিতে কুয়েটে ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ভালুকায় স্কয়ার ফ্যাশন কারখানায় শিক্ষানবিশ (ইন্টার্ন) প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন হাফিজ, দীপ্ত, শাহিন তাওহীদুল ইসলাম তপু। প্রত্যাশা ছিল একমাস পর বস্ত্র প্রকৌশলের স্বীকৃতি নিয়ে বের হবেন। একমাসের জন্য ওই পোশাক কারখানার পাশে মাস্টারবাড়িতে ছয়তলা ভবনের তিনতলায় চার বন্ধু মিলে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু ২৪ মার্চ রাত একটার দিকে ওই বাসার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হন তারা। তাওহীদুল ইসলাম নামে আরও একজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। দগ্ধ তিনজন দীপ্ত, হাফিজ এবং শাহিনকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ও পরে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এদিকে ঘটনার পর পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের সদস্যরা পরে পরীক্ষা করে জানান, গ্যাস থেকেই ওই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। পুলিশ জানায়, ওই ভবনে আগে থেকেই তিনটি সিলিন্ডার রাখা ছিল। এর বাইরে অবৈধভাবে গাস সংযোগ নেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে লিক করে ওই বাসায় গ্যাস জমে যায়। ওই ভবনের মালিক ঝুট ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশ। কুয়েটে তিনদিনের শোক ॥ স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস জানায়, ময়মনসিংহের ভালুকায় বিস্ফোরণের ঘটনায় কুয়েটের চার শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে শোকেস্তব্ধ হয়ে পড়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। গত ২৫ মার্চ রাত ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে এক এবং পরে আহত তিন শিক্ষার্থী ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় একে একে মৃত্যুবরণ করেন। প্রতিভাবান এ শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারসহ সকলকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরোর দেশে। চার শিক্ষার্থীর অকালমৃত্যুতে কুয়েটে তিন দিনের শোক কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী আজ (৩১ মার্চ) থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত কুয়েটের সকল ক্লাস বন্ধ থাকবে। কুয়েটের জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, কুয়েটের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষবর্ষের চার শিক্ষার্থী গত ১০ মার্চ থেকে আগামী ৫ এপ্রিল পর্যন্ত স্কয়ার গ্রুপের একটি টেক্সটাইল মিলে এক মাসের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্টের (ইন্টার্নি) জন্য ময়মনসিংহের ভালুকার মাস্টারবাড়ি এলাকার একটি ৬ তলা ভবনের ৩য় তলায় অবস্থান করছিল। ২৫ মার্চ রাত ১টার দিকে সেখানে বিষ্ফোরণ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় মোঃ তৌহিদুল ইসলাম। গুরুতর দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৮ মার্চ বুধবার রাতে মোঃ শাহীন মিয়া, ২৯ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে মোঃ হাফিজুর রহমান এবং ৩০ মার্চ শুক্রবার সকালে দীপ্ত সরকারের মৃত্যু হয়। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) চার মেধাবী শিক্ষার্থীর অকালমৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীরসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। এক শোক বিবৃতিতে কুয়েট ভাইস-চ্যান্সেলর মৃত শিক্ষার্থীদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এদিকে চার শিক্ষার্থীর অকালমৃত্যুর ঘটনায় কুয়েটে ৩১ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস বন্ধ থাকবে। কুয়েটের জনসংযোগ কর্মকর্তা মনোজ কুমার মজুমদার জানান, খবর শোনার পর পরই আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ছুটে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর। টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এতদিন ঢাকায় অবস্থান করে আহত তিন শিক্ষার্থীর চিকিৎসার জন্য সবধরনের সহযোগিতা প্রদানে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু তাদের এবং চিকিৎসকদের সব চেষ্টা বিফল করে সকলকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলো কুয়েটের মেধাবী এই শিক্ষার্থীরা। এছাড়া, দুর্ঘটনার সঠিক কারণ উদঘটানের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি, বিসিএসআইআরের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমন্বয়ে ৭ (সাত) সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।
×