ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গুলির শব্দে মিলিয়ে যেত আর্তচিৎকার

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৩১ মার্চ ২০১৮

গুলির শব্দে মিলিয়ে যেত আর্তচিৎকার

ময়মনসিংহের নান্দাইলে অযতœ, অবহেলা আর উদাসীনতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া মানুষ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি বিজড়িত বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। কালীগঞ্জ রেলওয়ে ব্রিজটিতে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও এখানে কোন স্মৃতিফলক স্থাপন দূরের কথা, বধ্যভূমির স্থানটি আজও চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে ’৭১-এ পাকবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে বহু বাঙালীর শহীদ হওয়ার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অজানাই রয়ে যাচ্ছে। সরেজমিনে জানা গেছে, উপজেলার মুশুলী ইউনিয়ন এলাকায় ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথে নরসুন্দা নদীর ওপর কালীগঞ্জ ব্রিজটি অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদাররা স্বাধীনতাকামী নিরীহ লোকজনকে ধরে এই ব্রিজের কাছে হত্যা করে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী জানান, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও এদের দোসর রাজাকার, আল-বদররা দূর-দূরান্ত থেকে লোকজনকে ধরে ট্রেনে করে নিয়ে আসত। এরপর ব্রিজের পাশে তৈরি করা বাংকারে নির্যাতন শেষে হাত, পা বেঁধে ওই ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দিত। কখনো এক রশিতে অনেককে একত্রে বেঁধে গুলি চালাত হানাদাররা। প্রতিরাতে চলত হত্যাকা-। এখানে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা কয়েক হাজার লোককে এখানে এনে হত্যা করা হয়। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে কিশোরগঞ্জ মহকুমার প্রশাসক ও মুক্তিযোদ্ধারা সড়ক পথে তারেরঘাট পাকা সেতু ও রেল পথের শুভখিলা গ্রামে কালীগঞ্জ রেলসেতুটি ধ্বংস করে দেয়। তারেরঘাট সেতুটি ডিনামাইট দিয়ে পুরোপুরি ধ্বংস করা হলেও রেল সেতুটির মাঝের একটি অংশ ধ্বংস করা হয়। এতে কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ শহরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা প্রবেশ করে। তারা ময়মনসিংহ প্রবেশের চেষ্টা করলে শুভখিলা-কালীগঞ্জ রেলসেতুতে এসে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ট্রেন আটকে পড়ায় নরসুন্দা নদী পাড় হয়ে উত্তর পাশে যাবার সময় দু’জন মাঝিকে গুলি করা হত্যা করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। ওই সময় এক দিনেই চারটি গ্রামের অন্তত ২১ জন মানুষকে হত্যা করা হয়। রেল সেতুটি বিদ্ধস্ত থাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা নরসুন্দা নদীর দুই পাশে বিশাল আস্তানা গড়ে তোলে। আস্তানার পাশে গড়ে তোলা হয় মানুষ জবাই করার কসাইখানা। ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে জামালপুর, ময়মনসিংহ, গৌরীপুর, ঈশ্বরগঞ্জ, সোহাগী, আঠারবাড়ি, নান্দাইল, ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, সরারচর, মানিকখালি, গচিহাটা, কিশোরগঞ্জ, নীলগঞ্জ স্টেশন থেকে নিরীহ মানুষকে এনে হত্যাযজ্ঞ চালানো হতো। ব্রিজের পাশের বাসিন্দা রাজগাতী খালপাড় গ্রামের বৃদ্ধ সুজন পাঠান (৭৫) ও বাবর আলী (৭৮) জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মেজর হানাদারের নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক জনগণ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে এ ব্রিজটি ভেঙে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানী বাহিনী আশপাশের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারপর সেখানে বাংকার তৈরি করে অবস্থান নেয়। তারা আরও জানায়, ব্রিজটি ভাঙ্গা থাকায় ট্রেন এসে দু’পাশে থামত। হানাদার বাহিনী ট্রেন থেকে আটক করে প্রতিদিন মানুষ হত্যা করত। একই গ্রামের ফাইজুল ইসলাম (৫৫) বলেন, উপজেলার