ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সোশ্যাল মিডিয়ার সব কিছুই সত্যি না, শিশুর জন্য নিরাপদও নয়

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৩১ মার্চ ২০১৮

 সোশ্যাল মিডিয়ার সব কিছুই সত্যি না, শিশুর জন্য নিরাপদও নয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইন্টারনেট ছাড়া এখন কারও ‘চলেই না’। কিন্তু সেই সোশ্যাল মাধ্যমে যা আসছে, তার সব কিছুই আবার সত্যি না, শিশুদের জন্য সব কিছু নিরাপদও না। ইউনিসেফের আয়োজনে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এই সত্য জানল কয়েক হাজার শিশু। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা শপথ নিল- ‘আমি ইন্টারনেট নিরাপদে ব্যবহার করব। ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক হব।’এ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভো থিয়েটারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ১০০ টিরও বেশি স্কুলের ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বাবা-মা, গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারকগণ, শিল্প খাতের নেতৃবৃন্দ, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের শীর্ষ ৫০ ইন্টারনেট পণ্য এবং ২০ লাখ অনলাইন ভিজিটর সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। ‘শিশু-কিশোরদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট’ প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে শুক্রবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভো থিয়েটারে দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ ও ফেসবুক। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ইউনিসেফের কমিউনিকেশন ম্যানেজার এএম শাকিল ফয়জুল্লাহ তাদের সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করছে তাদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের বয়স ১৮-এর নিচে। এই শিশু-কিশোররা ইন্টারনেটের নিরাপত্তা নিয়ে কী জানে, কী ভাবে তা বোঝাই ছিল তাদের জরিপের উদ্দেশ্য। এই জরিপে অংশগ্রহণকারী ১১ হাজার ৮২১ শিশু-কিশোরের ৮১ দশমিক ২ শতাংশ বলেছে, তারা প্রতিদিনই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা ইন্টারনেট ব্যবহার করে মোবাইল থেকে। জরিপের ৫ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা অনুমতি ছাড়া অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি প্রকাশের কথা স্বীকার করেছে। ৩ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছে, অনুমতি নেয়া অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানি বা উত্ত্যক্তের শিকার হওয়ার কথা বলেছে ১৩ শতাংশ শিশু। ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছে, অপরিচিত কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত ছবি বা পারিবারিক তথ্য চাইলে, তাকে সামান্য তথ্য দিলে কোন ক্ষতি হবে বলে তারা মনে করে না। আর ৫২ শতাংশ বলেছে, অপরিচিতি কেউ অনলাইনে বন্ধু হতে চাইলে তাতে তাদের আপত্তি নেই। প্রতিমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে প্রশ্ন আর উত্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেয়া বক্তব্যে শিশুদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেন যে, ইন্টারনেটে যে যাই করছে বা দেখছে, সে কাজে সবারই সতর্ক থাকা দরকার। আমাদের খেয়াল করতে হবে যে আমরা অনলাইনে, ফেসবুকে যা দেখছি সব কিছুই সত্য নয়। যে ছবি দেখছি, যে ইনফর্মেশন পাচ্ছি সেটা অনেক সময় ফেইক (ভুয়া) হতে পারে, সেটা আমাদের সাবধান থাকতে হবে। কখন আর কেন শিশুদের সাবধান থাকতে হবে? উদাহরণ দিতে গিয়ে পলক বলেন, ধর ফেসবুকে দিল তুমি হালকা-পাতলা একটা বাচ্চা; তুমি মোটা হতে চাও তুমি প্রতিদিন সকালে এটা খাও। তুমি খাবে? কেউ বলল মেদ কমানোর জন্য এটা খাও, সেটা খাওয়া যাবে না। ফেসবুকে যাই দেখ বা অনলাইনে যাই শোনো সেটাকে সত্যি মনে করবে না। তোমার বাবা-মা, শিক্ষক বা বড়দের জিজ্ঞেস করবে, সেটা সত্যি কি না। ফেসবুকের একজন ব্যবহারকারী ছেলে না মেয়ে, তার বয়স কত- তা প্রোফাইল পিকচার দেখে যে সব সময় যাচাই করা যায় না, সে বিষয়ে শিশুদের সতর্ক করেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, না দেখে কারও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করা যাবে না। অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে চ্যাট করা যাবে না। গেম খেলা বা অচেনা এ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করার বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। যদি কেউ সাইবার স্পেসে বুলিং করে