ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাগরের নোনা জলে বেড়ে ওঠা সেকান্দার ১২৪ বছরের যুবক

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৩১ মার্চ ২০১৮

সাগরের নোনা জলে বেড়ে ওঠা সেকান্দার ১২৪ বছরের যুবক

মুই আর কত কাল বাঁচমু, মোর বয়স ১২৪ বচ্ছর, কত মানুষ মোর হাতে কবর দিছি। মোর কবর কে দেবে? মোরে আল্লায় এ্যাহোনও বাঁচাইয়্যা রাখছে। নাতি, পুতি, ছাতি দ্যাখলাম আর কত মোরো আল্লায় দ্যাহাইবে। মোর পোলারা বুড়া অইয়্যা গ্যাছে। হ্যাগো নাতিপুতি অইছে। এর পরও মোরে বাঁচাইয়্যা রাখছে। তিন চাইডা যুদ্ধ দ্যাখলাম, বড় বড় বইন্যা দ্যাখলাম, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধ দ্যাখলাম। মোর দ্যাহার তো কোন শ্যাষ নাই। মোরো আর আল্লায় কত দ্যাহাইবে। বঙ্গোপসাগরের তুফানের লগে যুদ্ধ কইর‌্যা মুই বঁাঁইচ্যা আছি। তুফান শ্যাষ অইয়্যা গ্যাছে মোর কিছু অয়নাই। বইন্যায় সাগরে মায়রে, দুইডা বউ, দুইডা পোলা, তিন মাইয়্যা লইয়্যা গ্যাছে। রায়োডের সোমায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কতা হুনছি আজও হের কতা মোর কানে ফাসে। হেই অইতে বঙ্গবন্ধুর দলে নাম ল্যাহাইছি, আইজও মুই হ্যার দল হরি। মুই হ্যার দলের সভাপতি। এ কথা বলেছেন বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার নিশানবাড়ীয়া ইউনিয়নের বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন নলবুনিয়া গ্রামের ১২৪ বছর বয়সী সোকান্দার আলী হাওলাদার। তিনি আরও দাবি করে বলেন, মোর মতো বয়সী লোক এ্যাহোন আর একজনও এ্যালাকায় বাঁইচ্যা নাই। মুই এ দেশের বুড়া মানুষ। মোর মতে এ্যাতো পোলা মাইয়্যা ও নাতি-নাতনি কার আছে? বাবা মোক্তার আলী হাওলাদারের মৃত্যুর পরে ১৯৩০ সালের দিকে পরিবার পরিজন নিয়ে দুই ভাই মকবুল হোসেন হাওলাদার ও সেকান্দার আলী হাওলাদার পাথরঘাটার জাজিরা গ্রাম থেকে নলবুনিয়ার গ্রামে আসেন। ওই সময় বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন নলবুনিয়া এলাকায় তেমন জনবসতি ছিল না। শুধু ছিল বন আর বন। চারদিকে মানুষের অস্তিত্ব মেলা ছিল ভার। দু’ভাই সাগরে মাছ ধরে ও বন কেটে জমি আবাদ করত। ওই আবাদী জমিতে উৎপাদিত ফসল ও সাগরের মাছ আহরণই ছিল বঁাঁচার সম্ভব। পাথরঘাটা উপজেলার জাজিরা গ্রামে ১৮৯৪ সালে মোক্তার আলী হাওলাদারের ঘরে জন্ম নেয় সেকান্দার আলী হাওলাদার। বাবা আদর করে ডাকত সেকু। দুই ভাইয়ের মধ্যে সেকান্দার ছোট। নলবুনিয়া এলাকার মানুষ তাকে ডাকত ছোট মিয়া। বড় ভাই আলহাজ মকবুল হোসেন ১০ বছর পূর্বে ১১৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। বঙ্গোপসাগরের নোনা জলে বেড়ে ওঠা সেকু আজ ১২৪ বছর বয়সী বৃদ্ধ সেকান্দার। তিনি নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় বৃদ্ধ মা হাচন বরু, দুই স্ত্রী, দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে হারায়। ওই বন্যায় তারা সাগরবক্ষে হারিয়ে যায়। একা হয়ে পড়ে সেকান্দার হাওলাদার। মা, স্ত্রী ও সন্তান হারানো বেদনা ভুলতে সেকান্দার হাওলাদার পুনরায় পর পর দুটি বিয়ে করেন। ওই দুই স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয় ৯ ছেলে ও ৪ মেয়ে। বর্তমানে ওই ছেলেমেয়ের ঘরে জন্ম নেয়া তার ৩৮ নাতি ও নাতনি রয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও ভুলতে পারেনি ১৯৭০ সালে হারানো স্বজনদের। তাদের হারানো স্মৃতি আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। দুই স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে কোলাহলে দিন কাটায় সেকান্দার হাওলাদার। এত মানুষের আতিথেয়তা হাসি-খুশি যেন তার জীবনে এনে দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য ও নতুন বৈচিত্র্য। স্বজনে ভরপুর সেকান্দার হাওলাদার সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিনাতিপাত করছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জমান সেকান্দার হাওলাদার এখনও নিজের শক্তির বলে কারও সহযোগিতা ছাড়া হেঁটে বেড়াচ্ছেন। বন্ধুসুলভ এ মানুষটি সব সময় কোলাহলে ঘুরে বেড়ায়। বয়স যেন তাকে ছুঁতেই পারেনি। সকাল হলে সাগরপাড়ে জেলে, পর্যটক ও পরিচিত-অপরিচিত কাউকে নিয়ে মেতে ওঠে জীবনের গল্পে। পর্যটক ও অপরিচিতজনরা তার গল্পে কোন বিরক্তি ভোধ করে না। এখনও স্পষ্ট করে বলতে পারেন সব কিছু। স্বাক্ষর জ্ঞানহীন সেকান্দার আলী হাওলাদারের ২ স্ত্রী, ৯ ছেলে, ৪ মেয়ে ও ৩৮ নাতি-নাতনি বর্তমানে বেঁচে আছে। কলেজ পড়ুয়া নাতি নাঈম হাওলাদার জানান, আমরা আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত এত বছর বয়সী দাদা এখনও বেঁচে আছেন। দাদাকে নিয়ে আমরা ৩৮ নাতি-নাতনি আনন্দ-উল্লাসের মধ্যেই দিন কাটাই। তখনই বেশি আনন্দ লাগে যখন দাদা আমাদের কোন সামান্য অপরাধে শাসন করে। ছেলে আলমগীর হাওলাদার বলেন, আমরা ধন্য বাবার জন্য ধন্য সন্তান। বাবা এত বছর বয়সে কারও সাহায্য ছাড়া নিজেই চলাফেরা করতে পারে। কোলাহল ছাড়া থাকতেই পারে না। মানুষের সঙ্গে দিনভর গল্প করে বেড়ায়। সকলের কাছে দোয়া চাই বাবা যেন সুস্থ সবল মতো আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। নিশানবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ দুলাল ফরাজী বলেন, সেকান্দার হাওলাদার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের গর্ব। তার মতো এত বয়সী লোক কোথাও বেঁচে আছে কিনা আমার জানা নেই। তিনি আরও জানান, এত বৃদ্ধ বয়সে তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি। শত কষ্ট হলেও সব মিটিং-মিছিলে তিনি উপস্থিত হয়। সবচেয়ে বেশি বয়সী মানুষ হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই। -মোঃ হোসাইন আলী কাজী, আমতলী-বরগুনা থেকে
×