ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডাব বিক্রি করেই চলে শহীদুল্লাহর সংসার

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৩১ মার্চ ২০১৮

ডাব বিক্রি করেই চলে শহীদুল্লাহর সংসার

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ গরম কিংবা শীত সব ঋতুতেই ডাবের পানির সমান কদর রয়েছে। তবে গরমে ডাবের কদর অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়। তাইতো পথেঘাটে পিপাসা নিবারণের জন্য সচেতন মানুষ বেছে নেন ডাবের পানি। গ্রাহকদের মতে, রাজধানীতে যত পানীয় পাওয়া যায় তার মধ্যে ডাবের পানিই সবচেয়ে নিরাপদ। তাই অনেক ক্ষেত্রে কোমল পানীয়র বদলেও তারা বেছে নেন ডাবের পানি। গ্রামে ঘুরে ঘুরে ডাব কেনা, গাছ থেকে পাড়ানো, ট্রাকে ওঠানো, রাজধানীতে পাঠানো, আড়তে নামানো, পাইকারি বিক্রি ও খুচরা বিক্রি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে বহু মানুষ জড়িত। রাজধানীতে অনেকেই এখন বেছে নিচ্ছেন ডাব বিক্রির পেশা। ডাবের ওপর নির্ভর করে সংসার চলছে অনেকেরই। রাজধানীতে বিভিন্ন সড়কে কিছুদূর পরপরই চোখে পড়ে ভ্যানে করে ডাব বিক্রির দৃশ্য। রাজধানী ঢাকায় তোপখানা রোডে জাতীয় প্রেসক্লাবের কোণায় ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করছিলেন মোঃ শহিদুল্লাহ। তিনি ৪০ বছর ধরে ডাবের ব্যবসা করে আসছেন। দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে তিনি ডাব হাতে নিয়েই বুঝতে পারেন কোনটায় কতটুকু পানি আছে, কোনটায় সর বা শাঁস হয়েছে, কোনটার শাঁস শক্ত হয়েছে, কোনটায় পানি কম। শহিদুল্লাহ জানান, ৪০ বছর আগে এক শ’ ডাব কিনতেন ৭০ টাকায় আর এখন একটু বড় সাইজের এক শ’ ডাব কিনতে অন্তত সাড়ে চার হাজার টাকা লাগে। ডাব বিক্রিতে তার খুব সুনাম রয়েছে। অনেকেই তার কাছ থেকে ডাব কিনে খান। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও তার কাছ থেকে ডাব কিনে খেয়েছেন বলে জানান তিনি। শহিদুল্লাহর বাড়ি লক্ষ্মীপুরের নোয়াগাঁও ইউনিয়নের সাউধেরখিল গ্রামে। রাজধানীর ইসলামপুরে কয়েকজন মিলে মেসে থাকেন। তার পরিবার থাকে গ্রামে। তিনি চার মেয়ে ও দুই ছেলের বাবা। বড় মেয়েকে এসএসসি পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সেজো মেয়ে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ও ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। বড় ছেলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েই পাঠ চুকিয়েছে। ছোট জন মাদ্রাসায় পড়ে। শহিদুল্লাহ জানান, ডাবের ব্যবসা করেই সংসারের খরচ এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চলছে। যা আয় করেন খরচ হয়ে যায়। অতিরিক্ত কিছু জমাতে পারেননি। দিনে অন্তত দেড় শ’ ডাব বিক্রি করতে পারেন। তার কাছে সবচেয়ে বড় একটি ডাবের দাম ৭০ টাকা। তাতে সাড়ে তিন থেকে চার গ্লাস পানি হয়। তবে গুলশান এলাকায় বড় সাইজের প্রতিটি ডাব ৯০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন তিশা নামের একজন ডাব কিনছিলেন। তিনি জানান, ‘প্রায়ই এই ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে তিনি ডাব কিনে খান। কারণ, তিনি মনে করেন ডাবের পানি সবচেয়ে নিরাপদ।’ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান ডাবের দোকানে ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতার ডাব পছন্দ এবং দরদাম ঠিক হলে বিক্রেতা দা দিয়ে একপাশে কেটে ফুটো করে দেন। এরপর ছোট পাইপ দিয়ে ক্রেতা পানি পান করেন। কারো পছন্দ কচি ডাব, কেউ চান ভেতরে হালকা একটু শাঁস, আবার কেউ চান শক্ত শাঁস। কিছু ক্রেতা ডাবের পানি পান করা হলে ভেতরের শাঁস খাওয়ার আগ্রহ দেখান। তার কাছ থেকে ডাবের খোল হাতে নিয়ে তা দা দিয়ে কেটে দুই ভাগ করে শাঁস তুলে দেন বিক্রেতা। আকার ভেদে একেকটি ডাবের দাম ৪০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত হয়। রাজধানীতে শুধু রাস্তার পাশে নয়, ফলের দোকানে ও অভিজাত সুপার চেইন শপগুলোতেও ডাব পাওয়া যায়। তবে রাস্তার পাশে ডাবের ভ্যান থেকে ফলের দোকানে দাম একটু বেশি। তার চেয়ে আরো বেশি দাম চেইন শপগুলোতে। সুপার শপগুলোতে ডাব কেটে সাইজ করে প্যাকেট জাত করে রাখা হয়। যা দেখতেও সুন্দর লাগে। বারডেম হাসপাতালের প্রাক্তন চীফ নিউট্রেশন অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান আক্তারুন্নাহার আলো জনকণ্ঠকে জানান, ‘ডাবের পানি প্রাকৃতিক পানীয়। এতে প্রচুর পটাশিয়াম আছে। ১০০ গ্রাম ডাবের পানিতে প্রায় ১৮০ মিলি গ্রাম পটাশিয়াম থাকে। ডাবের পানি খাওয়ার পরে পটাশিয়ামের জন্য শরীরে একটা শীতল আমেজ আসে। পটাশিয়াম হার্টের রোগীর জন্য খুবই ভাল। তবে শরীরে যদি পটাশিয়াম বেশি থাকে সেক্ষেত্রে তার জন্য ডাবের পানি পান করা ঠিক নয়। ডাবের পানি চর্বি বাড়ায় না। ডাবের পানি রক্তে চর্বির কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। ক্লোরাইড আছে ১১৭ গ্রাম। ক্লোরাইড আমাদের দাঁত ভাল রাখে। ডাবে ক্যালরি কম থাকে। তাই ডাব খেলে অনেক মোটা মানুষেরও কোন সমস্যার আশঙ্কা নেই। কার্বোহাইডও তুলনামূলক কম থাকে। ক্যালসিয়াম থাকে ১৫ মিলিগ্রামের মতো। ডাবে সোডিয়াম থাকে খুব কম। ডাবের গুণাগুণ প্রসঙ্গে এই পুষ্টিবিদ আরও বলেন, ‘ডাবের পানি আমাদের শরীরের ডিহাইড্রেশন রোধ করে। মুখে পক্সের বা অন্য কোন দাগ থাকলে, দৈনিক ডাবের পানি দিয়ে মুখ ধুলে দাগ থাকে না। প্র¯্রাবে সংক্রমন থাকলে তা রোধ করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গর্ভকালীন সময়ে ডাব খেলে তাতে এ্যান্টি ফাঙ্গাল, এ্যান্টি ভাইরাস হিসেবে কাজ করে। এটার মধ্যে এটা ল্যারিক এসিড আছে, এটার জন্য এ্যান্টি ভাইরাস এ্যান্টি হিসেবে কাজ করে। অনেকের ধারণা যে ডাব খেলে সর্দি হয়। কিন্তু ধারণাটা একেবারেই ভুল উল্লেখ করে এই পুষ্টিবিদ বলেন, ডাবের সঙ্গে সর্দি বা ভাইরাসের কোন সম্পর্ক নেই। গরমে ডায়েরিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। ডায়েরিয়া প্রতিরোধের জন্য ডাবের পানি খুবই উপকারী। শরীরের পানি শূন্যতা রোধ করে। আমাদের ঘামের সঙ্গে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফ্লোরাইড-অনেক কিছুই শরীর থেকে বের হয়ে যায়। শরীরের ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হয়ে যায়। ইমব্যালেন্স রোধ করার জন্য আমরা প্রতিদিন যদি একটা বা দুইটা ডাব খেতে পারি তাহলে আমাদের শরীর বেশ ভাল থাকবে। সুতারাং ডাব শরীরের জন্য সব দিক থেকে ভাল। অন্য সফট ড্রিঙ্কের তুলনায় ডাবের দাম বেশি অভিযোগ করে এই পুষ্টিবিদ বলেন, ৫০ থেকে ৬০ টাকার কমে খাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ডাব খুব ব্যয়বহুল পানীয়। দাম বেশি হওয়ায় অনেক মানুষ ডাব না খেয়ে অন্য পানীয় পান করেন। তারা মনে করেন, পেপসি, ডিউ, সেভেন আপ এ ধরনের সফট ড্রিঙ্ক ১৫ টাকা করে হলে, একটা ডাবের টাকায় তিনটা সফট ড্রিঙ্ক খেতে পারবেন। তাই টাকা বাঁচাতে ডাব না খেয়ে তারা সফট ড্রিঙ্ক খেয়ে থাকেন। আর টাকা বেশি খরচ হলেও একটু সচেতন যারা তারা ডাব খান। সকলে যাতে ডাব কিনে খেতে পারেন সেজন্য দাম সাধ্যের মধ্যে রাখা যায় কিনা সে ব্যাপারে সরকারী-বেসরকারীভাবে ভেবে দেখে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।’ বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার মসনি গ্রামের মোঃ রাহাতুল ইসলাম তিন বছর ধরে ডাবের ব্যবসা করছেন। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডাব কেনেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ডাব কেনা হয় গড়ে ১৫ টাকা করে। এরপর পরিবহন খরচ রয়েছে। একদিন পর পর তিন শ’ থেকে চার শ’ ডাব গাড়িতে করে রাজধানীর পোস্তগোলা পাঠাই। কখনো কখনো যাত্রাবাড়ীতে পাঠাই। আড়তে যাওয়ার পর ডাব তিন সাইজে বিক্রি হয়। একেক সময় একেক দামে বিক্রি হয়। ছোট সাইজ ডাব গড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা, মাঝারি সাইজের ২২ থেকে ২৮ এবং বড় সাইজের ২৮ থেকে ৪০ টাকা করে বিক্রি হয়। বাগেরহাট থেকে শুধু ঢাকায় নয়, কোন কোন ব্যবসায়ী মাগুরা ও বগুড়া পাঠান। যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা ও কাওরান বাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ডাবের আড়ত রয়েছে। একেক আড়তে একেক রকম দাম। কাওরান বাজারে মেসার্স মাহফুজ ট্রেডিংয়ের মালিকের পক্ষে মোঃ মিসকাত জনকণ্ঠকে জানান, কাওয়ান বাজারে ডাবের অন্তত ১৫টি আড়ত রয়েছে। সেখানে সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি হয়। বরিশালের বিভিন্ন জেলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চল, নড়াইল, নোয়াখালী থেকে প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডাব ঢাকা মহানগরীতে আসে। বেশি আসে বরিশাল ও নোয়াখালী থেকে। তিনি বলেন, ‘আড়তে ডাব বিক্রি হয় এক শ’ হিসেবে। সময় ও চাহিদার ওপর দাম ওঠানামা করে। ছোট এক শ’ ডাব গড়ে ১৫শ’ থেকে দুই হাজার টাকা, মাঝারি ২২শ’ থেকে ২৮শ’ টাকা এবং বড় ডাব তিন হাজার টাকা থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়। দিন দিন ডাবের চাহিদা বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শতভাগ নিশ্চিত যে ডাবে কোন ভেজাল নেই। তাই ডাবের চাহিদা বাড়ছে।’ উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের মতো ভারত ও মধ্য আমেরিকার অনেক দেশে (যেমন কোস্টারিকা ও পানামা) রাস্তার পাশে বিক্রেতারা ডাব বিক্রি করেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে টাটকা ডাবের পানির ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এছাড়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহে ক্যানে ভরে অথবা বোতলে ভরে ডাবের পানি বিক্রি করা হয়। মাটির গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে ডাবের পানির স্বাদ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন- ভারতের ডাব মিষ্টি হলেও ব্রাজিলের ডাব হয় একটু পানসে। আবার বাংলাদেশের ডাবের পানি বেশ মিষ্টি হয় তবে একটু হাল্কা নোনতা স্বাদও থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে নারকেল তেল মিলগুলোয় গত কয়েকবছর ধরে মন্দা যাচ্ছে। কোন কোন নারকেল তেল ব্যবসায়ী এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। নারকেল তেল ব্যবসায় মন্দার পেছনে যতগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ডাব বিক্রি হয়ে যাওয়ায় মিলগুলোতে নারকেলের সঙ্কট। চাহিদা মেটাতে ডাবের উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হর্টিকালচার উইংয়ের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (ফল ও ফুল) মাহবুবা মুনমুন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় অর্থাৎ উপকূলীয় ১৭ জেলায় নারকেল চাষ বেশি হয়। এখন নতুন যে খাটো জাতের (বামন জাতের গাছ) নারকেল এসেছে, তা উপকূলীয় জেলাসহ সারাদেশে চাষের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত সারাদেশে ২ লাখ ১০ হাজার খাটো জাতের নারকেল গাছ লাগানো হয়েছে।’
×