বা ব্ল্যাকমেল করে তুমি কি ভয়ে চুপ করে থাকবা? কোন কিছুকে বিব্রতকর বিষয় বলে মনে হলে বাবা-মা, শিক্ষক বা বড়দের বলবা, কখনই নীরবে সব কিছু সহ্য করবা না। একটি শিশুর ট্যাবলেট ব্যবহারের ছবি বড় পর্দায় দেখিয়ে তিনি বলেন, আমরা এ রকম ছবি সব বাড়িতে দেখতে চাই। আমাদের শিশুরা ট্যাবলেট, ল্যাপটপ দিয়ে কাজ করবে এ রকমটা আমরা চাই। কিন্তু তারা ইন্টারনেটের ভাল ব্যবহার করবে, নিরাপদ ব্যবহার করবে। ইন্টারনেট ব্যবহার করা যেহেতু বন্ধ করা যাবে না সেহেতু ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে শিশুদের সেই শপথ করান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী। শিশুদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ফেসবুক দিয়ে শুধু ছবি বা ভিডিও শেয়ার করা আর ইউটিউবে শুধু গান বা মুভি দেখা না, এর বাইরেও অনেক প্রোডাক্টিভ কাজ করা যায়। কিন্তু ইউটিউবে থাকা সব কনটেন্টই যে শিশুদের জন্য উপযুক্ত না, সে কথাও তিনি বলেন। জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পার। তবে সেই ইন্টারনেট যদি তোমাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয় তখন কিন্তু তোমাদের সাবধান হতে হবে।’ অনুষ্ঠানে আসা অভিভাবক আর শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন পলক। আমরা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় হয়ত একজন নির্ভরযোগ্য আত্মীয় বা কারো কাছে বাচ্চাকে রেখে গেলাম, দরজায় তালা দিয়ে গেলাম কিন্তু একবারও চিন্তা করি না যে দরজার তালা দেয়া আছে কিন্তু ইন্টারনেটের দুনিয়া বাচ্চাদের খোলা আছে। সে কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে চলে যেতে পারে, যে কোন ছবি ভিডিও সে দেখতে পারে বা শেয়ার করে দিতে পারে। এজন্য বাবা-মায়েদের সব চেয়ে বেশি সতর্ক হতে হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেগবেদার বলেন, ইন্টারনেট তৈরি হয়েছিল বড়দের জন্য। তবে শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠী ক্রমবর্ধমান হারে এটি ব্যবহার করছে এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ক্রমবর্ধমান হারে তাদের জীবন ও ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করে। তাই ডিজিটাল নীতিমালা চর্চা ও পণ্যে শিশুদের প্রয়োজন, শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিশুদের বক্তব্য আরও ভালভাবে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। ফেসবুকের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রোগাম প্রধান রিতেশ মেহতা বলেন, দিনে দিনে শিশুরা অনলাইনে অনেক বেশি সময় ব্যয় করছে, তাই তাদেরকে অনলাইনে নিজেদের নিরাপদ রাখা এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে জানানো খুবই জরুরী। অনলাইনে শিশুদের নিরাপত্তা, বর্তমান সময়ের শিশু, তাদের মা-বাবা ও শিক্ষকদের জন্য খুবই জরুরী। আমাদের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির বিষয়ে শিশুদের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যেতে চাই- যেমনটা আমরা তাদের শেখাইÑ কিভাবে জনাকীর্ণ জায়গায়, খেলার মাঠে ও স্কুলে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। শিশুদের জন্য অনলাইন নিরাপত্তার পক্ষে প্রচার চালাতে ইউনিসেফ ও ফেসবুকের মধ্যে সাম্প্রতিক এই সহযোগিতার লক্ষ্য হচ্ছে আরও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নে এবং শিশুদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে আরও দায়িত্বশীল বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সহায়তা দেয়া; যার মধ্যে রয়েছে সব শিশুর জন্য উচ্চ-মানসম্পন্ন অনলাইন উপকরণসমূহ সহজলভ্য করা। অপব্যবহার, নিগ্রহ, পাচার, সাইবার উৎপীড়ন ও অনুপযুক্ত বিষয়ের মুখোমুখি হওয়াসহ অনলাইনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে শিশুদের সুরক্ষা প্রদান করা। অনলাইনে শিশুদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও পরিচয় সুরক্ষিত রাখা। শিশুদের অনলাইনে সম্পৃক্ত ও নিরাপদ রাখতে তাদের ডিজিটাল শিক্ষা প্রদান করা। অনলাইনে শিশুদের সুরক্ষিত রাখে এবং তাদের উপকারে আসে এমন নৈতিক মান ও চর্চা এগিয়ে নিতে বেসরকারী খাতের ক্ষমতাকে কাজে লাগানো। ডিজিটাল নীতিমালার কেন্দ্রে শিশুদের রাখা। ইউনিসেফ জানায়, বছরব্যাপী এই কর্মসূচীর লক্ষ্য হচ্ছে ডিজিটাল এই যুগে শিশুদের কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো বিস্তারের মাধ্যমে ‘অনলাইন ঝুঁকি’ থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে; সবমিলিয়ে আড়াই কোটি বাংলাদেশী শিশু এবং তাদের বাবা-মা ও শিক্ষকদের কাছে পৌঁছানো।
×