খামারগাঁও গ্রামের মজুমদার বাড়ির তিন সহোদরকে এ ব্রিজে এনে হত্যা করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল মজিদ (৭৮) বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী খাদিজা পাকিস্তানী হানাদারদের গুলিতে আহত হয়ে এখনো তার স্মৃতি চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ আশরাফ উদ্দিন ভুঁইয়ার বাড়ি সেতুর কাছেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। আশরাফ উদ্দিন ভুঁইয়া জনকণ্ঠকে জানান, পাকিন্তানীদের প্রবেশ রুখতে তারেরঘাট সেতু ও কালীগঞ্জ রেলসেতু ধ্বংস করেও পাকিস্তানীদের প্রবেশ রোখা যায়নি। পাকিস্তানীরা ট্রেন থামিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পরবর্তীতে রেল সড়কটি মেরামত করে চলাচল শুরু করে পাকিস্তানীরা। যুদ্ধকালীন সময় ট্রেনযোগে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষকে কালীগঞ্জ রেল সেতুতে নিয়ে আসা হতো। এখানে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশগুলো খরস্রোতা নরসুন্দায় ভাসিয়ে দেওয়া হতো। মুক্তিকামী ও সাধারণ মানুষ ভর্তি ট্রেনগুলো থামার পর মানুষ বাঁচার জন্য আর্তচিৎকার শুরু করত। কিন্তু নিমিষেই গুলির মুহুর্মুহু শব্দে মিলিয়ে যেত সেই আর্তচিৎকারের আওয়াজ। তিনি হতাশ হয়ে বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও বধ্যভূমিটিতে কোন স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। সেতুটির পাশে দাঁড়িয়ে কথা হয় আবদুল কদ্দুছ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। সেতুর পাশেই তার বাড়ি। তিনি মৃত সাহেব আলীর ছেলে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১২ বছর বয়সী আবদুল কদ্দুছ এখনও অনেক কিছু মনে রেখেছেন। তিনি জানান, হঠাৎ একদিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষদের বলা হয় দূরে স্বজনদের বাড়িতে চলে যেতে। পরিবারের সঙ্গে তারাও পাশের গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নেন। রাতের অন্ধকার বিকট শব্দে ভেঙে দেওয়া হয় রেলসেতুর মাঝের একটি অংশ। তিনি আরও বলেন, তার বাবা পাকিস্তানী ভাষায় কথা বলতে পারতেন। নদীতে নৌকা দিয়ে পারাপারের কাজ করতেন তার বাবা। সেই কারণে বাবার সঙ্গে সেতু এলাকায় প্রায়ই অবস্থান করতেন তিনি। ট্রেন এসে থামার পর মানুষকে সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে বলা হতো। বাঁচার জন্য চিৎকার করতো ট্রেনের ভেতরে থাকা অন্য মানুষও। একে একে পেছন দিক থেকে হাত বাঁধা মানুষকে সেতুর ওপর পাঠিয়ে পেছন থেকে গুলি করে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া হতো। সেই হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি মনে করে এখনও আঁতকে ওঠেন আবদুল কদ্দুছ। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার মাজহারুল হক ফকির জানান, রেলসেতুটিতে যুদ্ধকালীন পুরু সময় ধরে হত্যা যজ্ঞ চালানো হয়। ট্রেনযোগে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এনে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। হাজার হাজার মানুষের হত্যাযজ্ঞ চলে সেতুটিতে। বধ্যভূমিটিতে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা অনুমোদন না হওয়ায় বধ্যভূমিটিতে কোন স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা যায়নি। সাবেক কমান্ডার গাজী আবদুস ছালাম (বীর প্রতীক) বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও নৃশংসতা চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যার স্থানটি আজও চিহ্নিহ্নত করা হয়নি। স্থাপিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানটিতে যাওয়ার জন্য ভাল কোন রাস্তাও নেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, এই বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ তিনি মোমবাতি প্রজ্বলন করতে যান। ওই সময় সংসদ সদস্য বধ্যভূমিটিতে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের অঙ্গীকার করেন। -মজিবর রহমান ফয়সাল নান্দাইল, ময়মনসিংহ থেকে
×